07.জ্বীনদের খাদ্য হাড্ডি ও গোবর

ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, জ্বীন হলো এক ধরনের অদৃশ্য এবং অলৌকিক সৃষ্টি, যাদের সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তারা মানুষের মতোই স্বাধীন সত্তা, যারা ভালো বা খারাপ কাজ করতে সক্ষম এবং তাদের মধ্যে কিছু মুমিন এবং কিছু কাফিরও রয়েছে। ইসলামিক মিথলজিতে উল্লেখ আছে যে, জ্বীনরা হাড্ডি এবং গোবর খায়, যা তাদের খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। তবে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই দাবির সত্যতা বিশ্লেষণ করলে কিছু গুরুতর অসঙ্গতি উঠে আসে। ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে কাল্পনিক প্রাণী জিনেরা হাড্ডি এবং গোবর খায়, এর অর্থ হচ্ছে জিনেদের পরিপাকতন্ত্র আছে এবং খাবার হজম হয় [1]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৬৩/ আনসারগণ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর মর্যাদা
পরিচ্ছদঃ ৬৩/৩২. জ্বিনদের উল্লেখ।
৩৮৬০. আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উযু ও ইস্তিন্জার ব্যবহারের জন্য পানি ভর্তি একটি পাত্র নিয়ে পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তিনি তাকিয়ে বললেন, কে? আমি বললাম, আমি আবূ হুরাইরাহ। তিনি বললেন, আমাকে কয়েকটি পাথর তালাশ করে দাও। আমি তা দিয়ে ইস্তিন্জা করব। (১) তবে, হাড় এবং গোবর আনবে না। আমি আমার কাপড়ের কিনারায় কয়েকটি পাথর এনে তাঁর কাছে রেখে দিলাম এবং আমি সেখান থেকে কিছুটা দূরে গেলাম। তিনি যখন ইস্তিন্জা হতে বেরোলেন, তখন আমি এগিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হাড় ও গোবর এর ব্যাপার কী? তিনি বললেন, এগুলো জ্বিনের খাবার। আমার কাছে নাসীবীন (২) নামের জায়গা হতে জ্বিনের একটি প্রতিনিধি দল এসেছিল। তারা ভাল জ্বিন ছিল। তারা আমার কাছে খাদ্যদ্রব্যের আবেদন জানাল। তখন আমি আল্লাহর নিকট দু‘আ করলাম যে, যখন কোন হাড্ডি বা গোবর তারা লাভ করে তখন তারা যেন তাতে খাদ্য পায়। (৩) (১৫৫) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৫৭৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৫৭৮)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

জ্বীনদের পরিপাকতন্ত্রের ধারণা: ইসলামিক বিশ্বাস বনাম বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা

জ্বীনদের হাড্ডি এবং গোবর খাওয়ার ধারণা অনুযায়ী, তারা মানুষের মতোই কিছু খাবার গ্রহণ করে এবং তা পরিপাক করে। এর ফলে, একটি জৈবিক পরিপাকতন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে, যা এমন সত্তার জন্য প্রযোজ্য, যাদের শারীরিক উপস্থিতি রয়েছে এবং যারা বাস্তব জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য হজম করে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান কিছু মূল বিষয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরে:

  • ১. অদৃশ্য সত্তা এবং শারীরিক পরিপাকতন্ত্র:
    • জ্বীনকে ইসলামি মিথলজিতে একটি অদৃশ্য সত্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যারা মানুষের চোখে দেখা যায় না। তবে খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাক করার ধারণা অনুযায়ী, শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপস্থিতি প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, খাদ্য পরিপাক করতে হলে মুখ, দাঁত, খাদ্যনালী, পাকস্থলী, অন্ত্র, এবং লিভার, প্যানক্রিয়াসের মতো অঙ্গগুলোর প্রয়োজন। খাদ্য গ্রহণের পর, জৈবিক প্রক্রিয়ায় এনজাইম ও পেটের এসিড খাবারকে ভেঙে দেয় এবং সেগুলো পুষ্টি হিসেবে শরীরের অন্যান্য অংশে পৌঁছে দেয়।
    • এটি স্পষ্ট যে, কোনো অদৃশ্য বা অলৌকিক সত্তা যেমন জ্বীনদের পক্ষে এই ধরনের জৈবিক প্রক্রিয়া বাস্তবসম্মত নয়, কারণ অদৃশ্য সত্তার শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থাকাও অসম্ভব। এই অসঙ্গতির কারণে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, জ্বীনদের হাড্ডি এবং গোবর খাওয়ার ধারণাটি বাস্তবিক নয়।
  • ২. হাড্ডি এবং গোবরের রাসায়নিক গঠন:
    • হাড্ডি বা কঙ্কাল মূলত ক্যালসিয়াম ফসফেট এবং অন্যান্য খনিজ উপাদান দিয়ে গঠিত, যা অত্যন্ত শক্ত এবং কঠিন পদার্থ। এগুলো হজম করতে সক্ষম এমন জৈবিক প্রক্রিয়া খুবই জটিল। মাংসাশী প্রাণীদের দাঁত এবং পাকস্থলীর এনজাইমগুলো বিশেষভাবে হাড় ভাঙতে সক্ষম হলেও, এমন একটি অলৌকিক সত্তার ক্ষেত্রে এটি কীভাবে কার্যকর হবে, তা বিজ্ঞান দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।
    • গোবর মূলত পশুর অদীষ্ট খাবারের অবশিষ্টাংশ এবং বর্জ্য পদার্থ, যা প্রাণীদেহে প্রাথমিকভাবে হজম হওয়ার পরে নির্গত হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে অণুজীব ও ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা পরিপাকতন্ত্রের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনো অলৌকিক সত্তা যদি গোবর খায়, তবে তাকে এই ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য অণুজীব থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য পরিপাকতন্ত্রের বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়বে।
  • ৩. খাদ্য গ্রহণের শারীরিক প্রভাব:
    • বিজ্ঞান অনুযায়ী, খাদ্য গ্রহণ এবং পরিপাক করার মাধ্যমে শরীর শক্তি উৎপাদন করে। শরীরের প্রয়োজনীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন পাকস্থলী, লিভার, অন্ত্র, ইত্যাদি এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জ্বীন যদি সত্যিই খাদ্য গ্রহণ করে, তবে তাদের শরীরের প্রয়োজনীয় অঙ্গ থাকতে হবে। কিন্তু ইসলামিক বিশ্বাস অনুযায়ী, জ্বীন অদৃশ্য এবং তাদের শারীরিক গঠন মানুষের মতো নয়। যদি তাদের শারীরিক অঙ্গ থাকত, তবে তারা মানুষের মতো দৃশ্যমান হত এবং বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী তাদের আচরণ করতে পারত।
  • ৪. অদৃশ্য সত্তার পদার্থবিজ্ঞান:
    • পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো সত্তা দৃশ্যমান বা অদৃশ্য হওয়ার জন্য তাদের উপর নির্দিষ্ট কিছু শর্ত প্রযোজ্য। কোনো জীব যদি খাদ্য গ্রহণ করে, তবে সেই খাদ্যকণা অবশ্যই সেই সত্তার সাথে মিথস্ক্রিয়া করবে এবং তাদের দেহের ভিতর প্রবেশ করবে। এটি সত্তাটিকে দৃশ্যমান করে তুলবে, কারণ পদার্থকে অদৃশ্য থাকতে হলে তা আলোর সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারবে না। তবে, জ্বীনরা যদি বাস্তব খাবার গ্রহণ করে, তবে তারা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী অদৃশ্য থাকতে পারে না।

বৈজ্ঞানিক মিথ এবং ইসলামিক বিশ্বাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব:

ইসলামিক বিশ্বাসে জ্বীনরা অলৌকিক সত্তা, যারা মানুষের চোখে দেখা যায় না এবং তারা আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন। কিন্তু বিজ্ঞান বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে কাজ করে এবং কোনো কিছু প্রমাণ করার জন্য পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা এবং প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। জ্বীনদের হাড্ডি এবং গোবর খাওয়ার ধারণাটি অলৌকিক, যা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সত্য হতে পারে না, কারণ তা জৈবিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।

যেকোনো সত্তার খাদ্য গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, পরিপাকতন্ত্র, এবং রসায়নিক প্রক্রিয়া ছাড়া খাদ্য হজম করা সম্ভব নয়। এছাড়াও, হাড্ডি ও গোবরের মতো কঠিন বা বর্জ্য পদার্থ হজম করার জন্য শক্তিশালী শারীরিক প্রক্রিয়া ও রসের প্রয়োজন হয়, যা জ্বীনদের মতো অলৌকিক সত্তার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকভাবে অবাস্তব।

উপসংহার:

জ্বীনদের হাড্ডি এবং গোবর খাওয়ার ধারণাটি ইসলামিক মিথলজির একটি অংশ এবং অলৌকিক বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে, বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা অনুযায়ী, এই ধারণাটি বাস্তবসম্মত নয়। খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক প্রক্রিয়া, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়া কোনো অদৃশ্য সত্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। অতএব, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্বীনদের খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত এই বিশ্বাসকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় না।

তথ্যসূত্র

  1. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বরঃ ৩৮৬০ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"