ইসলাম ধর্মে কোরআনকে সর্বোচ্চ সত্য এবং নির্ভুল নির্দেশিকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সূরা আনফালের ৪৩ নম্বর আয়াতে দেখা যায়, আল্লাহ নবী মুহাম্মদ-কে যুদ্ধের পূর্বে একটি মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যেখানে শত্রুদের সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম দেখানো হয়েছিল। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেন যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এই মিথ্যা স্বপ্নটি দেখিয়েছিলেন, যাতে মুহাম্মদ এবং তার সাহাবীদের মনোবল অটুট থাকে এবং তারা যুদ্ধে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এই ধরনের বক্তব্য ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটি গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দেয়ঃ যদি কোরআনের প্রতিটি শব্দ ও বর্ণনা সত্য এবং নির্ভুল হয়, তাহলে আল্লাহ আসলেই নবী মুহাম্মদকে একটি মিথ্যা ও বানোয়াট স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে। এমনকি যদি তা মনের শক্তি ধরে রাখার জন্যও হয়, তবুও মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া কি আল্লাহর মতো সর্বশক্তিমান এবং সত্যের প্রতীক সত্তার জন্য সঙ্গতিপূর্ণ? আল্লাহ চাইলেই তো সাহাবীদের মনে সাহসের বান ডেকে যেতো। সেখানে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাদের মনোবল বাড়াবার প্রয়োজন হল কেন? আল্লাহ কী অন্য কোন উপায়ে মনোবল বাড়াতে অক্ষম ছিলেন যে, তার এরকম একটি ছলনার আশ্রয় নেয়া লাগলো? এর থেকেই বা মুসলিমরা কী শিক্ষা পেলো? প্রয়োজন অনুসারে মিথ্যা বানোয়াট ছলনা করা যায়?
এই আয়াতটি ধর্মীয় নৈতিকতার ওপরও একটি গুরুতর প্রভাব ফেলে। একজন ঈশ্বর, যিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান, যদি তার বিশ্বাসীদের মনোবল ধরে রাখতে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যার আশ্রয় নেন, তবে তা আল্লাহর সত্যের ধারণার সঙ্গে কিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে? এই আয়াতটি কি আল্লাহর সত্যবাদিতার ওপর একটি প্রশ্ন চিহ্ন সৃষ্টি করে না? এখানে বিষয়টি আরও বিতর্কিত হয়ে ওঠে, যখন কোরআনের অন্যান্য অংশে মিথ্যাচার বা প্রতারণাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে, যদি স্বয়ং আল্লাহ নিজেই তার নবীকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখান, তা কি ধর্মীয় নৈতিকতা ও আস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করে না? এমন একটি আয়াত ধর্মীয় অনুসারীদের জন্য একটি দ্বৈত মানদণ্ডের সৃষ্টি করে, যেখানে একজন বিশ্বাসীকে সত্যের পথে অটল থাকতে বলা হয়, অথচ তাদের ঈশ্বরই উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন [1],
স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নের মাধ্যমে তাদের সংখ্যাকে অল্প করে দেখিয়েছিলেন, যদি তিনি তাদের সংখ্যাকে তোমার নিকট বেশি করে দেখাতেন তাহলে তোমরা অবশ্যই সাহস হারিয়ে ফেলতে আর যুদ্ধের বিষয় নিয়ে অবশ্যইঝগড়া শুরু করে দিতে। কিন্তু আল্লাহ্ই তোমাদেরকে রক্ষা করেছিলেন, অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে তিনি খুবই ভালভাবে অবহিত।
— Taisirul Quran
আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নযোগে ওদের সংখ্যা অল্প দেখিয়েছিলেন, যদি তোমাকে তাদের সংখ্যা অধিক দেখাতেন তাহলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলতে এবং যুদ্ধ সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হত, কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। অন্তরে যা কিছু আছে সে সম্পর্কে তিনি সবিশেষ অবহিত।
— Sheikh Mujibur Rahman
যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নের মধ্যে তাদেরকে স্বল্প সংখ্যায় দেখিয়েছিলেন। আর তোমাকে যদি তিনি তাদেরকে বেশি সংখ্যায় দেখাতেন, তাহলে অবশ্যই তোমরা সাহসহারা হয়ে পড়তে এবং বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করতে। কিন্তু আল্লাহ নিরাপত্তা দিয়েছেন। নিশ্চয় অন্তরে যা আছে তিনি সে সব বিষয়ে অবগত।
— Rawai Al-bayan
স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ্ আপনাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন যে, তারা সংখ্যায় কম [১]; যদি আপনাকে দেখাতেন যে, তারা সংখ্যায় বেশি তবে অবশ্যই তোমরা সাহস হারাতে এবং যুদ্ধ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে। কিন্তু আল্লাহ্ তোমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আবশ্যই তিনি অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে সবিশেষে অবগত।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
[Remember, O Muḥammad], when Allah showed them to you in your dream as few; and if He had shown them to you as many, you [believers] would have lost courage and would have disputed in the matter [of whether to fight], but Allah saved [you from that]. Indeed, He is Knowing of that within the breasts.
— Saheeh International
( কোরআনঃ সূরা আনফাল আয়াত ৪৩ )
আসুন এই আয়াতটির তাফসীর শুনি মতিউর রহমান মাদানির মুখ থেকে,
এবারে আসুন তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে এই আয়াতটির অনুবাদ এবং প্রেক্ষাপট জেনে নিই। লক্ষ্য করুন, তাফসীরে খুব পরিষ্কারভাবেই বলা হচ্ছে, আল্লাহ পাক ইচ্ছাকৃতভাবেই নবী ও তার সাহাবীদের মিথ্যা বলেছিলেন [2] –
৪৩. স্মরণ কর সেই সময়টির কথা যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে দেখাইয়া ছিলেন যে, তাহারা সংখ্যায় স্বল্প, যদি তোমাকে দেখাইতেন যে, তাহারা সংখ্যায় অধিক তবে তোমরা সাহস পাইতে না এবং যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করিতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদিগের রক্ষা করিয়াছেন। তিনি তো অন্তরের বিষয় সম্পর্কে ভালভাবে ওয়াকিফহাল।
৪৪. স্মরণ কর, তোমরা যখন পরস্পরের সম্মুখীন হইয়াছিলে তখন তিনি তাহাদিগকে তোমাদিগের দৃষ্টিতে সল্প সংখ্যক দেখাইয়াছিলেন, যাহা ঘটিবার ছিল তাহা সম্পন্ন করিবার জন্য। সমস্ত বিষয় আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হয়।
তাফসীর : মুজাহিদ বলেন, আল্লাহ পাক মহানবী (সা)-কে স্বপ্নে উহাদের সংখ্যা কম দেখাইয়া ছিলেন। অতঃপর মহানবী (সা) তাঁহার সাহাবাগণকেও ইহা অবহিত করিয়া ছিলেন। সুতরাং উহাদের কাছে ইহাই প্রতীয়মান হইয়াছে। ইবন ইসহাক(র) সহ অনেক লোকই এইরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। ইবন জারীর (র) উহাদের কোন কোন লোক হইতে বর্ণনা করেন যে, যেরূপ স্বপ্নে দেখা গিয়াছে ময়দানেও অনুরূপ পরিদৃষ্ট হইয়াছে।
ইবন আবূ হাতিম (র) বর্ণনা বলেন : আমাদের নিকট আমার পিতা …. হাসান (র) হইতে … আয়াতাংশ প্রসঙ্গে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। হাসান বলেনঃ চাক্ষুস কম দেখান হইয়াছে। এই কথা অত্যন্ত দুর্বল ও গরীব। আয়াতে যখন পরিষ্কাররূপে শব্দ (স্বপ্ন) ব্যবহার হইয়াছে তখন দলীল ও যুক্তিহীন ব্যাখ্যার কোন অবকাশ থাকে না।
আলোচ্য … আয়াতের মর্ম হইল, আল্লাহ যদি তোমাদেরকে সংখ্যায় অধিক দেখাইতেন, তবে তোমরা ভীরু হইয়া পড়িতে এবং যুদ্ধ বিষয়ে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ দেখা দিত। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে উহাদের সংখ্যায় স্বল্পতা দেখাইয়া তোমাদের সাহস বাড়াইয়া তোমাদিগকে রক্ষা করিয়াছেন।
আলোচ্য … আয়াতাংশের তাৎপর্য হইল, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে গোপনকৃত এবং বুকের মাঝে রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে পূর্ণরূপেই জ্ঞাত থাকেন। যেমন অন্য এক আয়াতে বলা হইয়াছে, আল্লাহর চক্ষুর গর্হিত কাজ এবং তোমাদের অন্তরের মাঝে গোপনকৃত বিষয় পূর্ণরূপে অবস্থিত রহিয়াছে (৪০: ১৯)।
আলোচ্য … আয়াতাংশের তাৎপর্য হইলঃ আল্লাহ পাক এই আয়াতে তাঁহার নিয়ামতের কথা দ্বিতীয়বার উল্লেখ করিয়াছেন। অর্থাৎ আল্লাহ বলেন: তোমাদেরকে শুধু স্বপ্নেই উহাদের সংখ্যা কম দেখাই নাই। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যখন তোমরা পরস্পর মুখোমুখি হইয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিতেছিলে, তখনও আমি উহাদের সংখ্যা তোমাদের দৃষ্টিতে স্বপ্ন দেখাইয়াছি। তখন তোমরা বীরবিক্রমে দোয়া পড়িয়া উহাদিগকে পর্যুদন্ত করিয়াছিলে।
আবু ইসহাক সুবাই(র) ইবন মাসুদ (রা) হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ বদরের যুদ্ধের সময় উহাদিগকে সংখ্যায় কম দেখিয়াছি। শেষ পর্যন্ত আমি আমার পার্শ্বের এক লোককে বলিলাম, তুমি কি উহাদের সংখ্যা সত্তরজন দেখিয়াছ? এমনকি উহাদের এক লোককে বন্দী করিয়া উহাদের সংখ্যা জিজ্ঞেস করিলে সে উত্তর করিল আমাদের সংখ্যা এক হাজার।
আবারে আসুন তাফসীরে জালালাইন থেকে পড়ি [3] –
৪৩. স্মরণ কর আল্লাহ তোমাকে নিদ্রায় স্বপ্নে তাদেরকে সংখ্যায় অল্প দেখয়েছিলেন। আর তদনুসারে তুমি তোমার সাহাবীদের এই সংবাদ প্রদান করলে তারা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল। আর তাদেরকে যদি অধিক করে তোমাকে দেখাইতেন তবে তোমরা হতবল হয়ে যেতে সাহস হারিয়ে ফেলতে এবং যুদ্ধ বিষয়ে বিরোধ করতে, বিবাদ করতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে সাহসহারা ও বিবাদ করা হতে রক্ষা করেছেন এবং বক্ষে যা আছে অর্থাৎ অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে তিনি সবিশেষ অবহিত ।
৪৩ ও ৪৪ তম আয়াতে প্রকৃতির এক অপূর্ব বিস্ময় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যা বদর যুদ্ধের ময়দানে এই উদ্দেশ্যে কার্যকর করা হয়, যাতে উভয় বাহিনীর কোনো একটিও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে গিয়ে যুদ্ধের অনুষ্ঠানকেই না শেষ করে দেয়। কারণ, এ যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে বস্তুগত দিক দিয়েও ইসলামের সত্যতার বিকাশ ঘটানো ছিল নির্ধারিত।
বস্তুত প্রকৃতির সে বিস্ময়টি ছিল এই যে, কাফের বাহিনী যদিও তিন গুণ বেশি ছিল, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা শুধুমাত্র স্বীয় পরিপূর্ণ ক্ষমা ও কুদরতবলে তাদের সংখ্যাকে মুসলমানদের চোখে কম করে দেখিয়েছেন, যাতে মুসলমানদের মধ্যে কোনো দুর্বলতা ও বিরোধ সৃষ্টি হয়ে না যায়। আর এ ঘটনাটি ঘটে দু’বার। একবার মহানবীকে স্বপ্নযোগে দেখানো হয় এবং তিনি বিষয়টি মুসলমানদের কাছে বলেন। তাতে তাদের মনোবল বেড়ে যায়। আর দ্বিতীয়বার ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রে যখন উভয় পক্ষ সামনা-সামনি হয়, তখন মুসলমানদেরকে কাফেরদের সংখ্যা কম করে দেখানো হয়। সুতরাং ৪৩ তম আয়াতে স্বপ্নের ঘটনা এবং ৪৪ তম আয়াতে প্রত্যক্ষ জাগ্রত অবস্থার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
- কোরআনঃ সূরা আনফাল আয়াত ৪৩ [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৬৭-৪৬৮ [↑]
- তাফসীরে জালালাইন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৬, ৫৭৯, ৫৮০ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"