ভূমিকা
ইসলামি বিশ্বাস এবং আধুনিক বিজ্ঞান অসংখ্য বিষয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো, ধর্মীয় বিশ্বাস বনাম বিজ্ঞানভিত্তিক বিবর্তন তত্ত্ব। ইসলামী শিক্ষা সাধারণত ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে অস্বীকার করে, যেখানে বলা হয় যে সমস্ত প্রাণী ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে একটি অন্যরূপে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে, একটি অন্তর্নিহিত বৈপরীত্যের বিষয় লক্ষ্য করা যায়, যখন কোরআনে উল্লেখিত আয়াতের ভিত্তিতে বোঝা যায়, ইসলাম এমন এক ধরনের “উল্টো বিবর্তন”কে সমর্থন করে যা আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবোধের সাথে একদমই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোরআনে বর্ণিত আছে, আল্লাহর অভিশাপের ফলে কিছু মানুষকে বানর ও শুকরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ইসলামী মতাদর্শে বিজ্ঞানভিত্তিক বিবর্তনকে অস্বীকার করা হলেও, একধরনের উল্টো বিবর্তন বা রূপান্তর বা পরিবর্তনমূলক ধারণার বাস্তবতায় বিশ্বাস করা হয়।
বিবর্তন তত্ত্ব এবং ইসলামী শিক্ষা
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রাণীজগতের বিবর্তন ঘটে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে, যেখানে প্রকৃতির নির্বাচন এবং প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে প্রাণীদের মধ্যে জেনেটিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়। এর মাধ্যমে প্রাণীদের নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে এবং একটি প্রজাতি ধীরে ধীরে অন্য প্রজাতির রূপ ধারণ করে। এই তত্ত্বে মানুষের উৎপত্তিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা ইসলামী ধর্মবিশ্বাসে সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলামি বিশ্বাসমতে, আল্লাহ সরাসরি আদম এবং হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন, এবং সমগ্র মানবজাতি তাদের সন্তান।
তবে, ইসলামের বিবর্তন তত্ত্ব অস্বীকারের পেছনে মূল যুক্তি হলো, মানুষের কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভব নয়, বরং এটি সরাসরি স্রষ্টার ইচ্ছার ফসল। কিন্তু কোরআনে কিছু ঘটনায় দেখা যায়, আল্লাহর অভিশাপের কারণে মানুষ বানর এবং শুকরে পরিণত হয়েছে, যা একটি ধরণের তাত্ক্ষণিক রূপান্তরের ইঙ্গিত দেয়। এখানে প্রশ্ন ওঠে, এই ঘটনাগুলো কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য, নাকি কেবল ধর্মীয় শাস্তির প্রতীকী বর্ণনা? যদি এসব ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবে তা বিবর্তনের একটি রূপকে মান্যতা দেয়, যদিও তা প্রচলিত বিজ্ঞানভিত্তিক বিবর্তনের সম্পূর্ণ বিপরীত।
কোরআনের উল্টো বিবর্তন তত্ত্ব: বিশ্লেষণ
কোরআনের বিভিন্ন সূরায় উল্লেখ রয়েছে যে, কিছু মানুষ তাদের পাপাচার বা আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতার কারণে অভিশপ্ত হয়ে বানর ও শুকরে পরিণত হয়েছে। এই গল্পগুলো ধর্মীয় শাস্তির বর্ণনা হিসেবে উপস্থাপিত হয় এবং ইসলামী আকীদার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এক্ষেত্রে, ইসলামী শাস্ত্রাবলীর দৃষ্টিতে এটি একটি তাত্ক্ষণিক রূপান্তর বা “বিবর্তন” হিসেবে দেখা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সূরা আল-বাকারা ও সূরা আল-মায়েদায় উল্লেখ রয়েছে যে, কিছু লোকের পাপের জন্য আল্লাহ তাদের বানর ও শুকরে পরিণত করেছেন [1] [2] [3] –
তোমাদের মধ্যে যারা শনিবার সম্পর্কে সীমালঙ্ঘন করেছিল, তাদেরকে তোমরা অবশ্যই জান, আমি তাদেরকে বলেছিলাম, ‘তোমরা ঘৃণিত বানরে পরিণত হও’।
— Taisirul Quran
এবং অবশ্যই তোমরা অবগত আছ যে, তোমাদের মধ্যে যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমা লংঘন করেছিল। আমি তাদেরকে বলেছিলাম যে, তোমরা অধম বানর হয়ে যাও।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর তোমাদের মধ্যে যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল, তাদেরকে অবশ্যই তোমরা জান। অতঃপর আমি তাদেরকে বললাম, ‘তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’।
— Rawai Al-bayan
আর তোমাদের মধ্যে যারা শনিবার সম্পর্কে সীমালঙ্ঘন করেছিলো তাদেরকে তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনেছিলে [১]। ফলে আমরা তদেরকে বলেছিলাম, ‘তোমরা ঘৃণিত বানরে পরিণত হও’।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
যখন তারা চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে ঐ কাজগুলো করতে থাকল যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল, তখন তাদের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘ঘৃণিত অপমানিত, বানরে রূপান্তরিত হয়ে যাও’।
— Taisirul Quran
অতঃপর যখন তারা বেপরোয়াভাবে নিষিদ্ধ কাজগুলি করতে থাকল তখন আমি বললামঃ তোমরা ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও।
— Sheikh Mujibur Rahman
অতঃপর যা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল তারা যখন সে বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করল, তখন আমি তাদেরকে বললাম, ‘তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’।
— Rawai Al-bayan
অতঃপর তারা যখন নিষিদ্ধ কাজ বাড়াবাড়ির সাথে করতে লাগল তখন আমরা তাদেরকে বললাম, ‘ঘৃণিত বানর হও!’
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
বল, আমি তোমাদেরকে কি এর চেয়ে খারাপ কিছুর সংবাদ দেব যা আল্লাহর নিকট প্রতিদান হিসেবে আছে? (আর তা হল) যাকে আল্লাহ লা‘নাত করেছেন, যার উপর তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন, যাদের কতককে তিনি বানর ও শুকরে পরিণত করেছেন আর যারা তাগুতের ‘ইবাদাত করেছে তারাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানের লোক এবং সরল সত্য পথ হতে সবচেয়ে বিচ্যুত।
— Taisirul Quran
তুমি বলে দাওঃ আমি কি তোমাদেরকে এরূপ পন্থা হিসাবে ওটা হতেও (যাকে তোমরা মন্দ বলে জান) এরূপ সংবাদ দিব যা আল্লাহর কাছে অধিক নিকৃষ্ট? ওটা ঐ সব লোকের পন্থা, যাদেরকে আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন এবং যাদের প্রতি গযব নাযিল করেছেন ও যাদেরকে বানর ও শুকরে রূপান্তরিত করেছেন এবং যারা তাগুতের ইবাদাত করছে তারা মর্যাদার দিক দিয়ে নিকৃষ্টতর এবং সরল পথ হতে সর্বাধিক বিচ্যুত ।
— Sheikh Mujibur Rahman
বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে আল্লাহর নিকট পরিণতির বিচারে এর চেয়ে মন্দ কিছুর সংবাদ দেব? যাকে আল্লাহ লা‘নত দিয়েছেন এবং যার উপর তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন? আর যাদের মধ্য থেকে বাঁদর ও শূকর বানিয়েছেন এবং তারা তাগূতের উপাসনা করেছে। তারাই অবস্থানে মন্দ এবং সোজা পথ থেকে সর্বাধিক বিচ্যুত’।
— Rawai Al-bayan
বলুন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়ে নিকৃষ্ট পরিণামের সংবাদ দেব যা আল্লাহর কাছে আছে? যাকে আল্লাহ লা’নত করেছেন এবং যার উপর তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন। আর যাদের কাউকে তিনি বানর ও কাউকে শূকর করেছেন [১] এবং (তাদের কেউ) তাগূতের ইবাদাত করেছে। তারাই অবস্থানের দিক থেকে নিকৃষ্ট এবং সরল পথ থেকে সবচেয়ে বেশি বিচ্যুত’।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
সারা পৃথিবীর অসংখ্য রূপকথার গল্পেই এরকম উদ্ভট গল্প রয়েছে, পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মীয় গ্রন্থেই এরকম হাস্যকর শিশুতোষ কাহিনীর বিবরণ আছে। ইসলামও এসব রূপকথার বাইরে নেই। ইসলামি ধর্মীয় বিশ্বাস যেখানে ধীরগতির প্রাকৃতিক বিবর্তন তত্ত্বকে অস্বীকার করে, সেখানে তাত্ক্ষণিক এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতিতে রূপান্তরের ধারণা সমর্থন করা কিভাবে যুক্তিযুক্ত হতে পারে? আল্লাহর কুদরতে হুট করে একজন মানুষ বানর বা শুকরে পরিণত হতে পারে, এরকম হাস্যকর গল্প শিনলে আজকাল শিশুরাও হয়তো হাসাহাসি করবে।
উপসংহার
ইসলামি বিশ্বাস ও বিবর্তন তত্ত্বের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব এবং পরস্পরবিরোধী অবস্থান গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। একদিকে, বিজ্ঞানভিত্তিক বিবর্তন তত্ত্বকে সরাসরি অস্বীকার করে ইসলামী মতবাদ সৃষ্টিতত্ত্বকে সমর্থন করে। অন্যদিকে, কোরআনে বর্ণিত কিছু ঘটনায় এমন রূপান্তরের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা একই সাথে বিবর্তন এবং তাত্ক্ষণিক রূপান্তরের ধারণাকে সমর্থন করে। ফলে, এই দ্বৈত অবস্থান একদিকে ধর্মীয় শাস্ত্রের হাস্যকর দিকগুলো প্রকাশ করে ফেলে, একইসাথে কোরআনের যৌক্তিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বর্তমান সভ্য সমাজে এখনো কিছু মানুষ এই ধরণের পৌরাণিক রূপকথায় কীভাবে বিশ্বাস করে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে।
তথ্যসূত্র
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"