04.কারো বিশ্বাসকে আঘাত করা কি উচিত?

ভূমিকা

বিশ্বাস, চিন্তাধারা, মতাদর্শ এবং মতামতের মুক্ত প্রকাশ মানব সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যুক্তিবাদ, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং এই বিকাশের মূল চালিকা শক্তি। সমাজে একাধারে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস বিদ্যমান রয়েছে, এবং এগুলোর ভিত্তিতে মানুষের কাজ ও জীবনযাপন পরিচালিত হয়। তবে বিশ্বাসের ভিত্তিতে যদি সমালোচনার পথ বন্ধ করা হয়, তবে সমাজের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যুক্তি এবং প্রমাণের ভিত্তিতে বিশ্বাস যাচাইয়ের মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা মুক্তচিন্তার বিকাশে সহায়ক।

এই প্রবন্ধে, আমরা যুক্তিবাদী চিন্তার মৌলিক দিক, বিশ্বাসের সমালোচনা, এবং বিশ্বাসের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করব। আমরা দেখব, কেন প্রতিটি বিশ্বাসকে যুক্তিগতভাবে যাচাই করা উচিত এবং কেন সমালোচনা করতে পারার অধিকারই সামগ্রিকভাবে মানব সভ্যতার প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে সহায়ক।

যুক্তিবাদের মূলনীতি: যুক্তি ও প্রমাণের গুরুত্ব

যে কোন যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান নীতি হলো, সকল বিশ্বাস, মতাদর্শ, চিন্তা এবং ধারণাকে যুক্তি এবং প্রমাণের আলোকে যাচাই করা। যুক্তিবাদী চিন্তা কোন বিষয়কে অন্ধভাবে গ্রহণ করার পরিবর্তে তার বাস্তবতা, প্রমাণ, এবং যৌক্তিক ব্যাখ্যা খোঁজে। যুক্তিবিদ্যা হল সেই শাস্ত্র যা আমাদেরকে বৈধ চিন্তা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপায় শেখায়।

প্রাচীনকাল থেকে, দর্শন ও বিজ্ঞান যেকোনো দাবি যাচাই করার জন্য যুক্তি এবং প্রমাণের উপর জোর দিয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস এবং এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে অনুসন্ধান করার জন্য যৌক্তিক পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। এই যৌক্তিক পদ্ধতি আজকের বিজ্ঞান এবং বিচারব্যবস্থার মূল ভিত্তি।

সমালোচনা এবং প্রগতির সম্পর্ক

যেকোনো মতামত বা বিশ্বাস নিয়ে সমালোচনা করা কোনো আক্রমণ বা কটূক্তি নয়, বরং এটি সেই মতের সঠিকতা যাচাই করার একটি প্রক্রিয়া। মতামত বা বিশ্বাসের সমালোচনা করার মাধ্যমে আমরা সেই মতের প্রকৃত বাস্তবতা এবং যৌক্তিকতা যাচাই করতে পারি। বাক স্বাধীনতার সংজ্ঞা হিসেবে সহজ কথায় বলা হয়, আপনার যা শুনতে ইচ্ছা করে না, সেটি আমার বলার অধিকারই বাক স্বাধীনতা।

সমালোচনার পথ বন্ধ করে দিলে, সমাজে অগ্রগতি থেমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপের মধ্যযুগ (দ্য ডার্ক এজ) ছিল এমন একটি সময় যখন মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল সীমাবদ্ধ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ছিল অতুলনীয়। এই সময়ে বিজ্ঞানের বিকাশ ব্যাহত হয়েছিল, কারণ বিজ্ঞানীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত ছিল। বিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কার এবং চিন্তা ধর্মীয় মতাদর্শের বিরুদ্ধে গেলে তাদের উপর শাস্তি আরোপ করা হত। উদাহরণ হিসেবে গ্যালিলিও গ্যালিলেই-এর প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য, যিনি প্রমাণিত করেছিলেন যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। কিন্তু তার এই আবিষ্কার ধর্মীয় মতাদর্শের বিপরীত ছিল, তাই তাকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

অপরদিকে, ইউরোপের রেনেসাঁস যুগে সমালোচনা এবং মুক্তচিন্তার প্রচলন আবার শুরু হয়, যা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির যুগের সূচনা করে। নতুন বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও আবিষ্কার সমাজের বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে অবদান রাখে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, সমালোচনার সুযোগ থাকা এবং বিভিন্ন মতামতের বিচার বিশ্লেষণ করাই সমাজের উন্নতির জন্য অপরিহার্য।

সকল বিশ্বাসকে সম্মান করা কি যৌক্তিক?

প্রায়ই শোনা যায় যে, আমাদের সকল বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করা উচিত এবং সব ধরণের মতামতকে সম্মান করতে হবে। কিন্তু এই ধারণাটি বাস্তবিক এবং যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা যৌক্তিক?

বিশ্বাসের অধিকার এবং বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন দুটি আলাদা বিষয়। একজন ব্যক্তি তার ইচ্ছেমত বিশ্বাস করার এবং মত প্রকাশের অধিকার রাখেন, কিন্তু তার বিশ্বাস বা মতামত যৌক্তিক, প্রমাণভিত্তিক এবং মানবিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, সেটি যাচাই করার অধিকারও অন্যের থাকা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ দাবি করেন যে পৃথিবী সমতল, আমরা তার এই দাবি শ্রদ্ধা করতে পারি না। এই দাবি বৈজ্ঞানিক প্রমাণের বিপরীত এবং প্রমাণিত ভুল ধারণা। তার এটি বলার অধিকার রয়েছে, একইসাথে রয়েছে আমাদের সেই মতের বিরোধিতা করা, সমালোচনা করা, কটাক্ষ করার অধিকারও।

ধর্মীয় প্রসঙ্গে বলা যায়, হিন্দুদের জন্য গরু পবিত্র, কিন্তু মুসলিম ধর্মে কোরবানির প্রথা বিদ্যমান। একদিকে মুসলিমদের কোরবানির প্রথা হিন্দুদের বিশ্বাসের সাথে বিরোধী, আবার হিন্দুদের মূর্তিপূজা মুসলিমদের ধর্মীয় মতাদর্শের বিরুদ্ধে। তাহলে কি এই দুটি বিশ্বাসকে সম্মান জানাতে গরু কোরবানি এবং মূর্তিপূজা উভয়ই বন্ধ করতে হবে? এখানে দেখা যায়, একটি সমাজে সহাবস্থান করতে হলে একে অপরের বিশ্বাসের সাথে বিরোধ থাকতে পারে এবং সেই বিশ্বাসের মধ্যে কোনটি সঠিক তা যাচাই করার প্রয়োজন রয়েছে। একটি আদর্শ সমাজে দুইজন মানুষ চাইলে গরু কোরবানী দিতে পারবেন, আরেকজন মূর্তিপূজাও করতে পারেন।একইসাথে তারা পরস্পরের গরু কোরবানী ও মূর্তিপূজার সমালোচনা করতে পারেন, একজন আরেকজনকে বাধা না দিয়ে।

এছাড়া, ইতিহাসে অনেক নেতিবাচক ও ক্ষতিকর বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ, হিটলারের নাজি মতাদর্শ। এই বিশ্বাসের ফলে লাখ লাখ মানুষের জীবন বিনষ্ট হয়। তাহলে কি আমরা সেই বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করব? একইভাবে, বিভিন্ন ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন যেমন আল-কায়েদা, আইএসআইএস, এবং বাংলা ভাই-এর মতাদর্শও ক্ষতিকর। তারা সহিংসতা এবং হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এসব বিশ্বাস যুক্তিবাদী চিন্তার ভিত্তিতে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়, বরং এগুলো সমাজের জন্য হুমকি।

বাক স্বাধীনতা ও মতামতের সমালোচনা

বাকস্বাধীনতা মানবাধিকারের অন্যতম মূলনীতি। প্রতিটি মানুষেরই তার মত প্রকাশের অধিকার আছে, এবং এই অধিকারকে সম্মান করা উচিত। তবে এই মতামতের অধিকারকে সম্মান করা মানেই সেই মতামতকে শ্রদ্ধা করা নয়। মতামত বা বিশ্বাস ভালো বা মন্দ হতে পারে, এবং একজন ব্যক্তির অধিকার রয়েছে সেই মতের সমালোচনা করার।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমাজে একটি উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে মানুষ তাদের চিন্তা এবং বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করতে পারে। তবে সেই আলোচনার মধ্যে সমালোচনার অধিকারও থাকা উচিত। যে কোন মতবাদ, তা ধর্মীয় হোক বা রাজনৈতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক হোক বা সাংস্কৃতিক, যদি তা অসার বা ভুল প্রমাণিত হয়, তবে তা সমালোচনার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে।

যুক্তির ভিত্তিতে যাচাই: বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের মাঝে বিতর্ক

প্রকৃত যুক্তিবাদী সমাজে, প্রতিটি বিশ্বাস বা মতবাদকে যুক্তির কাঠামোতে বিচার করা হয়। যদি কোনো বিশ্বাস যুক্তির পরিপন্থী হয়, তবে সেটি ভুল বলে প্রতীয়মান হয়। আমরা যদি কোনো বিশ্বাসকে সমালোচনা থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করি, তবে সেই বিশ্বাসকে তার নিজস্ব সঠিকতা প্রমাণ করতে সুযোগ দেওয়া হয় না। এটি একটি অস্পষ্ট অবস্থান তৈরি করে, যা প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও, প্রতিটি তত্ত্বকে যাচাইয়ের জন্য উন্মুক্ত থাকতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এক সময়ে অভাবনীয় বলে মনে হলেও, বিজ্ঞানীরা তা বারবার পরীক্ষা করে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। এই ধরনের প্রমাণ এবং যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহার

বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমরা যখন যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করি, তখন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমালোচনার অধিকার। সমাজের যেকোনো বিশ্বাস বা মতবাদকে যুক্তি এবং প্রমাণের আলোকে বিচার করা উচিত। যদি কোনো বিশ্বাস প্রমাণ এবং যুক্তির ভিত্তিতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তবে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শুধুমাত্র মত প্রকাশের অধিকার থাকা মানেই সেই মতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা নয়।

আমরা শুধুমাত্র সেই বিশ্বাসকেই শ্রদ্ধা করতে পারি, যা যৌক্তিক এবং প্রমাণভিত্তিক আলোচনায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। বাকস্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের সমাজের প্রগতির পথকে উন্মুক্ত রাখে, এবং আমরা সেই অধিকারকে সম্মান করি। তবে, সকল বিশ্বাসকে সমানভাবে সম্মান জানানো যৌক্তিক নয়; বরং প্রতিটি বিশ্বাসকে যুক্তির কাঠামোতে যাচাই করা এবং মিথ্যা প্রমাণিত হলে তা প্রত্যাখ্যান করা প্রয়োজন।


পুনশ্চঃ ইসলাম কি অন্য ধর্মকে সম্মান করে?

ইসলাম ধর্মের প্রধান নবী মুহাম্মদ পৌত্তলিকদের দেবদেবী, পূর্বপুরুষদের ধর্ম, এগুলো সম্পর্কে অবমাননাকর কটূক্তি করতো বলেই ইসলামিক সূত্রগুলো থেকে পরিষ্কারভাবেই জানা যায়। মক্কায় সেই সময়ে তাকে ধর্মদ্রোহীতা দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তার ওপর অভিযোগ ছিল-তিনি প্রচলিত ধর্মকে অসম্মান এবং অবমাননা করেছেন। সমাজে শত শত বছর ধরে প্রচলিত ধর্মের সমালোচনা, বাপদাদার ধর্মের অবমাননা, কটূক্তি, দেবদেবী নিয়ে অপমানজনক কথা বলার কারণে বারবার তাকে সতর্ক করা হয়। কিন্তু নবী কখনোই ধর্ম অবমাননা থেকে সরে আসেন নি। তাই বাপদাদার ধর্ম বা প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কটূক্তি করা তো নবী রাসুলেরই সুন্নত। উল্লেখ্য, উনাকে কিন্তু শুরুতেই আক্রমণ করা হয় নি [1]

আঘাত
আঘাত 1

এই বিষয়ে আরো জানা যায় সীরাতুল মুস্তফা সা. গ্রন্থ থেকে। নবী মুহাম্মদ নিজেই বলতেন, তিনি মূর্তিকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন [2]

আঘাত 3
আঘাত 5
আঘাত 7
আঘাত 9
আঘাত 11

এবারে আসুন আসহাবে রাসুলের জীবনকথাতে বর্ণিত ইবনু হিসামের আল সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ গ্রন্থের একটি দলিল পড়ে নিই। এখানে দেখুন, কিছু পৌত্তলিক এসে নবীকে জিজ্ঞেস করলো, আপনিই কি সেই ব্যক্তি, যিনি পৌত্তলিকদের বাপ দাদাদের গালাগালি করেন, তাদের উপাস্যকদের দোষের কথা বলেন, পৌত্তলিকদের বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান লোকেদের নির্বোধ ও বোকা মনে করেন? উত্তরে নবী বললো, হ্যাঁ, আমিই সেই ব্যক্তি। অর্থাৎ তিনিই এই সব কর্ম করে থাকেন [3]

আঘাত 13

তথ্যসূত্র

  1. সীরাতে ইবনে হিশাম : হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জীবনীগ্রন্থঃ আকরাম ফারুক পৃষ্ঠা ৬১, ৬২ []
  2. সীরাতুল মুস্তফা সা. লেখকঃ আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী (রহ.) প্রকাশকঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১১৩, ১৪৪, ১৪৯, ১৫৪, ১৫৫ []
  3. আসহাবে রাসুলের জীবনকথা, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"