পা শব্দটির অর্থ হচ্ছে পদ, চরণ, পায়ের পাতা, ঊরু হতে পায়ের পাতা পর্যন্ত দেহাংশ; অবলম্বন; পায়া। অর্থাৎ শরীরের যে অঙ্গটি দ্বারা প্রাণীরা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ভ্রমণ করে। ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, সর্বশক্তিমান এবং মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ পাকের পা আছে। সেই পা আল্লাহর কী কাজে লাগে, সে পা কি দিয়ে তৈরি, সেই পায়ের আকৃতি কেমন, তা নিয়ে নিশ্চয়ই আগ্রহী পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন জাগবে।
পা হলো মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে ও চলাফেরায় বিশাল ভূমিকা রাখে। পা সাধারণত শরীরের নিম্নাংশে অবস্থিত এবং এটি মানুষের ভারসাম্য রক্ষা, দেহকে স্থানে স্থানে স্থানান্তরিত করা এবং বিভিন্ন কাজ সম্পাদনে সাহায্য করে। শুধু মানুষ নয়, বিভিন্ন প্রাণীদেরও পা রয়েছে যা তাদের চলাচল এবং কাজের সুবিধার্থে বিবর্তিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা পা সম্পর্কে, এর বিবর্তন, এর গুরুত্ব, এবং বিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে পায়ের উদ্ভব নিয়ে আলোচনা করব।
পায়ের উদ্ভবের মূল সূত্র খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হয় বহু লক্ষ বছর আগে, যখন প্রথম স্থলভাগে বসবাসকারী প্রাণীরা উদ্ভূত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে, এই প্রাণীগুলোর পূর্বপুরুষ ছিল জলজ প্রাণী, যাদের পাখনা ছিল চলাচলের প্রধান মাধ্যম। যখন এই প্রাণীরা জল থেকে স্থলে ওঠা শুরু করে, তখন তাদের শরীরের নিম্নাংশের পাখনাগুলো ধীরে ধীরে শক্ত এবং স্থিতিশীল অঙ্গে পরিণত হয়, যা পরবর্তীতে পায়ের আকার ধারণ করে। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে প্রথম ভূমি প্রাণী হিসেবে যেগুলো পা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, তাদের মধ্যে টেট্রাপড (Tetrapods) উল্লেখযোগ্য। এই প্রাণীগুলির চতুর্ভুজ পা ছিল, যা তাদের ভূমিতে চলাচলে সাহায্য করত। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এই টেট্রাপডদের পা বিকশিত হয়ে আধুনিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে আরও জটিল ও শক্তিশালী অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
মানুষের পায়ের বিবর্তন এবং গঠন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানুষের পূর্বপুরুষরা প্রথমে গাছে বাস করা প্রাইমেট ছিল। তারা গাছের ডাল ধরে ঝুলে থাকত এবং লাফ দিয়ে এক ডাল থেকে অন্য ডালে যেতে পারত। কিন্তু যখন তারা স্থলভাগে জীবনযাপন শুরু করল, তখন তাদের শরীরের নিম্নাংশে বড় পরিবর্তন আসতে শুরু করল। মানবজাতির পূর্বপুরুষরা ক্রমান্বয়ে দ্বিপদী প্রাণীতে পরিণত হয়, অর্থাৎ তারা দুই পায়ে চলাচল করতে সক্ষম হয়। এটি ছিল মানবজাতির বিবর্তনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
দ্বিপদী চলাচল মানবজাতির বিকাশে বেশ কিছু সুবিধা এনে দিয়েছে। প্রথমত, দুই পায়ে চলার ফলে মানুষের হাত মুক্ত হয়ে যায়, যা হাতের সাহায্যে বিভিন্ন কাজ করা সম্ভব করেছে। দ্বিতীয়ত, মানুষের মস্তিষ্কের আকার বাড়ার কারণে মাথার ভারসাম্য রক্ষা করতে পায়ের গঠনে পরিবর্তন আসে। এর ফলে, পায়ের হাড়, পেশী, এবং জয়েন্টের গঠন এমনভাবে বিকশিত হয়, যা ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং শক্তিশালীভাবে স্থির থাকতে সাহায্য করে।
মানুষের পায়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এতে আঙুল, পায়ের তালু, গোড়ালি, এবং বিভিন্ন জয়েন্টের সমন্বয় থাকে, যা পায়ের স্থিতিশীলতা এবং কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। পায়ের আঙুলগুলো আমাদের চলার সময় ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে, এবং পায়ের তালুর গঠন আমাদের দেহের ভারকে সঠিকভাবে বিতরণ করে যাতে আমরা সহজে চলাচল করতে পারি। গোড়ালি এবং পায়ের পেশীগুলোর মধ্যে শক্তিশালী সমন্বয় রয়েছে যা আমাদের দ্রুত দৌড়াতে, লাফাতে এবং বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে সহায়ক হয়।
পায়ের ব্যবহার শুধুমাত্র চলাচলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পা অনেক ক্ষেত্রে ভার বহন, ভারসাম্য রক্ষা, এবং কাজের জন্য একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। খেলাধুলায়, যেমন ফুটবল, বাস্কেটবল বা দৌড়, পায়ের ভূমিকা অপরিসীম। এছাড়া বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজ যেমন ভারী বস্তু তোলা, পাহাড়ে চড়া, বা এমনকি দাঁড়িয়ে থাকার জন্যও পা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
পায়ের বিবর্তন শুধুমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের বিকাশ দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু প্রাণীর পা তাদের চলাচলের ধরন অনুযায়ী বিকশিত হয়েছে। যেমন, ঘোড়া এবং হরিণের পা দ্রুত দৌড়ানোর জন্য শক্তিশালী এবং দীর্ঘ। আবার, হাতি এবং গন্ডারের পা ভারি ও মজবুত, যা তাদের বিশাল দেহের ভারসাম্য রক্ষা করতে সহায়ক। পাখিদের ক্ষেত্রে পা সাধারণত ছোট এবং হালকা হয়, যা তাদের উড়তে সুবিধা দেয়। অন্যদিকে, সিংহ বা বাঘের পা তাদের শিকার ধরতে এবং শিকার করার সময় শক্তি প্রয়োগ করতে সক্ষম।
সব মিলিয়ে, পা হলো এমন একটি অঙ্গ, যা আমাদের চলাচল, ভারসাম্য রক্ষা, এবং শারীরিক শক্তির প্রয়োগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানবজীবনে পায়ের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এর সাহায্যে আমরা শুধু দৈনন্দিন কাজই করি না, বরং শারীরিক এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে পারি। বিবর্তন তত্ত্বের আলোকে পায়ের উদ্ভব এবং বিকাশের ধারা মানবজাতির জন্য এক উল্লেখযোগ্য অঙ্গ হিসেবে পায়কে প্রতিষ্ঠা করেছে, যা আমাদের অতীত, বর্তমান, এবং ভবিষ্যৎকে সুনির্দিষ্টভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামের আল্লাহর পায়ের প্রয়োজন কেন? আসুন এই সম্পর্কিত হাদিসগুলো পড়ে দেখি,
সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৮৬/ জাহ্মিয়াদের মতের খণ্ডন ও তাওহীদ প্রসঙ্গ
পরিচ্ছদঃ ৩১২৭. আল্লাহ্র বাণীঃ আল্লাহ্র অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়নদের নিকটবর্তী (৭ঃ ৫৬)
৬৯৪১। উবায়দুল্লাহ ইবনু সা’দ ইবনু ইবরাহিম (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়টি স্বীয় প্রতিপালকের কাছে অভিযোগ করল। জান্নাত বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমার ব্যাপারটি কি হলো যে তাতে শুধু নিঃস্ব ও নিম্ন শ্রেনীর লোকেরাই প্রবেশ করবে। এদিকে জাহান্নামও অভিযোগ করল অর্থাৎ আপনি শুধুমাত্র অহংকারীদেরকেই আমাতে প্রাধান্য দিলেন। আল্লাহ জান্নাতকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তুমি আমার রহমত। জাহান্নামকে বললেনঃ তুমি আমার আযাব। আমি যাকে চাইব, তোমাকে দিয়ে শাস্তি পৌছাব। তোমাদের উভয়কেই পূর্ণ করা হবে। তবে আল্লাহ তা’আলা তার সৃষ্টির কারো উপর যুলম করবেন না। তিনি জাহান্নামের জন্য নিজ ইচ্ছানুযায়ী নতুন সৃষ্টি পয়দা করবেন। তাদেরকে যখন জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তখন জাহান্নাম বলবে, আরো অভিরিক্ত আছে কি? জাহান্নামে আরো নিক্ষেপ করা হবে, তখনো বলবে, আরো অতিরিক্ত আছে কি? এভাবে তিনবার বলবে। পরিশেষে আল্লাহ তাআলা তাঁর কদম (পা) জাহান্নামে প্রবেশ করিয়ে দিলে তা পরিপূর্ন হয়ে যাবে। তখন জাহান্নামের একটি অংশ আরেকটি অংশকে এই উত্তর করবে যথেষ্ট হয়েছে যথেষ্ট হয়েছে ষথেষ্ট হয়েছে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
আবু হুরাইরার বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জাহান্নাম ততক্ষণ ভরবেনা যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর পা জাহান্নামে রেখে দেবেন তখন জাহান্নাম বলতে থাকবে ব্যাস! ব্যাস !!
(বুখারীও মুসলিম, মিশকাত ৫০৫ পৃষ্ঠা)
ইবনু আব্বাসের বর্ণনায় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আলকুর্সী মাওাইল কুদামাইন- কুরসী হচ্ছে আল্লাহর দুটি পায়ের পাতা রাখার জায়গা।
(মুসতাদরকে হা-কিম ২য় খণ্ড, ২৮২ পৃষ্ঠা)
তথ্যসূত্র
- সহিহ বুখারী। ইসলামিক ফাউন্ডেশন। অষ্টম খণ্ড। পৃষ্ঠা ২০৪ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"