ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, মানুষের শরীরে একটি হাড় কখনোই ক্ষয় হয় না বা পচন ধরে না, যা কিয়ামতের দিন মানুষের পুনরুত্থানের জন্য ব্যবহার করা হবে। এই ধারণাটি শুধু অবৈজ্ঞানিকই নয়, বরং এটি যুক্তি এবং বাস্তবতার সাথে পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মীয় হাদিসে বর্ণিত আছে যে, মানুষের মেরুদণ্ডের একটি হাড় কখনোই মাটির সাথে মিশে যায় না এবং এটি মানুষের পুনর্জন্মের ভিত্তি হিসেবে থাকবে। বাস্তবে, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অগণিত মানুষ মারা গিয়েছে এবং তাদের দেহাবশেষ মাটিতে মিশে গিয়ে সম্পূর্ণরূপে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। যদি সত্যিই কোনো হাড় মাটিতে অবিকৃত থাকত, তাহলে প্রতিটি প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সেই হাড়ের প্রমাণ পাওয়া যেত। তবে, বিজ্ঞানীরা বা প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কখনোই এরকম কোনো “অক্ষত হাড়” পাননি, যা প্রমাণ করে যে এই ধারণাটি বাস্তবতার সাথে পুরোপুরি অমিল।
মানুষের শরীরের প্রতিটি অংশ, বিশেষ করে হাড়, একটি নির্দিষ্ট সময় পর মাটির সাথে মিশে যায় এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। মানুষের হাড়ের প্রধান উপাদান হলো ক্যালসিয়াম ফসফেট এবং প্রোটিন কোলাজেন। যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায়, তার দেহে থাকা জীবাণু, এনজাইম এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান দেহের কোষগুলোকে ভেঙে ফেলে, যা হাড়সহ সমস্ত দেহের অংশকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় [1]। এই প্রক্রিয়া কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে, মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের ওপর নির্ভর করে। কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে, যেমন অত্যন্ত শুষ্ক পরিবেশ বা খুব ঠান্ডা আবহাওয়ায়, হাড় কিছুটা সময় ধরে অবিকৃত থাকতে পারে, কিন্তু তা স্থায়ীভাবে অবক্ষয় থেকে রক্ষা পায় না। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে এই ধরনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় হাড়ের অবক্ষয় ঘটে এবং কয়েক দশক পর সেগুলি সম্পূর্ণরূপে মাটিতে মিশে যায়।
ধর্মীয়ভাবে “অক্ষত হাড়” এর এই ধারণা কেবল একটি মিথ্যা প্রচারণা নয়, এটি মানুষের বিশ্বাস এবং বৈজ্ঞানিক সত্যের মধ্যে একটি বিরাট বিভেদ তৈরি করে। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রতিটি জীবের মৃত্যুর পর তার দেহের প্রতিটি অংশই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রাপ্ত হাড়ের অবশিষ্টাংশগুলো অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং প্রায়ই ভাঙাচোরা অবস্থায় পাওয়া যায়। লক্ষ লক্ষ বছর আগের মানুষের দেহাবশেষ শুধুমাত্র পাথরীভূত অবস্থায় বা জীবাশ্ম আকারে সংরক্ষিত থাকে, যা একটি অত্যন্ত বিরল প্রক্রিয়া এবং এই অবস্থায়ও হাড়ের গঠন পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে, যদি কোনো একটি “অক্ষত হাড়” সত্যিই থাকত, তাহলে আজকের প্রত্নতাত্ত্বিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তা শনাক্ত করতে পারতেন এবং এর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারতেন।
এই ধরনের কুসংস্কার শুধু মানুষের যৌক্তিক চিন্তাশক্তিকে বাধাগ্রস্ত করে না, বরং এটি মানুষের স্বাভাবিক আচরণ ও বিশ্বাসকে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। মানুষ যখন বাস্তবতা এবং বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করে অন্ধবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে, তখন তাদের মধ্যে অযৌক্তিক চিন্তাভাবনার জন্ম হয় এবং তারা প্রমাণসাপেক্ষ বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যায়। এই ধরনের বিশ্বাস মানুষের মনকে দূষিত করে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং সত্যের প্রচারে বাধা সৃষ্টি করে। অক্ষত হাড়ের এই ধর্মীয় তত্ত্ব জনসাধারণকে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা থেকে দূরে রাখে এবং এর ফলে সমাজে শিক্ষার অভাব এবং কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় [2] [3] [4] –
সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী)
অধ্যায়ঃ ৫৪। বিভিন্ন ফিতনাহ ও কিয়ামাতের লক্ষনসমূহ
২৮. উভয় ফুঁৎকারের মধ্যে ব্যবধান
৭৩০৬-(১৪৩/…) মুহাম্মাদ ইবনু রাফি (রহঃ) ….. আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কতিপয় হাদীস উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে একটি হাদীস হচ্ছে এই যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষের শরীরে এমন একটি হাড় আছে, যা জমিন কখনো ভক্ষণ করবে না। কিয়ামাতের দিন এর দ্বারাই পুনরায় মানুষ সৃষ্টি করা হবে। সহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! এ আবার কোন হাড্ডি? তিনি বললেন, এ হলো, মেরুদণ্ডের হাড্ডি। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭১৪৮, ইসলামিক সেন্টার ৭২০০)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
তথ্যসূত্র
- Forensic Archaeology: Advances in Theory and Practice”, M. Cox & J. Hunter, 2005 [↑]
- সহীহ মুসলিম, হাঃ একাডেমী, হাদিসঃ ৭৩০৬ [↑]
- সহিহ মুসলিম শরীফ (প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ বঙ্গানুবাদ), মাকতাবাতুল হাদীছ প্রকাশনী, ২১ ও ২২ তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৫২ [↑]
- তাফসীরে মাযহারী, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৪৭২ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"