02.কোরআন কি আল্লাহর বাণী?

বেশিরভাগ মুসলমানই এই কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, কোরআনের প্রতিটি বাক্য হচ্ছে সরাসরি আল্লাহর মুখ থেকে মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট বাণী বা নির্দেশনা কিংবা বলা যেতে পারে জীবনবিধান। কোরআনেই বলা আছে, [1]

এবং এটা কোন কবির কালাম নয়; তোমরা কমই বিশ্বাস কর।
এবং এটা কোন অতীন্দ্রিয়বাদীর কথা নয়; তোমরা কমই অনুধাবন কর।
এটা বিশ্বপালনকর্তার কাছ থেকে অবতীর্ণ।
সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত,
তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম,
অতঃপর কেটে দিতাম তার গ্রীবা।

তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করতে পারতে না।

যদি কোরআনকে আল্লাহর সরাসরি বাণী এবং সৃষ্টির আদিকাল থেকে “লাওহে মাহফুজ”-এ সংরক্ষিত বলে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে এর বক্তব্যগুলোতে কোনো অসঙ্গতি বা বিভ্রান্তি থাকার কথা নয়। কোরআন অনুসারে, জিব্রাইল ছিলেন শুধুমাত্র বাহক এবং মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বাণী প্রাপক ও প্রচারক। এই যুক্তিতে, কোরআনের প্রতিটি শব্দই আল্লাহর নির্ভুল এবং অপরিবর্তিত বাণী হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে, কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও সূরায় একাধিক বিভ্রান্তিকর বক্তব্য লক্ষ্য করা যায়, যেখানে কখনো আল্লাহ কথা বলছেন, কখনো নবী কথা বলছেন, আবার কখনো মনে হয় জিব্রাইলের বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমনকি কিছু কিছু আয়াতে দেখা যায়, আল্লাহ নিজেই আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছেন! যেমন, “আমি শয়তানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই” – এই ধরনের আয়াত কি আদৌও আল্লাহর সরাসরি বক্তব্য হতে পারে? যদি তা না হয়, তাহলে এই বক্তব্যগুলো আসলে কার? এতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, কোরআন একটি সুসংহত এবং একক বক্তার বাণী নয়। এটি হয়তো বিভিন্ন সূত্র থেকে সংকলিত এবং এর প্রতিটি অংশই আল্লাহর সরাসরি বাণী নয়। এটি কেবল কোরআনের ঐশ্বরিকতা এবং নির্ভুলতার দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং ধর্মগ্রন্থটির আদি রচনাশৈলী ও সত্যতা সম্পর্কেও গুরুতর সন্দেহের জন্ম দেয়। যদি কোরআনের প্রতিটি বক্তব্যই আল্লাহর নিজের হয়, তবে একাধিক বক্তার অসংগঠিত উপস্থিতি, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপনা, এবং এমন বক্তব্য কেন থাকবে যা সরাসরি আল্লাহর বক্তব্য বলে মেনে নেওয়া যায় না? এই অসঙ্গতিগুলোই প্রমাণ করে, কোরআনের “আল্লাহর সরাসরি বাণী” হিসেবে প্রচলিত বিশ্বাস একটি চরম অসত্য এবং বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা একটি কল্পনা মাত্র। যেমন ধরুন আল্লাহ কোরআনে বলছেন,

  • পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
  • আল্লাহরই জন্য সমস্ত প্রশংসা, যিনি বিশ্বজগতের রাব্ব।
  • যিনি পরম দয়ালু, অতিশয় করুণাময়।
  • যিনি বিচার দিনের মালিক।
  • আমরা আপনারই ইবাদাত করছি এবং আপনারই নিকট সাহায্য চাচ্ছি।
  • আমাদেরকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন।
  • তাদের পথ, যাদের আপনি অনুগ্রহ করেছেন। তাদের পথে নয়, যাদের প্রতি আপনার গযব বর্ষিত হয়েছে, তাদের পথও নয় যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। ( সূরা ফাতিহা )

এবারে আসুন বিষয়টি ভালভাবে বুঝি। ধরুন, করিম বলছে তার ছেলেকে রহিমকেঃ

হে রহিম, বেশি করে পুষ্টিকর খাবার খাও, যা তোমার শরীরের জন্য ভাল।

অথবাঃ

হে রহিম, বেশি করে পুষ্টিকর খাবার খাও, যা আমি তোমার জন্য নিয়ে আসি। নিশ্চয়ই আমি উত্তম খাবার বাজার থেকে কিনে আনি।

কিন্তু এই কথা পিতা করিম তার ছেলে রহিমকে কখনই বলবে না, এরকম কেউ বললে কথাগুলো তার ছেলে রহিমের বক্তব্য বলেই বোঝা যাবেঃ

  • শুরু করছি বাজার থেকে উত্তম খাবার নিয়ে আসা পিতা করিমের নামে
  • সম্মানীত পিতা করিমই উত্তম খাবার বাজার করে আনেন
  • যিনি অত্যন্ত দয়ালু, খুবই উদার
  • বাজারের তাজা সবজি আর মাছ উনিই সবচেয়ে ভাল চেনেন
  • আমরা আপনার কাছ থেকেই স্কুল টিফিনের টাকা পাই
  • আমরা আপনার কাছ থেকেই স্কুলের বেতনের টাকা চাই
  • হে পিতা, আমাদেরকে বিকাল বেলা ফুটবল খেলতে দিন
  • আর যারা আপনার খাবার খেয়ে আপনার তোষামোদি করে না,
  • আপনার মাথা আর পিঠ টিপে দেয় না,
  • তাদের ওপর গযব নাজিল করুন

আবার যেমন নিচের সূরাটি লক্ষ্য করি –

  • হে মানবসমাজ, তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন[2]
  • যে কেউ আল্লাহ ও রাসুলের অবাধ্যতা করে ও তার সীমা অতিক্রম করে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। [3]
  • আর তোমরা আকাংক্ষা করো না এমন বিষয়ে যাতে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের একের ওপর অন্যের শ্রেষ্টত্ব দান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ, নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ। আর আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত। [4]

উপরের সূরার আয়াতগুলো পড়ে স্পষ্টই মনে হচ্ছে, কথাগুলো সরাসরি আল্লাহ পাকের কথা নয়। মুহাম্মদের কথা, জিব্রাইল কিংবা অন্য কারো। কোরআনের প্রতিটি শব্দ যদি আল্লাহ পাকেরই বক্তব্য হয়ে থাকে, তাহলে এই সূরাগুলো হওয়ার কথা নিম্নরূপঃ

  • হে মানবসমাজ, তোমরা তোমাদের পালনকর্তা অর্থাৎ আমাকে ভয় কর, আমি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছিআমি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছি
  • যে কেউ আমার এবং আমার রাসুলের অবাধ্যতা করে ও তার সীমা অতিক্রম করে, আমি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবো
  • আর তোমরা আকাংক্ষা করো না এমন বিষয়ে যাতে আমি তোমাদের একের ওপর অন্যের শ্রেষ্টত্ব দান করেছি। পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ, নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ। আর আমার কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আমি সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত।

কোরআনের ৫১ নম্বর সূরাটি হচ্ছে সূরা যারিয়াত। এই সূরাটির ৪৬ থেকে শুরু করে ৫১ নম্বর আয়াত আসুন পড়ে দেখা যাক, [5]

৪৬। আর ইতঃপূর্বে নূহের কওমকেও (আমি ধ্বংস করে দিয়েছিলাম)। নিশ্চয় তারা ছিল ফাসিক কওম।
৪৭। আর আমি হাতসমূহ দ্বারা আকাশ নির্মাণ করেছি এবং নিশ্চয় আমি শক্তিশালী।
৪৮। আর আমি যমীনকে বিছিয়ে দিয়েছি। আমি কতইনা সুন্দর বিছানা প্রস্তুতকারী!
৪৯। আর প্রত্যেক বস্তু থেকে আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি। আশা করা যায়, তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে।
৫০। অতএব তোমরা আল্লাহর দিকে ধাবিত হও। আমি তো তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য এক স্পষ্ট সতর্ককারী।
৫১। আর তোমরা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহ নির্ধারণ করো না; আমি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য এক স্পষ্ট সতর্ককারী।

প্রশ্ন হচ্ছে, ৪৯ নম্বর আয়াত পর্যন্ত আমি বলতে যদি আল্লাহকে বোঝানো হয়, তাহলে ৫০ এবং ৫১ নম্বর আয়াতে এই আমিটি আসলে কে? একই সূরার এক আয়াতে আমি বলতে যদি আল্লাহকে বোঝানো হয়, অর্থাৎ আয়াতটি সরাসরি আল্লাহর বাণী হয়ে থাকে, পরের আয়াতে আমি বলতে নবীর কথা বোঝানো হচ্ছে কেন? আসুন আরো একটি সূরার দুইটি আয়াত পড়ে দেখি [6]


আলিফ, লাম, রা; এটা এমন একটা গ্রন্থ, এর আয়াতগুলো সুদৃঢ়, অতঃপর সবিস্তারে ব্যাখ্যাকৃত মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞের নিকট হতে।
— Taisirul Quran
আলিফ লাম রা। এটি (কুরআন) এমন কিতাব যার আয়াতগুলি (প্রমাণাদী দ্বারা) মাযবূত করা হয়েছে। অতঃপর বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে; প্রজ্ঞাময়ের (আল্লাহর) পক্ষ হতে।
— Sheikh Mujibur Rahman
আলিফ-লাম-রা। এটি কিতাব যার আয়াতসমূহ সুস্থিত করা হয়েছে, অতঃপর বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে প্রজ্ঞাময়, সবিশেষ অবহিত সত্ত্বার পক্ষ থেকে।
— Rawai Al-bayan
আলিফ–লাম-রা, এ কিতাব, যার আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট [১], সুবিন্যস্ত ও পরে বিশদভাবে বিবৃত [২] প্রজ্ঞাময়, সবিশেষ অবহিত সত্তার কাছ থেকে [৩];
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

(এটা শিক্ষা দেয়) যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ‘ইবাদাত করবে না, আমি অবশ্যই তাঁর পক্ষ হতে তোমাদের জন্য ভয় প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদদাতা।
— Taisirul Quran
এ (উদ্দেশে) যে, আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদাত করনা; আমি (নাবী) তাঁর (আল্লাহর) পক্ষ হতে তোমাদেরকে সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা।
— Sheikh Mujibur Rahman
(এ মর্মে) যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করো না। নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য তাঁর পক্ষ থেকে সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা।
— Rawai Al-bayan
যে, তোমরা আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যের ইবাদাত করো না [১], নিশ্চয় আমি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা [২]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

তাহলে, এই সূরাগুলোর এইসব বক্তব্য কী আল্লাহ নিজ মুখে বলেছেন? নাকি আল্লাহ বলেছেন একভাবে, জিব্রাইল বলেছে আরেকভাবে, আর মুহাম্মদ লিখেছে আরেকভাবে? মানে, ব্যক্তিভেদে বক্তব্যের কী পরিবর্তিত হয়েছে? সরাসরি আল্লাহর বানী হলে তো অন্যরকম হওয়া উচিত ছিল। যেমন ধরুন, সূরা কাউসার এর আয়াতগুলো পড়ি [7]

আমি তোমাকে (হাওযে) কাওসার দান করেছি।
— Taisirul Quran
আমি অবশ্যই তোমাকে কাওছার দান করেছি,
— Sheikh Mujibur Rahman
নিশ্চয় আমি তোমাকে আল-কাউসার দান করেছি।
— Rawai Al-bayan
নিশ্চয় আমরা আপনাকে কাউছার [১] দান করেছি।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

সূরা ফাতিহা নিয়ে আলোচনার সময় মুমিন ভাইদের বক্তব্য থাকে, সূরা ফাতিহা নাজিল হয়েছে এমনভাবে যেন বান্দারা তা পড়তে পারে। এটি যদি আল্লাহ পাকের বক্তব্য হিসেবে নাজিল হতো, তাহলে কেউ এই সূরাটি নামাজের সাথে পড়তে পারতো না। মুসুল্লিদের পড়ার সুবিধার্থেই সূরাটি এমনভাবে নাজিল হয়েছে। কারণ এভাবে না নাজিল হলে বান্দারা সূরাটি পড়ার সময় সেটি কোন সেন্স মেইক করতো না। কিন্তু একই কথা কী সূরা আল কাউসারের জন্য প্রযোজ্য নয়? এই সূরাটি যখন মুসুল্লিরা নামাজের মাঝে পড়েন, তারা আরবি ভাষাতে বলেন, নিশ্চয়ই আমি (মানে যিনি সূরাটি পড়ছেন তিনি) মুহাম্মদকে আল কাউসার দান করেছি। এর অর্থ হয়, মুসুল্লিরা মুহাম্মদকে কিছু একটা দিচ্ছেন। এই কথাটি কোন অর্থ বহন করে?

এবারে আসুন আরেকটি আয়াত পড়ি. লক্ষ্য করুন, আল্লাহ নিজেই নিজের কসম কেটে কিছু কথা বলছেন। এটি কেমন কথা যে, আল্লাহ নিজেই নিজের কসম দিচ্ছে! নাকি সত্য কথাটি হচ্ছে, এই আয়াতগুলো লেখার সময় তালগোল পাকিয়ে লেখা হয়েছে, যার কারণে কোন কথাটি মুহাম্মদের, কোন কথাটি জিবরাইলের আর কোন কথাটি আল্লাহর সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি? [8]

আল্লাহর কসম! তোমার পূর্বে আমি বহু জাতির কাছে রসূল পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু শয়ত্বান তাদের কাছে তাদের কার্যকলাপকে শোভনীয় করে দিয়েছিল, আর আজ সে-ই তাদের অভিভাবক, তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।
— Taisirul Quran
শপথ আল্লাহর! আমি তোমার পূর্বেও বহু জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি; কিন্তু শাইতান ঐ সব জাতির কার্যকলাপ তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল; সুতরাং সে’ই আজ তাদের অভিভাবক এবং তাদেরই জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
— Sheikh Mujibur Rahman
আল্লাহর শপথ, আমি তোমার পূর্বে বহু জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি। অতঃপর শয়তান তাদের জন্য তাদের কর্মকে শোভিত করেছে। তাই আজ সে তাদের অভিভাবক। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক আযাব।
— Rawai Al-bayan
শপথ আল্লাহ্‌র! আমরা আপনার আগেও বহু জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি; কিন্তু শয়তান ঐসব জাতির কার্যকলাপ তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল; কাজেই সে –ই আজ [১] তাদের অভিভাকক আর তাদেরই জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

এবারে সূরা মুমতাহিনার ৭ নম্বর আয়াতটির বাঙলা এবং ইংরেজি অনুবাদ পড়ি [9]। বলুন তো, যিনি সকল কিছুর তাকদীর সৃষ্টির পূর্বেই লিখে রেখেছেন, সেই আল্লাহ পাক কেন নিজের বক্তব্যের মধ্যে সম্ভবত শব্দটি ব্যবহার করবেন? আমরা সাধারণ মানুষ নিজের কোন কাজের বিষয়ে আশা করা যায় বা সম্ভবত বা হয়তো শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকি। মাঝে মাঝে আমরা বলি, সম্ভবত আমি আজকে দুপুরে ইলিশ মাছ খাবো। বা আশা করি আজকে আমি ইলিশ মাছ খাবো। এর কারণ হচ্ছে, আমরা নিশ্চিতভাবে সবকিছু জানি না। অনেক কিছু বিচার বিবেচনা করে সাধারণ কিছু ধারণা করতে পারি। যদি বাসায় ইলিশ মাছ রান্না হয়ে থাকে, তার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, সম্ভবত আজ দুপুরে আমরা ইলিশ মাছ খাবো। কিন্তু ভিন্ন কিছুও ঘটতে পারে। যেমন ইলিশ মাছটি যদি বেড়াল খেয়ে যায়, তাহলে আর আমার ইলিশ মাছ খাওয়া আজ হবে না। এগুলো হচ্ছে নানা ধরণের সম্ভাবনা, তাই আমরা হয়তো বা সম্ভবত শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকি। তবে আমরা আশাকরি সাম্ভাব্যতার ভিত্তিতে।

কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে তো এরকম শব্দ ব্যবহারের কোন কারণ নেই। কারণ আল্লাহ নিশ্চিতভাবেই সবকিছু জানেন। এর আরবি শব্দটি লক্ষ্য করুন, শব্দটির অর্থ হয়তো, সম্ভবত, আশা করা যায় ইত্যাদি। তাহলে আল্লাহও কী কোন ঘটনা সম্পর্কে অনিশ্চিত? তিনিও কী আশা করেন? কেন করেন? কার কাছে আশা করছেন তিনি? তাহলে, এই কথাটি তো কোনভাবেই আল্লাহর কথা হতে পারে না। আল্লাহ নিজের সম্পর্কে কেন সম্ভবত শব্দটি ব্যবহার করে কিছু বলবেন? তাহলে কথাটি কী জিব্রাইলের, নাকি নবীর? নাকি আমাদের মত সাধারণ মানুষের? আল্লাহ লওহে মাহফুজে আসলে কী লিখে রেখেছিলেন? সম্ভবত আমি এটি করবো, সেটি করবো? সেটি কীভাবে সম্ভব? [10]

সম্ভবত আল্লাহ তোমাদের মধ্যে আর তাদের মধ্যেকার যাদেরকে তোমরা শত্রু বানিয়ে নিয়েছ তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দিবেন (তাদের মুসলিম হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে)। আল্লাহ বড়ই শক্তিমান, আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু।
— Taisirul Quran
যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা রয়েছে সম্ভবতঃ আল্লাহ তাদের ও তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দিবেন; আল্লাহ সর্বশক্তিমান, পরম দয়ালু।
— Sheikh Mujibur Rahman
যাদের সাথে তোমরা শত্রুতা করছ, আশা করা যায় আল্লাহ তোমাদের ও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। আর আল্লাহ সর্ব শক্তিমান এবং আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
— Rawai Al-bayan
যাদের সাথে তোমাদের শক্ৰতা রয়েছে সম্ভবত আল্লাহ তাদের ও তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন [১] এবং আল্লাহ্‌ ক্ষমতাবান। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
Perhaps Allah will put, between you and those to whom you have been enemies among them, affection. And Allah is competent,1 and Allah is Forgiving and Merciful.
— Saheeh International

অনেক মুসলিমই বলবেন, এগুলো আল্লাহ পাক বলে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, কীভাবে আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করতে হয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই সূরাটিও কী আল্লাহর মুখের বাণী? [11]

তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।

এরকম অসংখ্য সূরা আছে, যেখানে মূল বক্তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ বলেই বোঝা যায়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহ মুহাম্মদের কাছে সূরাটি একভাবে পাঠিয়েছিলেন, আর মুহাম্মদ সূরাটি নিজের মত করে বলেছেন। আল্লাহ আসলে বলেছিলেন,

আমি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবো, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আমি(আল্লাহ) তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আমার (আল্লাহর) প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আমার (আল্লাহর) দল। জেনে রাখ, আমার (আল্লাহর) দলই সফলকাম হবে।

এই বক্তব্যটি জিব্রাইলকে বলা হয়েছিল, যেখানে জিব্রাইল কথাটি শুনে মুহাম্মদকে বলেছেন, মুহাম্মদ মুসলিমদের বলেছেন। যার কারণে বাচ্য পরিবর্তিত হয়ে গেছে।

যেমন ধরুন, আল্লাহ বলছেঃ “আমি সর্বশক্তিমান। আমি সব করতে সক্ষম।” এই কথাটি জিব্রাইল শুনলো। এবং তিনি মুহাম্মদকে বললেন, “আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি সব করতে সক্ষম।” মুহাম্মদ কথাটি শুনলো। এবং তিনি মুসলিমদের বললেন যে, আল্লাহর কাছ থেকে ওহী আসলো যে, আল্লাহ জানিয়েছেন, “আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি সব করতে সক্ষম। ”

লক্ষ্য করে দেখুন, একই বক্তব্য, তিনজনার কাছে এসে বক্তব্যগুলোর কিছু পরিবর্তন ঘটে গেল। তাহলে, কোরআনে মুহাম্মদ বা জিব্রাইল বা বান্দাদের যেসকল বক্তব্য পাওয়া যায়, সেগুলো তো আল্লাহর সরাসরি বক্তব্য হতে পারে না। আল্লাহ তো কথাগুলো সেভাবে বলবেন না।

আবার ধরুন, নিচের আয়াতটি লক্ষ্য করুনঃ [12]

তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন অতঃপর আমি এর দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি, অতঃপর আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি, যা নুয়ে থাকে এবং আঙ্গুরের বাগান, যয়তুন, আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত এবং সাদৃশ্যহীন। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ্য কর যখন সেগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্কতার প্রতি লক্ষ্য কর। নিশ্চয় এ গুলোতে নিদর্শন রয়েছে ঈমানদারদের জন্যে।

এবারে ভেবে বলুন তো, উপরের আয়াতে তিনিই কে এবং আমি কে? একই বাক্যের মধ্যে যদি তিনি এবং আমি ব্যবহৃত হয়, তা কী একই জনকে উদ্দেশ্য করে বলা হতে পারে?

আরো দেখুনঃ [13] [14]

তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্রপুঞ্জ সৃজন করেছেন যাতে তোমরা স্থল ও জলের অন্ধকারে পথ প্রাপ্ত হও। নিশ্চয় যারা জ্ঞানী তাদের জন্যে আমি নির্দেশনাবলী বিস্তারিত বর্ণনা করে দিয়েছি।

তিনিই তোমাদের কে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অনন্তর একটি হচ্ছে তোমাদের স্থায়ী ঠিকানা ও একটি হচ্ছে গচ্ছিত স্থল। নিশ্চয় আমি প্রমাণাদি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি তাদের জন্যে, যারা চিন্তা করে।

লক্ষ্য করুন, একই আয়াতে একবার বলা হচ্ছে তিনি, আবার বলা হচ্ছে আমি। এই আয়াতটির মূল বক্তা কে? আল্লাহ, নবী, জিব্রাইল না বান্দা? আবার ধরুন, নিচের আয়াতটি যদি পর্যালোচনা করি [15],

আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার উপর বর্তায় যা সে করে। হে আমাদের পালনকর্তা, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি, তবে আমাদেরকে অপরাধী করো না। হে আমাদের পালনকর্তা! এবং আমাদের উপর এমন দায়িত্ব অর্পণ করো না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর অর্পণ করেছ, হে আমাদের প্রভূ! এবং আমাদের দ্বারা ঐ বোঝা বহন করিও না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নাই। আমাদের পাপ মোচন কর। আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের কে সাহায্যে কর।

উপরের সূরার আয়াতটি কার বক্তব্য? প্রথম লাইনটি আল্লাহ বা নবী বা জিব্রাইলের বক্তব্য হতে পারে। কিন্তু পরের লাইনগুলো তো পরিষ্কারভাবেই মানুষের বক্তব্য। কোন মানুষের প্রার্থণা, বা প্রত্যাশা। মানুষের কথাবার্তা কোরআনে আল্লাহর বানী হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে কীভাবে? তাছাড়া, আল্লাহ শুরুর লাইনে যেখানে বলেই দিচ্ছেন, আল্লাহ সাধ্যাতীত কাজের ভার কারো ওপর চাপান না, পরের লাইনে আবার বলা হচ্ছে, আমাদের ওপর এমন ভার চাপিও না যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। পূর্ববর্তীদের ওপর যা চালিয়েছো! আয়াতটির মধ্যে প্রবল স্ববিরোধীতা লক্ষ্য করছেন?

আসুন আরেকটি আয়াত পড়ি। এখানে পড়ে বলুন তো, এটি কার বাণী, আল্লাহর, জিবরাইলের নাকি মুহাম্মদের? [16]

তোমরা যে সব বিষয়ে মতভেদ কর তার মীমাংসা আল্লাহর উপর সোপর্দ. সেই আল্লাহই আমার প্রতিপালক, আমি তাঁর উপরই নির্ভর করি, আর তাঁরই অভিমুখী হই।
— Taisirul Quran
তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন, ওর মীমাংসাতো আল্লাহরই নিকট। বলঃ তিনিই আল্লাহ! আমার রাব্ব। আমি নির্ভর করি তাঁর উপর এবং আমি তাঁরই অভিমুখী!
— Sheikh Mujibur Rahman
আর যে কোন বিষয়েই তোমরা মতবিরোধ কর, তার ফয়সালা আল্লাহর কাছে; তিনিই আল্লাহ, আমার রব; তাঁরই উপর আমি তাওয়াক্কুল করেছি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী হই।
— Rawai Al-bayan
আর তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ করা না কেন-–তার ফয়সালা তো আল্লাহরই কাছে। তিনিই আল্লাহ্ — আমার রব; তাঁরই উপর আমি নির্ভর করেছি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী হই।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria


তথ্যসূত্র

  1. সূরা আল হাক্কাহ, আয়াত ৪১ – ৪৭ []
  2. সূরা নিসা, আয়াত ১ []
  3. সূরা নিসা, আয়াত ১৪ []
  4. সূরা নিসা, আয়াত ৩২ []
  5. সূরা যারিয়াত, আয়াত ৪৬- ৫১ []
  6. সূরা হুদ, আয়াত , []
  7. সূরা আল কাউসার, আয়াত ১ []
  8. কোরআন, ১৬ঃ৬৩ []
  9. সূরা মুমতাহিনা, আয়াত ৭ []
  10. সূরা মুমতাহিনা, আয়াত ৭ []
  11. সূরা আল মুজাদালাহ, আয়াত ২২ []
  12. কোরআন ৬ঃ৯৯ []
  13. কোরআন ৬ঃ৯৭ []
  14. কোরআন ৬ঃ৯৮ []
  15. কোরআন ২ঃ ২৮৬ []
  16. সূরা আশ-শুয়ারা, আয়াত ১০ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"