ইসলামি বিশ্বাস হচ্ছে, মৃত মানুষরা কানে শুনতে পায়, যা শুধু উদ্ভটই নয়, হাস্যকরও বটে।
সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২০/ জানাযা
পরিচ্ছেদঃ ৮৫০. মৃত ব্যক্তি (দাফনকারীদের) জুতার শব্দ শুনতে পায়।
১২৫৭। আয়্যাশ ও খলীফা (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বান্দাকে যখন তার কবরে রাখা হয় এবং তাকে পিছনে রেখে তার সাথীরা চলে যায় (এতটুকু দূরে যে,) তখনও সে তাদের জুতার শব্দ শুনতে পায়, এমন সময় তার কাছে দু’জন ফিরিশতা এস তাকে বসিয়ে দেন। এরপর তাঁরা প্রশ্ন করেন, এই যে মুহাম্মদ তাঁর সম্পর্কে তুমি কি বলতে? তখন সে বলবে, আমি তো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল)। তখন তাঁকে বলা হবে, জাহান্নামে তোমার অবস্থানের জায়গাটি দেখে নাও, যার পরিবর্তে আল্লাহ পাক তোমার জন্য জান্নাতে একটি স্থান নির্ধারিত করেছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তখন সে দু’টি স্থান একই সময় দেখতে পাবে। আর যারা কাফির বা মুনাফিক, তারা বলবে, আমি জানিনা। (তবে) অন্য লোকেরা যা বলতো আমিও তাই বলতাম। তখন তাকে বলা হবে, না তুমি নিজে জেনেছ, না তিলাওয়াত করে শিখেছ। এরপর তার দু’ কানের মধ্যবর্তী স্থানে লোহার মুগুর দিয়ে এমন জোরে আঘাত করা হবে, এতে সে চিৎকার করে উঠবে, মানুষ ও জ্বীন ব্যতীত তার আশেপাশের সকলেই তা শুনতে পাবে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
শ্রবণ প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
শ্রবণ, বা শোনা, মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়গত ক্রিয়া যা তাকে চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে এবং যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। শোনার প্রক্রিয়া একটি জটিল এবং অত্যন্ত সমন্বিত শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যার জন্য একটি কার্যকর মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়। এর মাধ্যমে মানুষের কান এবং মস্তিষ্কের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মানুষকে সোনার অনুভূতি প্রদান করে। শ্রবণ প্রক্রিয়াটি মূলত ধ্বনিতরঙ্গের মাধ্যমে শুরু হয়, যা কানের বিভিন্ন অংশের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় এবং ব্যাখ্যা করা হয়।
কানের গঠন
মানুষের কান তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত: বাইরের কান, মধ্য কান এবং ভেতরের কান। প্রতিটি অংশের নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে শ্রবণ প্রক্রিয়ায়।
- বাইরের কান (Outer Ear): বাইরের কানের মধ্যে থাকে পিনা এবং কানছিদ্র। পিনা বা কানের বাইরের অংশের কাজ হলো ধ্বনিতরঙ্গ সংগ্রহ করা এবং তা কানছিদ্রের (Ear Canal) মাধ্যমে কানের ভেতরের দিকে পাঠানো। এই ধ্বনিতরঙ্গগুলি হল মূলত বায়ুতে কম্পনের ফলে সৃষ্ট তরঙ্গ, যা কানের ছিদ্র দিয়ে কানের ভেতরে প্রবেশ করে।
- মধ্য কান (Middle Ear): মধ্য কানে কানপর্দা (Eardrum) এবং তিনটি ছোট হাড় থাকে, যেগুলোকে বলা হয় ম্যালিয়াস (Malleus), ইনকাস (Incus), এবং স্ট্যাপিস (Stapes)। ধ্বনিতরঙ্গ কানছিদ্রের মাধ্যমে কানের ভেতরে পৌঁছানোর পর কানপর্দায় আঘাত করে এবং তা কম্পিত হয়। এই কম্পন মধ্য কানের তিনটি ছোট হাড়ের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয় এবং তা ভেতরের কানে পৌঁছায়। এই তিনটি হাড় একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে কম্পনকে বাড়িয়ে তোলে এবং তা ভেতরের কানের তরল পদার্থে প্রেরণ করে।
- ভেতরের কান (Inner Ear): ভেতরের কান হলো শ্রবণ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে রয়েছে ককলিয়া (Cochlea) নামক একটি সর্পিল আকৃতির তরলপূর্ণ অঙ্গ। ককলিয়ার ভেতরে অসংখ্য সংবেদনশীল কোষ (Sensory Cells) বা চুলের কোষ থাকে, যাদের বলা হয় হেয়ার সেলস। মধ্য কানের হাড়ের মাধ্যমে কম্পন যখন ভেতরের ককলিয়ায় পৌঁছায়, তখন এই তরল পদার্থ কম্পিত হয় এবং ককলিয়ার চুলের কোষগুলো এই কম্পনকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত করে।
শ্রবণ সংকেতের মস্তিষ্কে প্রেরণ
ককলিয়া থেকে বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি হওয়ার পর, এই সংকেতগুলো শ্রবণ স্নায়ু (Auditory Nerve) এর মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রেরিত হয়। মস্তিষ্কের শ্রবণ কেন্দ্র হলো অডিটরি কর্টেক্স (Auditory Cortex), যা এই সংকেতগুলোকে প্রক্রিয়াকরণ করে। এখানে সংকেতগুলো ধ্বনিতে পরিণত হয় এবং আমরা শব্দ হিসেবে তা শুনতে পাই। এটি একটি অত্যন্ত দ্রুত প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিটি অংশ তার নিজ নিজ কাজ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করে, ফলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে শব্দ শুনতে সক্ষম হই।
বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতার ধ্বনি
মানুষের কান বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির (Frequency) এবং তীব্রতার (Intensity) ধ্বনি শোনার ক্ষমতা রাখে। সাধারণভাবে, মানুষ ২০ হার্জ (Hz) থেকে ২০,০০০ হার্জ পর্যন্ত ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ শুনতে সক্ষম। তবে, বয়স এবং শারীরিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা পরিবর্তিত হতে পারে। উচ্চতর ফ্রিকোয়েন্সির ধ্বনি শোনার ক্ষমতা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যেতে পারে।
ককলিয়ার ভেতরের চুলের কোষগুলো বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ শনাক্ত করতে বিশেষভাবে কাজ করে। উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ ককলিয়ার নিচের অংশে প্রভাব ফেলে, আর নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ প্রভাব ফেলে ককলিয়ার উপরের অংশে। এইভাবে ককলিয়া বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির কম্পনকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত করে এবং তা মস্তিষ্কে পাঠায়।
শব্দ শনাক্তকরণ এবং ব্যাখ্যা
শ্রবণ শুধু ধ্বনিতরঙ্গ শোনা নয়, বরং মস্তিষ্কে সেই ধ্বনির ব্যাখ্যা করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মস্তিষ্কের শ্রবণ কেন্দ্রগুলো শব্দ শনাক্ত করে এবং তা ব্যাখ্যা করে, যার মাধ্যমে আমরা ধ্বনি, ভাষা এবং অন্যান্য শব্দকে বুঝতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, যখন কেউ কথা বলে, তখন তার মুখ থেকে নির্গত শব্দ তরঙ্গ আমাদের কানে পৌঁছায় এবং মস্তিষ্ক সেই শব্দগুলোকে ভাষা হিসেবে শনাক্ত করে এবং ব্যাখ্যা করে। এভাবে আমরা কথা শুনে বুঝতে পারি এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি।
শ্রবণ প্রক্রিয়ার সমস্যা
শ্রবণ প্রক্রিয়ায় কোনো অংশে সমস্যা দেখা দিলে তা শ্রবণশক্তি হ্রাস বা সম্পূর্ণ শ্রবণহীনতার কারণ হতে পারে। মধ্য কানের হাড় বা ককলিয়ার চুলের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ধ্বনিতরঙ্গের বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর বাধাপ্রাপ্ত হয়, ফলে শ্রবণক্ষমতা কমে যায়। এছাড়াও, দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ তীব্রতার শব্দের প্রভাবও চুলের কোষের ক্ষতি করতে পারে, যা শ্রবণশক্তি হ্রাসের একটি সাধারণ কারণ।
উপসংহার
মানুষ কীভাবে শুনতে পায় তা একটি জটিল, কিন্তু চমকপ্রদ প্রক্রিয়া। বাইরের ধ্বনিতরঙ্গ কানপর্দার মাধ্যমে ককলিয়ায় পৌঁছে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত হয় এবং মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াকৃত হয়ে শব্দে রূপান্তরিত হয়। শ্রবণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, যা যোগাযোগ এবং পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে এই পুরো প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে, তাই মৃত মানুষের শোনার কোন শক্তি অবশিষ্ট থাকে না।