ইসলামে চুরির শাস্তি হিসেবে কোরআনে বর্ণিত আছে, “চোর নারী হোক বা পুরুষ, তার ডান হাত কেটে দাও” [1]। এই বিধানকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে, তবে আয়াতে কোথাও উল্লেখ নেই যে কতটুকু বা কোন পরিস্থিতিতে এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। এটি একটি গুরুতর সমস্যা, কারণ এটি আধুনিক সভ্য আইন এবং বিচার ব্যবস্থার পরিপন্থী। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ ক্ষুধার্ত অবস্থায় একটি আম বা একটুকরো রুটি চুরি করে, তবে কি তাকে শারীরিকভাবে এত কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে? এটি স্পষ্টতই প্রশ্নবিদ্ধ এবং অমানবিক। ইসলামিক শরিয়া আইন এই ধরনের কঠোর শাস্তির মাধ্যমে অপরাধ দমনের প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু এর ফলে কোন অবস্থাতেই অপরাধ কমে না, বরঞ্চ মানবাধিকার ভয়ঙ্করভাবে লঙ্ঘিত হয়। ইতিহাসে অপরাধ বিজ্ঞান বিষয়ক এবং সমাজ বিজ্ঞানের গবেষণাতে এরকম কোন প্রমাণ মেলেনি যে, এরকম ভয়ঙ্কর শাস্তি কোথাও চুরি প্রতিরোধ করতে পারে।
হাদিসে এই শাস্তির প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত উল্লেখ আছে, যেমন: চুরি করতে হবে একটি নির্দিষ্ট মূল্যের অধিক, এবং এই শাস্তি অপ্রাপ্তবয়স্ক, মানসিক ভারসাম্যহীন বা নিরুপায় অবস্থায় অপরাধ করলে প্রযোজ্য নয়। তবে এই শর্তগুলো কোরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই, যা ধর্মীয় আইনের ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগে অস্পষ্টতা ও বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। ইসলামী আইনের সমালোচকরা বলে থাকেন, বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এটি অগ্রহণযোগ্য, যেখানে মানবাধিকারের মানদণ্ড অনুযায়ী সকল মানুষের অঙ্গহানি থেকে নিরাপত্তা পাওয়া তার মৌলিক মানবাধিকার।
চুরি করার শাস্তি হিসেবে হাত কেটে ফেলা শুধু যে শারীরিকভাবে নির্মম তা-ই নয়, এটি অপরাধীর জীবনের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে। এর ফলে অপরাধীর পুনর্বাসন এবং সমাজে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়। সারাজীবনের জন্য সে একজন চোর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়, যার ফলে তার সামাজিক সম্মান, তার পরিবারের সামাজিক সম্মান নষ্ট হয়। সে আর কোনদিন সুস্থ সামাজিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না। আধুনিক বিচারব্যবস্থায় অপরাধীদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়, যাতে তারা সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে, শরিয়া আইনে চুরি করার শাস্তি হিসেবে হাত কেটে ফেলাকে প্রয়োগ করা হয় একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে, যা সমাজে ভয় সৃষ্টি করে অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এটি অপরাধীর জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং তাকে সমাজের প্রান্তিক ও বিতাড়িত শ্রেণীতে পরিণত করে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের আলোকে এই ধরনের শাস্তি অমানবিক এবং বর্বর হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি ব্যক্তির শারীরিক অখণ্ডতা এবং মর্যাদার পরিপন্থী। এমন শাস্তির পদ্ধতি সমকালীন সভ্যতা এবং ন্যায়বিচারমূলক মানদণ্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটি সভ্যতার বিকাশ ও মানবিকতার সুরক্ষায় বাধা সৃষ্টি করে। শরিয়া আইনের এই ধরনের শাস্তির প্রয়োগের পরিবর্তে অপরাধীদের সংশোধন, শিক্ষাদান এবং পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা জরুরি। মানবিক ও ন্যায়সংগত পন্থায় অপরাধ প্রতিরোধ করাই সময়ের দাবি এবং ইসলামের প্রকৃত মানবিক শিক্ষার প্রতিফলনও তাই হওয়া উচিত।
আর চোর ও চোরনী তাদের হাত কেটে দাও, তাদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ, আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আল্লাহ হলেন মহাপরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী।
Taisirul Quran
আর যে পুরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে, তোমরা তাদের কৃতকর্মের সাজা হিসাবে তাদের (ডান হাত) কেটে ফেল, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি, আর আল্লাহ অতিশয় ক্ষমতাবান, মহা প্রজ্ঞাময়।
Sheikh Mujibur Rahman
আর পুরুষ চোর ও নারী চোর তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও তাদের অর্জনের প্রতিদান ও আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষণীয় আযাবস্বরূপ এবং আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
Rawai Al-bayan
আর পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও; তাদের কৃতকর্মের ফল ও আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে (১)। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
( কোরআন ৫ঃ৩৮ )
সহীহ মুসলিম
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
অধ্যায়ঃ ৩০/ অপরাধের শাস্তি
৪২৫৯। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ) … ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ঢাল চুরির অপরাধে এক চোরের হাত কর্তন করেন। ঢালটির মূল্য ছিল তিন দিরহাম।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৩০/ অপরাধের শাস্তি
৪২৫১। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া, ইসহাক ইবনু ইবরাহীম ও ইবনু আবূ উমার (রহঃ) … আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক দ্বীনারের এক চতুর্থাংশ এবং এর অধিক পরিমাণ মূল্যের মাল চুরির অপরাধে চোরের হাত কর্তন করতেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সুনানে ইবনে মাজাহ
অধ্যায়ঃ ১৪/ হদ্দ (দন্ড)
১/২৫৮৩। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ চোরের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত, ডিম চুরি করার অপরাধে যার হাত কাটা যায় এবং রশি চুরি করার অপরাধে যার হাত কাটা যায়।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৩০/ অপরাধের শাস্তি
৪২৬১। আবূ বাকর ইবনু আবূ শায়বা (রহঃ) ও আবূ কুরায়ব (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা অভিসম্পাত করেন সে চোরের ওপর, যে একটি ডিম (বা ডিমের মূল্যের পরিমাণ বস্তু) চুরি করল। এতে তার হাত কাটা যাবে। আর যে ব্যক্তি একটি দড়ি (কিংবা দড়ির সমম্যূল্যর পরিমাণ বস্তু) চুরি করল, তারও হাত কাটা যাবে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সূনান আবু দাউদ (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৩৩/ শাস্তির বিধান
পরিচ্ছদঃ ২০. যে বার বার চুরি করে, তার শাস্তি সস্পর্কে।
৪৩৫৮. মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ্ (রহঃ) ……. জাবির ইবন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ জনৈক চোরকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে হাযির করা হলে, তিনি তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। তখন সাহাবীগণ বলেনঃ হে আল্লাহ্র রাসুল! এ লোক তো কেবল চুরি করেছে! তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তবে তার হাত কেটে দাও। তখন সে ব্যক্তির ডান হাত কেটে দেওয়া হয়। এরপর সে দ্বিতীয়বার চুরি করলে, তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত করা হয় এবং তিনি তার হত্যার নির্দেশ দেন। তখনও সাহাবীগণ বলেনঃ হে আল্লাহ্র রাসুল! সে তো কেবল চুরি করেছে। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তার পা কেটে দাও। তখন তার বাম-পা কেটে ফেলা হয়। এরপর সে ব্যক্তিকে তৃতীয় বার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে পেশ করা হলে, তিনি তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। তখন সাহাবীগণ বলেনঃ হে আল্লাহ্র রাসুল! সে তো চুরি করেছে। এরপর তিনি কাটার নির্দেশ দিলে, সে ব্যক্তির বাম-হাত কাটা হয়। পরে সে ব্যক্তিকে চতুর্থবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে পেশ করা হলে, তিনি তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। তখনও সাহাবীগণ বলেনঃ হে আল্লাহ্র রাসুল! এ ব্যক্তি তো চুরি করেছে। তখন তিনি কাটার নির্দেশ দিলে তার ডান-পা কেটে ফেলা হয়। এরপর সে ব্যক্তিকে পঞ্চমবারের অপরাধের কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে হাযির করা হলে, তিনি তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। জাবির (রাঃ) বলেনঃ এরপর আমরা তাকে প্রান্তরে নিয়ে হত্যা করি এবং তার লাশ টেনে কূপের কাছে নিয়ে তাতে নিক্ষেপ করি। পরে তার মৃত দেহের উপর পাথর নিক্ষেপ করি।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
সুনানে ইবনে মাজাহ
তাওহীদ পাবলিকেশন
অধ্যায়ঃ ১৪/ হদ্দ (দন্ড)
১/২৫৮৭। ইবনে মুহাইরীঝ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ফাদালা ইবনে উবাইদ (রাঃ) কে কর্তিত হাত কাঁধের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, এটাই নিয়ম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির হাত কেটে তা তার কাঁধের সাথে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন।
হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai’f)
তথ্যসূত্র
- সূরা আল-মায়িদা ৫:৩৮ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"