10.কাফের হত্যা করলে মৃত্যুদণ্ড নেই

ইসলামী শরীয়ত বা ইসলামী আইনে মুসলিম ও অমুসলিমের জীবনের মূল্য বৈষম্যমূলকভাবে নির্ধারিত, যা আধুনিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে একজন মুসলিমের জীবন অনেক বেশি মূল্যবান; তাই একজন মুসলিম যদি কোনো অমুসলিমকে হত্যা করে, তবে তার জন্য প্রাণদণ্ড প্রযোজ্য নয়। অন্যদিকে, একজন অমুসলিম যদি কোনো মুসলিমকে হত্যা করে, তবে তাকে অবশ্যই প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। এই বৈষম্যমূলক আইন শুধু যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে তাই নয়, এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সভ্য সমাজের ন্যায়বিচারমূলক মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

প্রথমত, এই আইনের মূল সমস্যা হচ্ছে—এটি মানবজীবনের মর্যাদাকে ধর্মের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে। আধুনিক সমাজে প্রতিটি মানুষের জীবন সমানভাবে মূল্যবান এবং এর কোনো ধর্মীয়, জাতিগত বা সামাজিক ভিত্তিতে পার্থক্য করা যায় না। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, সব মানুষ সমান অধিকার এবং মর্যাদা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং তাদের জীবনের সমান মূল্য থাকা উচিত। কিন্তু ইসলামী শরীয়তের এই আইনটি ধর্মের ভিত্তিতে জীবনের মূল্য কম-বেশি করে একটি বিপজ্জনক ও অসভ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এটি সাম্প্রদায়িক হিংসা, বৈষম্য এবং সামাজিক বিভাজন তৈরি করে, যা একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রধান অন্তরায়।

দ্বিতীয়ত, এই আইন বিচার প্রক্রিয়ায় অন্যায় বৈষম্য তৈরি করে। একজন অমুসলিম যদি কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হয়, বিশেষত কোনো মুসলিমের জীবন কেড়ে নিলে, তার জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বিপরীত পরিস্থিতিতে, একজন মুসলিম অপরাধ করলে তার শাস্তি তুলনামূলকভাবে লঘু বা শিথিল করা হয়। এই ধরনের বৈষম্যমূলক বিচারব্যবস্থা আইনের ন্যায্যতা এবং সাম্যবাদী আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এটি অপরাধীদের মধ্যে শাস্তির সাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় এবং ধর্মের নামে ন্যায়বিচারকে ধ্বংস করে। এই আইনের অধীনে, অপরাধের বিচার ও শাস্তির ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট এবং এটি সমাজে ন্যায়বিচারের ধারণাকে দুর্বল করে দেয়।

তৃতীয়ত, এই ধরনের আইন রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করে। ধর্মের ভিত্তিতে জীবন-মৃত্যুর এই বৈষম্যমূলক মূল্যায়ন অমুসলিম নাগরিকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। এটি তাদের জন্য একটি ভীতিকর ও বৈরী পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে তারা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময় শঙ্কিত থাকে। এই আইন সংখ্যালঘুদের প্রতি অবিচার ও নিপীড়নকে বৈধতা দেয় এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করে।

চতুর্থত, ইসলামী শরীয়তের এই আইনটি নৈতিক ও মানবিকতার আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একটি সভ্য সমাজের ভিত্তি হলো ন্যায়বিচার, সমতা, এবং প্রত্যেকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। যখন একজন অমুসলিমের জীবনের মূল্য কমিয়ে দেখা হয়, তখন এটি মানবিক মর্যাদার প্রতি সরাসরি আঘাত করে এবং একটি ভ্রান্ত বার্তা প্রদান করে যে, কিছু মানুষের জীবন অন্যদের তুলনায় কম মূল্যবান। এটি সামাজিক সামঞ্জস্য ও আন্তঃসম্পর্ককে বিষিয়ে তোলে এবং রাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে।

এছাড়া, এই ধরনের বৈষম্যমূলক আইন একটি সভ্য ও মানবিক সমাজ গঠনের পথে অন্তরায়। আধুনিক বিচারব্যবস্থা অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি না করে আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট। অপরাধীর ধর্ম, জাতি, বা সামাজিক অবস্থান বিচার প্রক্রিয়ার কোনো অংশ হতে পারে না। কিন্তু ইসলামী শরীয়তের এই আইন বৈষম্য ও বিভাজনের মাধ্যমে একটি পশ্চাৎপদ ও অসভ্য বিচারব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করে।

সব মিলিয়ে, ইসলামী শরীয়তের এই আইন আধুনিক মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক সমতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এটি শুধু যে সংখ্যালঘুদের জন্য একটি বৈরী পরিবেশ তৈরি করে তাই নয়, বরং সমগ্র সমাজকে বিভাজিত করে। এই আইনকে সভ্য সমাজের মাপকাঠিতে একটি বর্বর এবং অগ্রহণযোগ্য বিচারব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা মানবিকতার মৌলিক আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই, সভ্য মানুষ হিসেবে আমাদের দাবি হলো—সকল ধর্মের মানুষকে সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করা এবং একটি ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠন করা, যেখানে সকলের জীবন সমানভাবে মূল্যবান এবং সুরক্ষিত।

আসুন এই বিষয়ে বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আলেমের বক্তব্য শুনে নিই,

সেইসাথে উল্লেখ্য, আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, কোন মুসলমান কোন জিম্মি অর্থাৎ জিজিয়া কর দেয়া অমুসলিমকে হত্যা করলে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না, তবে তার জন্য কোন দুনিয়াবি শাস্তির কথা কিন্তু বলা নেই। যেখানে মুসলিমকে হত্যা করা হলে তার দুনিয়াবি এবং আখিরাত উভয় শাস্তির কথাই বলা আছে [1] [2] [3] [4]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৮৭/ রক্তপণ
পরিচ্ছদঃ ৮৭/৩১. কাফেরের বদলে মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না
৬৯১৫. আবূ জুহাইফাহ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের কাছে এমন কিছু আছে কি যা কুরআনে নেই? তিনি বললেন, দিয়াতের বিধান, বন্দী-মুক্তির বিধান এবং (এ বিধান যে) কাফেরের বদলে কোন মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না। (১১১) (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৪৩৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৪৪৭)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সুনানে ইবনে মাজাহ
পাবলিশারঃ তাওহীদ পাবলিকেশন
‏অধ্যায়ঃ ১৫/ রক্তপণ
পরিচ্ছদঃ ১৫/২১. কাফের ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করা যাবে না
১/২৬৫৮। আবূ জুহাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আলী ইবনে আবূ তালিব (রাঃ) কে বললাম, আপনাদের নিকট এমন কোন জ্ঞান আছে কি যা অন্যদের অজ্ঞাত? তিনি বলেন, না, আল্লাহর শপথ! লোকেদের নিকট যে জ্ঞান আছে তা ব্যতীত বিশেষ কোন জ্ঞান আমাদের নিকট নাই। তবে আল্লাহ যদি কাউকে কুরআন বুঝবার জ্ঞান দান করেন এবং এই সহীফার মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দিয়াত ইত্যাদি প্রসঙ্গে যা আছে (তাহলে স্বতন্ত্র কথা)। এই সহীফার মধ্যে আরো আছেঃ কোন কাফেরকে হত্যার অপরাধে কোন মুসলমানকে হত্যা করা যাবে না।
সহীহুল বুখারী ১১১, ১৮৭০, ৩০৪৭, ৩০৩৪, ৩১৭২, ৩১৮০, ৬৭৫৫, ৬৯০৩, ৬৯১৫, ৭৩০০, মুসলিম ১৩৭০, তিরমিযী ১৪১২, ২১২৭, নাসায়ী ৪৭৩৪, ৪৭৩৫, ৪৭৪৪, ৪৭৪৫, ৪৭৪৬, ৪৫৩০, আহমাদ ৬০০, ৬১৬, ৪৮৪, ৯৬২, ৯৯৪, ১০৪০, দারেমী ২৩৫৬, ইরওয়া ২২০৯। তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩৪/ রক্তমূল্য
পরিচ্ছেদঃ ১১. কাফির হত্যার দায়ে মুসলিমকে হত্যা করা হবে কি না?
৪৫৩০। কাইস ইবনু আব্বাদ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি ও আল-আশতার আলী (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে বলি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আপনাকে বিশেষ কোনো উপদেশ দিয়েছেন যা সাধারণভাবে মানুষকে দেননি? তিনি বললেন, না; তবে শুধু এতটুকু যা আমার এ চিঠিতে আছে। অতঃপর তিনি তার তরবারির খাপ থেকে একখানা পত্র বের করলেন। তাতে লেখা ছিলোঃ সকল মুসলিমের জীবন সমমানের। অন্যদের বিরুদ্ধে তারা একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি।
তাদের একজন সাধারণ ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তাই সকলের জন্য পালনীয়। সাবধান! কোনো মু‘মিনকে কোনো কাফির হত্যার অপরাধে হত্যা করা যাবে না। চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিককেও চুক্তি বলবৎ থাকাকালে হত্যা করা যাবে না। কেউ বিদ‘আত চালু করলে তার দায় তার উপর বর্তাবে। কোনো ব্যক্তি বিদ‘আত চালু করলে বা বিদ‘আতিকে মুক্তি দিলে তার উপর আল্লাহর অভিশাপ এবং ফিরিশতা ও মানবকূলের অভিশাপ।(1)
সহীহ।
(1). নাসায়ী, আহমাদ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ কায়স ইবনু ‘উবাদ (রহঃ)

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩৪/ রক্তমূল্য
পরিচ্ছেদঃ ১১. কাফির হত্যার দায়ে মুসলিমকে হত্যা করা হবে কি না?
৪৫৩১। আমর ইবনু শু‘আইব (রহঃ) থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অতঃপর আলী (রাঃ) বর্ণিত হাদীদের অনুরূপ। তবে এতে রয়েছেঃ তাদের দূরবর্তীরাও তাদের পক্ষে নিরাপত্তা দিতে পারবে, উত্তম ও দুর্বল পশুর মালিকরা এবং পিছনে অবস্থানরত ও সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ সৈন্যগণও গানীমাতে সমান অংশ লাভ করবে।(1)
হাসান সহীহ।
(1). এটি গত হয়েছে হা/ ২৭৫১।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
বর্ণনাকারীঃ আমর ইবনু শু‘আয়ব (রহঃ)

এই বিষয়ে ফতোয়া বিষয়ক প্রখ্যাত ওয়েবসাইট ইসলাম ওয়েব থেকে একটি ফতোয়া দেখে নিই [5]

All perfect praise be to Allaah, The Lord of the Worlds. I testify that there is none worthy of worship except Allaah, and that Muhammad is His slave and Messenger. We ask Allaah to exalt his mention as well as that of his family and all his companions.
First of all, you should know that a Muslim should not be killed for killing a belligerent non-Muslim according to the consensus of the scholars may Allaah have mercy upon them. According to the view of the majority of the scholars may Allaah have mercy upon them a Muslim should not be killed against a free non-Muslim under the Muslim rule. The evidence about this is the saying of the Prophet sallallaahu `alayhi wa sallam ( may Allaah exalt his mention ): “A Muslim should not be killed for killing a non-Muslim.” (At-Tirmithi)
Moreover, according to the view of the majority of the scholars may Allaah have mercy upon them the title (and rulings) “disbeliever” is applicable to a free non-Muslim under the Muslim rule. However, Abu Haneefah, and the scholars of his School of jurisprudence may Allaah have mercy upon them are of the view that a Muslim should be killed for killing a free non-Muslim under Muslim rule; their evidence is the two verses which the questioner mentioned. Nonetheless, the correct opinion is that of the majority of the scholars may Allaah have mercy upon them that is based on the above Prophetic narration, which is a direct proof related to the case of dispute.
Allaah Knows best.

এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানা যায় দরসে তাওহীদ ও কিতাল (চতুর্থ দরস) যে সকল কারণে কারো রক্তপাত হালাল হয়ে যায় গ্রন্থ থেকে [6]

কাফের
কাফের 1

এবারে আসুন ফিকহে ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু গ্রন্থ থেকে এই বিষয়ে ওসমানের শাসনামলের একটি ঘটনা জেনে নিই [7]

কাফের 3
কাফের 5
কাফের 7

তথ্যসূত্র

  1. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিসঃ ৬৯১৫ []
  2. সুনানে ইবনে মাজাহ, তাওহীদ পাবলিকেশন‏, হাদিসঃ ২৬৫৮ []
  3. সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিসঃ ৪৫৩০ []
  4. সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিসঃ ৪৫৩১ []
  5. Killing a Muslim in punishment for killing a non-Muslim []
  6. দরসে তাওহীদ ও কিতাল (চতুর্থ দরস) যে সকল কারণে কারো রক্তপাত হালাল হয়ে যা , মূল- শাইখ মুজাহিদ হারেস বিন গাযী আন নাযারী রহ , অনুবাদ- আব্দুল্লাহ সিরাজী, আল-আবতাল মিডিয়া প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৭, ৮ []
  7. ফিকহে ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, ড মুহাম্মদ রাওয়াস কালা’জী, ভাষান্তর ও সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ খলিলুল রহমান মুমিন, আধুনিক প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ১৫২, ১৫৩, ১৫৪ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"