জারজ বলে গালি
কাউকে “জারজ” বলা একটি ভয়াবহ অন্যায় ও অসভ্য আচরণ, কারণ এটি একটি মানব সন্তানের প্রতি মানুষ হিসেবে তার সর্বোচ্চ অবমাননাকর মন্তব্য। যেকোনো মানুষের জন্ম তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না; সে কখন, কোথায়, কাদের ঘরে জন্ম নেবে, সে সম্পর্কে তার কোনো হাত নেই। পিতৃপরিচয়হীন বা জন্মের কোনো সামাজিক ও প্রথাগত নিয়মের বাইরে জন্মগ্রহণ করলেও, সেই সন্তানের প্রতি অসম্মান বা গালি দেওয়া ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এ ধরনের গালি সমাজে বৈষম্য, ঘৃণা এবং অসম্মানকে উস্কে দেয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য অবমাননকর এক মানসিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। একজন মানুষ কেবল তার কাজ, চরিত্র ও মানবিক গুণাবলির জন্য মূল্যায়িত হওয়া উচিত, জন্মসূত্রে প্রাপ্ত পরিচয়ের জন্য নয়।
একটি শিশুর জন্ম তার বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে এবং কখনো কখনো তা পরিকল্পনার বাইরেও ঘটে। শিশুর জন্মের পেছনে কোনো অবস্থাতেই তার নিজস্ব ইচ্ছা বা কর্তৃত্ব নেই। তাই তাকে তার জন্মপরিস্থিতির জন্য অপমান করা অযৌক্তিক এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এ ধরনের শব্দ ব্যবহার কেবল সেই ব্যক্তির ওপর আঘাত হানে না; বরং এটি একটি অবজ্ঞাপূর্ণ সামাজিক মনোভাবের প্রতিফলন, যা ব্যক্তির আত্মমর্যাদা এবং মানসিক সুস্থতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সন্তানকে তার বাবা-মায়ের কর্মের জন্য দায়ী করা বা তার জন্মকে উপহাসের বিষয় বানানো, তার প্রতি অন্যায় এবং অপমান।
কাউকে ‘জারজ’ বলা বিশেষভাবে অমানবিক, কারণ এটি ব্যক্তি ও তার পারিবারিক পরিচয়কে আঘাত করে এবং তাকে সমাজের চোখে হেয় করে তোলে। যে সন্তান পিতৃপরিচয়হীন বা বৈধ বিবাহের বাইরে জন্মগ্রহণ করেছে, তার প্রতি এই ধরনের আক্রমণ কোনোভাবেই তার প্রাপ্য নয়। এমন গালি প্রদান করা সামাজিক অসভ্যতা ও অন্যায়ের প্রতীক এবং এটি একজন মানুষ হিসেবে আমাদের সম্মানবোধ ও নৈতিক দায়িত্বের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। এ ধরনের শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা শুধু একজন মানুষকেই নয়, পুরো মানবতার বিরুদ্ধে অন্যায় করছি। তাই কাউকে ‘জারজ’ বলা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির সম্মানহানিই নয়, বরং এটি মানবিক মূল্যবোধের চরম লঙ্ঘন। এমন অমানবিক আচরণ পরিহার করে আমাদের উচিত মানুষকে তার জন্ম বা পারিবারিক পটভূমি নয়, বরং তার কাজ এবং মানবিক গুণাবলির ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা।
ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে বহু জায়গাতে অমুসলিমদের নানাভাবে গালাগালি করা হয়েছে। এই অংশে আমরা শুধু এই বিশেষ গালিটি নিয়েই আলোচনা করছি। কোরআনে কাফেরদের সম্পর্কে জারজ বলে একটি জায়গাতে গালি দেয়া হয়েছে। কোরআনের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য অনুবাদে এই শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে [1]
কঠোর স্বভাব, তার উপরে আবার কুখ্যাত।
Taisirul Quran
রূঢ় স্বভাব এবং তদুপরি কুখ্যাত।
Sheikh Mujibur Rahman
দুষ্ট প্রকৃতির, তারপর জারজ।
Rawai Al-bayan
রূঢ় স্বভাব (১) এবং তদুপরি কুখ্যাত (২);
Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
এই বিষয়ে তাফসীরে ইবনে কাসীরে যা বলা হয়েছে, [2]
ইকরামা (রঃ) বলেন যে, জারজ সন্তান উদ্দেশ্য। এটাও বর্ণিত আছে যে, কর্তিত কান বিশিষ্ট বকরী, যে কান তার গলদেশে ঝুলতে থাকে, এরূপ বকরীকে যেমন পালের মধ্যে সহজেই চেনা যায় ঠিক তেমনই মুমিনকে কাফির হতে সহজেই পৃথক করা যায়। এ ধরনের আরো বহু উক্তি রয়েছে। কিন্তু সবগুলোরই সারমর্ম হলো এই যে, (আরবি) হলো ঐ ব্যক্তি যে কুখ্যাত এবং যার সঠিক নসবনামা এবং প্রকৃত পিতার পরিচয় জানা যায় না। এ ধরনের লোকদের উপর শয়তান খুব বেশী জয়যুক্ত হয় এবং তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যেমন হাদীসে এসেছেঃ “জারজ সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অন্য এক হাদীসে আছেঃ জারজ সন্তান তিনজন মন্দ লোকের একজন, যদি সেও তার পিতা-মাতার মত আমল করে।”
আসুন সরাসরি এবারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তাফসীরে ইবনে কাসীর গ্রন্থ থেকে এই আয়াতটির তাফসীরের অংশ বিশেষ পড়ি, [3]
নিকৃষ্ট জীব বলে গালি
কোরআনে অমুসলিমদের নিকৃষ্টতম জীব বলে গালাগালি করা হয়েছে। সেইসাথে এই কথাও বলা হয়েছে যে, [4]
কিতাবধারীদের মধ্যে যারা কুফুরী করে তারা আর মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। এরাই সৃষ্টির অধম।
— Taisirul Quran
কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করে তারা এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে; তারাই সৃষ্টির অধম।
— Sheikh Mujibur Rahman
নিশ্চয় কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে ও মুশরিকরা, জাহান্নামের আগুনে থাকবে স্থায়ীভাবে। ওরাই হল নিকৃষ্ট সৃষ্টি।
— Rawai Al-bayan
নিশ্চয় কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরি করেছে তারা এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে; তারাই সৃষ্টির অধম [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
এবারে আসুন এই আয়াতটির তাফসীর পড়ে নিই, যেখানে পরিষ্কারভাবে বলা হচ্ছে, নবীকে নবী হিসেবে মেনে না নিলে তাড়াই ইসলামের দৃষ্টিতে সবচাইতে নিকৃষ্টতম জীব! [5] –
আহলে-কিতাব ও মুশরেকদের মধ্যে যারা কাফের, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম। [6]
কুরআন ৯৮ঃ৬
সমস্ত জীবের মাঝে আল্লাহর নিকট তারাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট, যারা অস্বীকারকারী হয়েছে অতঃপর আর ঈমান আনেনি। [7]
কোরআন ৮:৫৫
নিশ্চয় যারা কুফরী করে এবং কাফের অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে, সে সমস্ত লোকের প্রতি আল্লাহর ফেরেশতাগনের এবং সমগ্র মানুষের লা’নত। [8]
কোরআন ২-১৬১
বস্তুতঃ এহেন কাফেরদের উদাহরণ এমন, যেন কেউ এমন কোন জীবকে আহবান করছে যা কোন কিছুই শোনে না, হাঁক-ডাক আর চিৎকার ছাড়া বধির মুক, এবং অন্ধ। সুতরাং তারা কিছুই বোঝে না। [9]
কোরআন ২-২৫৭
কাফেরদিগকে বলে দিন, খুব শিগগীরই তোমরা পরাভূত হয়ে দোযখের দিকে হাঁকিয়ে নীত হবে-সেটা কতই না নিকৃষ্টতম অবস্থান। [10]
কোরআন ৩-১২
বলুন, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য প্রকাশ কর। বস্তুতঃ যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদিগকে ভালবাসেন না। [11]
কোরআন ৩-৩২
আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ। [12]
কোরআন ৭:১৭৯
অতএব যারা কাফের হয়েছে, তাদেরকে আমি কঠিন শাস্তি দেবো দুনিয়াতে এবং আখেরাতে-তাদের কোন সাহায্যকারী নেই। [13]
কোরআন ৩-৫৬
যাতে ধবংস করে দেন কোন কোন কাফেরকে অথবা লাঞ্ছিত করে দেন-যেন ওরা বঞ্চিত হয়ে ফিরে যায়। [14]
কোরআন ৩-১২৭
খুব শীঘ্রই আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করবো। কারণ, ওরা আল্লাহ্র সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করে যে সম্পর্কে কোন সনদ অবতীর্ণ করা হয়নি। আর ওদের ঠিকানা হলো দোযখের আগুন। বস্তুত: জালেমদের ঠিকানা অত্যন্ত নিকৃষ্ট। [15]
কোরআন ৩-১৫১
আসুন তা জেনে নিই সর্বাপেক্ষ গ্রহণযোগ্য তাফসীর গ্রন্থে এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যাতে কী বলা রয়েছে। আসুন পড়ি ইবনে কাসীর [16] থেকে
তথ্যসূত্র
- কোরআন ৬৮ঃ১৩ [↑]
- তাফসির ইবনে কাছের রহ, ৮-১৬ নং আয়াতের তাফসীর [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড ১১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ২২৫ [↑]
- কোরআন ৯৮ঃ৬ [↑]
- তাফসীরে জালালাইন, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩৮ [↑]
- কোরআন ৯৮:৬ [↑]
- কোরআন ৮:৫৫ [↑]
- কোরআন ২:১৬১ [↑]
- কোরআন ২:২৫৭ [↑]
- কোরআন ৩:১২ [↑]
- কোরআন ৩:৩২ [↑]
- কোরআন ৭:১৭৯ [↑]
- কোরআন ৩:৫৬ [↑]
- কোরআন ৩:১২৭ [↑]
- কোরআন ৩:১৫১ [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৮১ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"