রোকেয়া সমালোচনা

Print Friendly, PDF & Email

বেগম রোকেয়ার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং ভক্তি কতটা, সেটা আমার লেখার নিয়মিত পাঠক মাত্রই জেনে থাকবেন। আমি একটা কভার ব্যানার বানিয়েছিলাম, সেখানেও রোকেয়াই ছিল একমাত্র নারী এবং কভার ফটোটির মধ্যমনি। বেগম রোকেয়া নিঃসন্দেহে বাঙলার শ্রেষ্ট নারীবাদী, এবং আজকের তসলিমার চাইতে তিনি সেই সময়ই কয়েকযুগ এগিয়ে ছিলেন। তার সময়ে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল দুজনেই জীবিত, অথচ তারা রোকেয়াকে রীতিমত অবহেলাই করেছিলেন, রোকেয়া সম্পর্কে দুই লাইন লেখার মত সময় তাদের কারোরই হয় নি। কিন্তু তাদের সার্টিফিকেট না পেয়েও রোকেয়ার গুরুত্ব এতটুকু কমে নি।

রোকেয়া আসলেই একজন বিষ্ময়কর মানুষ, যার শৈশব কেটেছিল এমন একটি পরিবেশে, যেখানে নারীদের পাঁচ বছর বয়স থেকেই অপরিচিত মহিলাদের সামনেও কঠোর পর্দা করে বের হতে হয়েছে। তার পিতা চারটি বিয়ে করেছিলেন, একটি উপপত্নীও ছিল। সিপাহী বিদ্রোহের সময় একজন আইরিশ মহিলাকে বাসায় থাকতে দিয়েছিলেন তিনি, সেই ছিল তার উপপত্নী। বিয়ের সময় রোকেয়ার বয়স ছিল ১৬, তার স্বামীর ৪১; স্বামী সাখাওয়াত হোসেন বিলেত থেকে নিয়ে এসেছিলেন নতুন এক মতাদর্শ, ইউরোপে তখন নারীবাদের প্রাথমিক অবস্থা, যদিও নারীবাদ কি তা ইউরোপেও খুব বেশি স্বচ্ছ ধারণা মানুষের মাঝে ছিল না। ঠিক সেই সময় রোকেয়া যা লিখেছিলেন, তা শুধু এই অঞ্চলের জন্য অভিনব নয়, ইউরোপের জন্যেও ছিল অনেকখানি আধুনিক।

কিন্তু তিনি যতই মহৎ নারীবাদী হোন না কেন, তার বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা অবশ্যই জরুরী। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সময় এবং আরেকটি কারণ হচ্ছে রোকেয়ার কিছু লেখা একটা সময় মৌলবাদীদের অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে, এবং রোকেয়ার কিছু রচনাকে পুঁজি করে ধর্মীয় মৌলবাদীরা নারীর উপরে চাপাতে পারে তাদের ধর্ম-ধর্মগ্রন্থসমুহ, যা খুব পরিষ্কারভাবেই নারী বিরোধী। রোকেয়া কতটা শক্তিমান ছিলেন, সেটা আশা করি সকলেই জানেন। তিনি সেই আমলে বলেছিলেন,

>> আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।

>>এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহ্য করা উচিত নহে, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ় সেখানেই নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক, যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল, সেখানে রমনী প্রায় পুরুষের মতো উন্নত অবস্থায় আছেন।

>> ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর? আমেরিকায় কি তাহার রাজ্য ছিল না? ঈশ্বরদত্ত জলবায়ু তো সকল দেশেই আছে, কিন্ত তাহার দূতগন সকল দেশে ব্যপ্ত হন নাই কেন? ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ আছে, প্রেরিত নারী নাই কেন?

সেই তিনিই যখন “বোরকা” নামক একটি বিশ্রী প্রবন্ধ লিখে বোরকার পক্ষে অবস্থান নেন, সেই তিনিই যখন লেখেন,

>> “সভ্যতাই জগতে পর্দা বৃদ্ধি করিতেছে। যেমন পূর্বে লোকে চিঠিপত্র কেবল ভাঁজ করিয়া পাঠাইত, এখন সভ্য লোকে চিঠির উপর লেফাফার আবরণ দেন। চাষারা ভাতের থালা ঢাকে না, অপেক্ষাকৃত সভ্য লোকে খাদ্য সামগ্রীর তিন চারি পত্র একখানা বড় থালায় রাখিয়া উপরে একটা খানপোষ বা সরপোষ ঢাকা দেন; যারা আরও বেশি সভ্য তাহাদের খাদ্যবস্তুর প্রত্যেক পাত্রের স্বতন্ত্র আবরণ থাকে। এইরূপ আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যাইতে পারে, যেমন টেবিলের আবরণ, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়- ইত্যাদি।”

-বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়!!!

কি অবলীলায় তিনি বোরকার পক্ষে অবস্থান নিলেন! শুধু অবস্থানই নিলেন না, নারীকে ভাতের সাথে-খাদ্যবস্তুর সাথে তুলনাও করলেন। অর্থাৎ নারী একটি ভোগ্যবস্তু, যা আসলে খেতে হয়! কিন্তু একই কথা তো পুরুষের শরীরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবার কথা! পুরুষের শরীরও তো নারীর কামনার বস্তু হতে পারে!

বোরকা হিজাব ভাল নাকি মন্দ, তা নিয়ে ইতিপুর্বে দীর্ঘ আলোচনা করেছি, এখানে কেউ বোরকার উপকারীতা বা অপকারীতা নিয়ে ত্যানা প্যাচাবেন না, যাদের এই নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা তারা পুরনো পোস্ট খুঁজে বের করে সেখানে কথা বলুন, এ পোস্টের উদ্দেশ্য হচ্ছে রোকেয়ার স্ববিরোধী আচরণ, একদিকে ধর্মকে ছুড়ে ফেলে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনা হিসেবে প্রকাশ করে অন্যদিকে মধ্যযুগীয় একটি বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তিনি নিজেও নারীর শরীরকে একটি খাদ্যবস্তুই ভেবেছেন! এছাড়াও তিনি তার স্বামীর নাম নিজের নামের সাথে যুক্ত করেছেন, সারাজীবন বহন করেছেন স্বামীর নাম, নিজের স্বতন্ত্র পরিচয়ে যে একজন নারী পরিচিত হতে পারে, সেটা তার উপলব্ধী করাও উচিত ছিল। একই সাথে, শেষ বয়সে রোকেয়ার নারীবাদী লেখার সংখ্যা বেশ খানিকটা কমে গিয়েছিল, এবং তার ভেতরে ধর্মভীতি/মৃত্যুভীতি প্রবেশ করেছিল।

বোরকার পক্ষে রচনার কারণ হিসেবে শৈশবের প্রতিক্রিয়াশীল পরিবেশ এবং মেয়েদের জন্য যেই স্কুলটি করেছিলেন, সেখানে ছাত্রী সংগ্রহ আলোচিত হতে পারে। খুব সম্ভবত ছাত্রী সংগ্রহের জন্যেই তিনি বোরকার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, বোরকার বিরুদ্ধে কথা বলে সে সময়ের মেয়েদের অভিভাবককে ক্ষেপিয়ে নিজের স্কুলে মেয়েদের সংখ্যা কমাতে চান নি। তা না হলে যেই রোকেয়া ধর্মগ্রন্থগুলোকে পুরুষদের তৈরি গ্রন্থ বলে বসতে পারে, সে সচেতনভাবে বোরকার পক্ষে অবস্থান নেবেন তা মেনে নেয়া কষ্টকর। অনেক সময় অনেক সমাজ সংস্কারকেরই নানা ধরণের কৌশলে কাজ করতে হয়েছে, এটাও তার একটি কৌশল হলে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু তারপরেও কথা হচ্ছে, ঐ বিশেষ রচনাগুলো নারীকে বোরকার ভেতরে বন্দী করে রাখবার উপকরণ হয়ে উঠতে পারে। তাই এর বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা জরুরী।

তারপরেও বাঙালি নারীদের মধ্যে প্রথম সত্যিকারের নারীবাদী ছিলেন রোকেয়া। নারীবাদ বলতে যে শুধু নারীর উন্নতি বোঝানো হয় না, সেটা তিনি খুব ভালভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক মানুষ, যার বেশিরভাগ লেখাই মৌলিক এবং যৌক্তিক, একই সাথে আধুনিক। তার মত শত বিরুদ্ধতার মধ্যেও স্রোতের বিপরীতে কাজ করে যাওয়া মানুষের জন্যেই আজকে বাঙলাদেশে নারীরা ঘর থেকে বেরুতে পারছে, কাজ করতে পারছে।

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

2 thoughts on “রোকেয়া সমালোচনা

  • January 17, 2017 at 5:13 PM
    Permalink

    দারুণ লাগলো

    Reply
  • April 15, 2017 at 6:55 AM
    Permalink

    নাস্তিক চির উন্নত মম শির

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *