02.কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (CMB)- বিগ ব্যাং তত্ত্বের বাস্তব প্রমাণ

ভূমিকা

মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে মানুষের জিজ্ঞাসা বহু শতাব্দী পুরনো। আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা ও পদার্থবিজ্ঞানের উন্নয়নের মাধ্যমে মহাজাগতিক ক্ষুদ্রতরঙ্গ বিকিরণ বা কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (CMB) আবিষ্কার হয়, যা বিগ ব্যাং তত্ত্বের (Big Bang Theory) অন্যতম শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে পরিগণিত হয়। এই প্রবন্ধে আমরা CMB-এর সংজ্ঞা, ইতিহাস, বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব এবং এর মাধ্যমে বিগ ব্যাং তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণের আলোচনা করবো।


1.কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

1.1 কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন কী?

কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (Cosmic Microwave Background Radiation বা CMB) হলো এমন একটি বিকিরণ যা মহাবিশ্বের আদিম অবস্থার সাক্ষ্য বহন করে। এটি সমগ্র মহাবিশ্ব জুড়ে একটি অভিন্ন মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ হিসেবে ছড়িয়ে আছে। বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রায় ৩,৮০,০০০ বছর পর, যখন মহাবিশ্বের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল, তখন এই বিকিরণ প্রথম আবির্ভূত হয়। সেই সময়, নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন একত্রিত হয়ে হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি করতে শুরু করে, ফলে বিকিরণটি পদার্থের সাথে মুক্তভাবে মিথস্ক্রিয়া করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং মহাবিশ্বের মধ্য দিয়ে স্বাধীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে। CMB-এর এই পর্যবেক্ষণ বিগ ব্যাং তত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। [1]

1.2 CMB-এর তাপমাত্রা ও বিকিরণ শক্তির বর্ণনা

CMB-এর বর্তমান গড় তাপমাত্রা প্রায় ২.৭২৫ কেলভিন (K), যা মহাবিশ্বের ক্রমাগত সম্প্রসারণের ফলে কমে গিয়েছে। এটি মূলত একটি ব্ল্যাকবডি স্পেকট্রাম বা কালো বস্তুর বর্ণালী আকারে বিদ্যমান, যা প্রমাণ করে যে এটি কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা সময়ে নয় বরং সমগ্র মহাবিশ্ব জুড়ে উপস্থিত। CMB-এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং এর শুরুর অবস্থার ওপর গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পান।


2. বিগ ব্যাং তত্ত্ব ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি

2.1 বিগ ব্যাং তত্ত্বের মূল ধারণা

বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুসারে, প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পূর্বে মহাবিশ্ব একটি অতি ঘন এবং অতি উত্তপ্ত বিন্দু থেকে উৎপন্ন হয়েছিল। এই তত্ত্বে বলা হয় যে, প্রাথমিক বিস্ফোরণের পর মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হতে থাকে এবং এই প্রসারণের ফলেই মহাবিশ্বের বিভিন্ন উপাদান, যেমন গ্যালাক্সি, নক্ষত্র এবং গ্রহ গঠন হতে শুরু করে।

2.2 বিগ ব্যাং তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক প্রমাণসমূহ

বিগ ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • গ্যালাক্সির লাল সরণ (Redshift): গ্যালাক্সিরা একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, যা প্রমাণ করে মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে।
  • হাবলের আইন (Hubble’s Law): গ্যালাক্সির দূরত্বের সাথে তাদের সরে যাওয়ার গতির একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে, যা মহাবিশ্বের বিস্তারের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত।
  • কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন: CMB মহাবিশ্বের প্রথম দিকের অবস্থার একটি ছবি, যা প্রমাণ করে যে মহাবিশ্ব একসময় উষ্ণ ও ঘন ছিল।

3. CMB আবিষ্কারের ইতিহাস ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা

3.1 আরনো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসনের গবেষণা

১৯৬৫ সালে আরনো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন নিউ জার্সির বেল ল্যাবস (Bell Labs) থেকে একটি বিশেষ ধরনের মাইক্রোওয়েভ অ্যান্টেনার মাধ্যমে এক অদ্ভুত মাইক্রোওয়েভ সংকেত সনাক্ত করেন। প্রাথমিকভাবে তাঁরা এটিকে যন্ত্রের ত্রুটি হিসেবে মনে করলেও পরে আবিষ্কৃত হয় যে এটি প্রকৃতপক্ষে মহাজাগতিক ক্ষুদ্রতরঙ্গ বিকিরণ বা CMB। তাঁদের এই আবিষ্কার বিগ ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে একটি শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

3.2 নোবেল পুরস্কার ও বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

CMB আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৮ সালে আরনো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। বিজ্ঞানী সম্প্রদায় এই আবিষ্কারকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে, কারণ এটি বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রতি বৈজ্ঞানিক সমর্থন যোগায়।


4. CMB ও মহাবিশ্বের আদিম অবস্থার প্রমাণ

4.1 আদিম বিকিরণ ও মহাবিশ্বের শুরুর দশা

CMB-এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের আদিম অবস্থার একটি সুনির্দিষ্ট ছবি পেতে সক্ষম হন। এটি প্রমাণ করে যে প্রাথমিক অবস্থায় মহাবিশ্ব ছিল এক অত্যন্ত উষ্ণ এবং সমতল একটি অবস্থায়, যেখানে কোনো ধরনের গ্যালাক্সি, নক্ষত্র বা গ্রহ ছিল না।

4.2 CMB থেকে প্রাপ্ত মহাবিশ্বের বয়স ও গঠন

CMB-এর বিশ্লেষণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সাথে, এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের গঠন, যেমন ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির পরিমাণ এবং মহাবিশ্বের ঘনত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।


উপসংহার

কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা CMB মহাবিশ্বের শুরুর অবস্থা এবং বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রতি এক অসামান্য প্রমাণ হিসেবে পরিগণিত হয়। আধুনিক গবেষণা এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে CMB পর্যবেক্ষণের সঠিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিজ্ঞানীরা এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের গঠন, উন্নয়ন এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে আরও গভীরতর ধারণা পাচ্ছেন। ভবিষ্যতে CMB-এর উপর আরও গবেষণা মহাবিশ্বের অসীম রহস্য উদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তথ্যসূত্র

  1. Penzias, A. A., & Wilson, R. W. (1965). A Measurement of Excess Antenna Temperature at 4080 Mc/s. The Astrophysical Journal, 142, 419-421. []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"