প্রশ্নঃ আপনার বাবাই যে আসলে আপনার সত্যিকারের জন্মদাতা, তার প্রমাণ কী?
উত্তরঃ প্রথমেই, আমরা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দের সংজ্ঞা পরিষ্কার করতে পারি: বিশ্বাস (Believe), আস্থা (Trust) এবং ধর্মবিশ্বাস (Faith)। এগুলো প্রায়শই একে অপরের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়, তবে এদের পার্থক্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
শব্দের সংজ্ঞা:
- Believe(বিশ্বাস) – অনুমান, বিশ্বাস, বিশেষভাবে প্রমাণ ছাড়াই মেনে নেয়া
- accept that something is true, especially without proof.
- hold something as an opinion; think.
উদাহরণ: ভুতে বিশ্বাস করা, এলিয়েনে বিশ্বাস করা।
- Trust (আস্থা) – পূর্ব অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের(যা যুক্তি ও প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত) আলোকে কোন কিছুকে সঠিক বা সত্য বলে ধারণা করা।
- firm belief in the reliability, truth, or ability of someone or something.
উদাহরণ: বন্ধু টাকা ধার নিলে তা ফেরত দেবে বলে আস্থা রাখা, কোন বিশেষ পত্রিকার উপর আস্থা রাখা। যেমন বিবিসি বা নাসার প্রচারিত সংবাদের ওপর আস্থা রাখা।
- firm belief in the reliability, truth, or ability of someone or something.
- Faith (বিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস, বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই পরিপূর্ণ বিশ্বাস)
- complete trust or confidence in someone or something.
- strong belief in the doctrines of a religion, based on spiritual conviction rather than proof.
উদাহরণ: ইসলাম বিশ্বাস করা, হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা।
বাবা কে এবং তা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া:
আমরা সাধারণত পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু বিষয়ের ওপর আস্থাশীল হই, এবং কিছু বিষয় সম্পর্কে ধারণা করি যে, সেটি সত্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ইংরেজিতে যাকে বলে লাইকলিহুড বা প্রবল সম্ভাবনা। যেমন ছোটবেলা থেকে আমরা যাদের বাবা মা বলে জেনে এসেছে, যাদের আশেপাশে দেখেছি, তাদেরই বাবা মা বলে জানি। এর সাথে যুক্ত হয় নানান ছোট ছোট আপাত দৃষ্টিতে যুক্তি বা প্রমাণ। যেমন, আমরা আমাদের চেহারার সাথে আমাদের বাবা মায়ের চেহারার মিল খুঁজে পাই। গায়ের রঙ, উচ্চতা, চোখের রঙ ইত্যাদি বিষয়ে আমরা মিল খুঁজি। নানান আচার আচরণের সাথে মিল খুঁজে পাই আমাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের আচার আচরণের। এভাবেই আমরা আমাদের বাবা মা কে, সেটি সম্পর্কে ধারণা করি। ছোটবেলা থেকেই আমরা পরিবার পরিজন থেকে এই সম্পর্কে ধারণা নিয়েই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠি।
আমরা আস্তিক বা নাস্তিক কেউই আসলে শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি না, আমার বাবাই আমার জন্মদাতা। কারণ আমার জন্ম প্রক্রিয়া অর্থাৎ সেই যৌনকর্মের সময় আমরা কেউই সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। তবে যেহেতু আমরা একটি পরিবারে বড় হই, সেই শিক্ষা নিয়েই বড় হই যা আমাদের শেখানো হয়। কিন্তু সেটি সবার বেলাতে শতভাগ সত্য নাও হতে পারে। হয়তো আমি যাকে বাবা বলে এতদিন ডেকে এসেছি, সে আসলে আমার জন্মদাতা নন। আমাকে কুড়িয়ে পাওয়া হয়ে থাকতে পারে, অথবা আমার জন্মদাতা আমার জন্মের আগেই মারা যেতে পারে। অনেক ঘটনাই অনেকের ক্ষেত্রে ঘটে। কিন্তু সেগুলোর বেলাতেও আমরা আসলে যুক্তি ও প্রমাণেরই আশ্রয় নিই। কখনই আমরা শুধুমাত্র বিশ্বাসের ভিত্তিতে কাউকে বাবা হিসেবে সাব্যস্ত করি না।
ধরুন, কাল রহিমুদ্দীন বা কলিমুদ্দীন নামের একজন রাস্তায় আপনাকে এসে জাপটে ধরে বললো, সেই আপনার বাবা। এবং আপনাকে বলা হলো, সে যে আপনার বাবা, সেটি অন্তর দিয়ে অনুভব করতে বা সেটি হৃদয় দিয়ে ধারণ করতে। বিশ্বাস করতে। কোন যুক্তি বা প্রমাণ না চাইতে। এই নিয়ে সন্দেহ না করতে। প্রশ্ন না করতে। আপনি কী করবেন? আপনি যত বিড় বিশ্বাসী মানুষই হোন না কেন, আপনি সেই লোককে কোন প্রমাণ ছাড়া বাবা ডাকবেন না। হয়তো আপনি যুক্তির ধার ধারেন না, বা সন্দেহ অথবা প্রশ্ন করেন না, পরিপূর্ণভাবে একজন বিশ্বাসী মানুষ, তারপরেও আপনি সেই ক্ষেত্রে প্রমাণ চাইবেন। নাকি কোন প্রমাণ ছাড়াই সেই লোকের কথাতে বিশ্বাস করে বাবা বাবা বলে তার গালে দুটো চুমু দেবেন?
সেটি আপনি করবেন না। কারণ এই ক্ষেত্রেও প্রমাণ দরকার হবে। আর যদি তার কাছে সেরকম কোন অবজেক্টিভ প্রমাণ থাকে, সেটি মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। হয়তো আপনাকে যে লালন পালন করেছে, তাকেই আপনি সবসময় বাবা ডাকবেন, কিন্তু আপনার জন্মদাতার কাছে যদি ডিএনএ টেস্ট রেজাল্ট থাকে, এবং অন্যান্য প্রমাণের মাধ্যমে যদি সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ হয় যে, সেই আপনার জন্মদাতা, সেই ক্ষেত্রে এটি তো মানতেই হবে। কারণ যুক্তি তথ্য প্রমাণ ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির চাইতে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।
ডিএনএ টেস্ট এবং বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ:
আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে, আমরা অনেকটাই জেনেটিক প্রমাণের ওপর নির্ভর করতে পারি। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা আমাদের জন্মদাতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি। যদিও সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে এই ধরনের সম্পর্ক নির্ধারণ করা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। তাই, যাকে আপনি আপনার বাবা বলে জানেন, তার সাথে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে মিল খুঁজে পাওয়া গেলে, সেটাই হবে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ।
বিশ্বাস বনাম প্রমাণ:
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন—যদি আমি বড় হয়ে এমন একজনকে বাবা হিসেবে জানি, এবং আমার মনে গভীর আস্থা থাকে, তাহলে কি এটি যথেষ্ট নয়? তবে এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আস্থা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তি হতে পারে, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া এর যৌক্তিক বৈধতা দুর্বল। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন ব্যক্তি তার বাবাকে নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিনতে পারে, সেটি তার কাছে যথেষ্ট হতে পারে। কিন্তু কোনও আইনি বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের প্রেক্ষাপটে সেই আস্থা যথেষ্ট নাও হতে পারে।
অন্যদিকে, যদি একজন দাবি করে, “আমি অনুভব করি যে আমার বাবা আমার সত্যিকারের জন্মদাতা নন,” এবং কোনও প্রমাণ ছাড়া সেটি মেনে নেয়, সেটিও একইভাবে ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। কারণ অনুভূতি বা বিশ্বাস প্রমাণ নয়।
ধর্মবিশ্বাস বনাম বাস্তব অভিজ্ঞতা:
ধর্মীয় বিশ্বাস এবং পারিবারিক বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য হলো, ধর্মীয় বিশ্বাসে প্রমাণের কোনো ভূমিকা থাকে না। ধর্ম বিশ্বাসীরা তাদের ঈশ্বর বা ধর্মীয় বিষয়গুলোকে প্রমাণ ছাড়া মেনে নেয়। কিন্তু পারিবারিক বা জেনেটিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রমাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ঈশ্বরের অস্তিত্বের মতো বিষয়গুলো কেবল বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করতে পারে, কিন্তু বাবা-মা সম্পর্কিত তথ্য নির্ভর করে জেনেটিক এবং অভিজ্ঞতাগত প্রমাণের ওপর।
উপসংহার:
আপনার বাবাই যে আসলে আপনার জন্মদাতা, তার নিশ্চিত প্রমাণ পেতে গেলে বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা ও যুক্তির সাহায্য নেয়া জরুরি। আমরা সাধারণত পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক শিক্ষা, এবং অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে আমাদের বাবা-মাকে চিনি। কিন্তু কোনো অজানা দাবি বা তথ্যের ক্ষেত্রে প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করা যাবে না। যেমন আমরা ডিএনএ টেস্ট বা অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে আমাদের জন্মদাতাকে নিশ্চিত করতে পারি, তেমনই, যুক্তি এবং প্রমাণের ওপর নির্ভর করা সর্বোত্তম পথ।
বিশ্বাস ও প্রমাণের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ব্যক্তি জীবনের সম্পর্ক এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও এই নীতিগুলো প্রযোজ্য।