ইসলাম আবির্ভাবের বহুকাল আগে থেকেই দেবদেবীর মূর্তিতে পরিপূর্ণ মক্কা কাবায় বছরে একবার তীর্থযাত্রীদের সমাগম হতো। অপবিত্র কাপড় পরে এই উপাসনা নিষিদ্ধ ছিল বিধায় সেলাই বিহীন কাপড় সেখানে গিয়ে পরতে হতো। কিছু কিছু গোত্র সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়েও কাবা প্রদক্ষিণ করতো। কাবাকে বাম দিকে রেখে ডান দিক থেকে সাতবার চক্কর দেয়ার নিয়ম সেই সময়েই ছিল। ঘোরার সময় কালো পাথরকে চুম্বন করা ও মাথা নোয়ানোর নিয়ম ছিল। মক্কার দুই পর্বত সাফা ও মারওয়ার মধ্যে দৌড়ানো থেকে শুরু করে শয়তানকে পাথর মারার প্রতিটি পুরনো প্যাগান ধর্মগুলোর ইসলামি সংস্করণ। দেবতার সন্তুষ্টি লাভের আশায় সেই সময়ে গরু উট ছাগল ইত্যাদি কোরবানি দেয়াও ছিল পৌত্তলিক প্রথা।
ইসলামের প্রাথমিক সময়ে মুসলমানদের কেবলা ছিল পৌত্তলিক দেবদেবীর মূর্তিতে পরিপূর্ণ কাবা। এরপরে ইহুদিদের দলে টানার জন্য মুহাম্মদ কিবলা পরিবর্তন করে ইহুদিদের মতই ছিল বায়তুল মোকাদ্দাসের দিক মুখ করে নামাজ আদায় করতে শুরু করেন৷ ইহুদিরা সেই সময়ে মানমর্যাদার দিক দিয়ে সম্ভ্রান্ত ছিলেন, নবীদের বর্ণিত ঈশ্বরের আশির্বাদ ধন্য জাতি হিসেবে তারা সামাজিক সম্মান লাভ করতেন। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবেও তারা প্রভাবশালী ছিলেন। মুহাম্মদ তার নতুন ধর্মের নানা প্রথা ইহুদীদের থেকে নিয়েছিলেন। মুহাম্মদের প্রত্যাশা ছিল, হয়তো ইহুদীরা তাকে তাদের নবী হিসেবে মেনে নেবে।
ইহুদীদের মধ্যে সেই সময়ে দরিদ্রদের সম্পদের একটা অংশ দেয়ার প্রথা ছিল, যাকে বলা হয় Tzedakah বা Ṣedaqah। মুহাম্মদ এই প্রথাটিকে গ্রহণ করেন সাদাকাহ ও যাকাত নামকরণের মাধ্যমে। ইহুদীদের মধ্যে শুকরের খাওয়া হারাম ছিল, মুহাম্মদের নতুন ধর্মের ওজু এবং নামাজের সাথে সাবেইনদের ধর্মের প্রার্থনা ও ইহুদি ধর্মের প্রার্থনারীতির অনেকটাই মিলে যায়। ইহুদীরা শনিবার, খ্রিস্টানরা রবিবারকে প্রার্থনার জন্য বিশেষ দিন হিসেবে পালন করতো, মুহাম্মদ সেটাকে করেন শুক্রবারে। আরব পৌত্তলিক ও ইহুদিদের মধ্যে উপবাস প্রচলিত ছিল, যা তিনি গ্রহণ করেন রোজা নাম দিয়ে। এমনকি, এখনকার সময়ে সুন্নতে খৎনার ধারণাও ইহুদিদের অনুকরণে যুক্ত হয়। ইহুদিরা সেই সময়ে একজন নবীর আবির্ভাবের অপেক্ষায় ছিল, মুহাম্মদ মদিনা হিজরতের পরে কিছু সময়ে পর্যন্ত ভেবেছিল সে নিজেকে নবী দাবী করলে ইহুদীদের সাথে তার মিত্রতা তৈরি হবে।
কিন্তু পরবর্তীতে ইহুদীরা মুহাম্মদকে ভণ্ড এবং পাগল আখ্যা দিলে মুহাম্মদ পরবর্তী জীবনে ইহুদিদের ভালভাবেই ঘৃণা করতেন। এমনকি, বহু ইহুদি গোত্রকে দিনের মধ্যে উধাও করে ফেলা হয়। তাদের ওপর নির্মম গণহত্যা চালানো হয়। তাদের নারী এবং শিশুদের যৌনদাস বানানো হয়। মুহাম্মদের জীবনের শেষ ওয়াসিতের একটি ছিল ইহুদি নাসারা ও পৌত্তলিক সবাইকে আরব উপদ্বীপ থেকে বিতারিত করার নির্দেশনা। সেই নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে এখানে [1]। কিন্তু শুরুর দিকে ব্যাপারটি এরকম ছিল না। শুরুতে মুহাম্মদের সাথে ইহুদিদের সখ্যতাই ছিল। কিন্তু শত্রুতা সৃষ্টির পরেই মুহাম্মদ কিবলা সরিয়ে নেন।
সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫/ নামাজ প্রসঙ্গে
পরিচ্ছেদঃ ২২/ কিবলামুখী হওয়া ফরজ প্রসঙ্গে
৪৮৯। মুহাম্মদ ইবনু বাশ্শার (রহঃ) … বা’রা ইবনু আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ষোল মাস বা সতর মাস (বর্ণনাকারী সুফিয়ানের সন্দেহ) বায়তুল মুকাদ্দাস অভিমুখী হয়ে সালাত আদায় করি। পরে তাঁকে (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে) কাবার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়।
সহিহ, ইরউয়াউল গালীল হাঃ ৪৯০, বুখারি হাঃ ৪৪৯২, মুসলিম (ইসলামিক সেন্টার) হাঃ ১০৬৬
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ বারা’আ ইবনু আযিব (রাঃ)
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫/ মসজিদ ও সালাতের স্থান
পরিচ্ছেদঃ ২. বায়তুল মুকাদ্দাস হতে কা’বার দিকে কিবলা পরিবর্তন
১০৬১। শায়বান ইবনু ফাররূখ ও কুতায়বা ইবনু সাঈদ (রহঃ) … আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকেরা কুবাতে ফজরের সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করছিল, ইতিমধ্যে একজন লোক এসে বলল, এ রাত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং কাবার দিকে মুখ করবার আদেশ প্রদান করা হয়েছে। অতএব, তোমরাও কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়াও। তাদের চেহারা ছিল তখন সিরিয়ার দিকে। অতঃপর তারা কা’বার দিকে ঘূরে গেলেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ)
আল-লুলু ওয়াল মারজান
৫/ মাসজিদ ও সালাতের স্থানসমূহের বর্ণনা
পরিচ্ছেদঃ ৫/২. বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে কা’বার দিকে কিবলা পরিবর্তন।
৩০৪. ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা লোকেরা কুবা নামক স্থানে ফজরের সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় তাদের নিকট এক ব্যক্তি এসে বললেন যে, এ রাতে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ওয়াহী অবতীর্ণ হয়েছে। আর তাঁকে কা‘বামুখী হবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কাজেই তোমারা কা‘বার দিকে মুখ কর। তখন তাঁদের চেহারা ছিল শামের (বায়তুল মুকাদ্দাসের) দিকে। একথা শুনে তাঁরা কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
সহীহুল বুখারী, পৰ্ব ৮। সালাত, অধ্যায় ৩২, হাঃ ৪০৩; মুসলিম, পর্ব ৫ মসজিদ ও সালাতের স্থানসমূহের বর্ণনা, অধ্যায় ২, হাঃ ৫২৬
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ)
আসুন মুসলিম পণ্ডিত ইবন কায়্যিম আল-জাওযিয়্যা কর্তৃক রচিত যাদুল মা’আদ গ্রন্থ থেকে এই বিষয়ে কী বলা আছে দেখে নেয়া যাক [2] –
১৬/১৭ মাসের এই কিবলা পরিবর্তন, এরপরে ইহুদিদের কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে আবার কাবার দিকে মুখ ফেরানো, এগুলো যে ইহুদিদের আকৃষ্ট করার জন্য করা হয়েছিল, তাফসীরে তা খুব সরাসরিই বলা আছে। প্রথমে আমরা তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআন থেকে পড়ি। উল্লেখ্য, মুহাম্মদ শফি বিন মুহাম্মাদ ইয়াসিন উসমানি দেওবন্দি বা মুফতি মুহাম্মদ শফি ছিলেন পাকিস্তানের দেওবন্দি ধারার বিখ্যাত সুন্নি ইসলামি পণ্ডিত। তিনি একজন হানাফী আইনজ্ঞ এবং মুফতি। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান মুফতিও ছিলেন। তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআন সারা পৃথিবীতেই একটি অত্যন্ত বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ হিসেবে গণ্য [3]
পুরো বিষয়টি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তাফসীরে জালালাইনেও [4] [5] –
প্রায় প্রতিটি প্যাগান প্রথাকে ইসলামে অন্তর্ভূক্ত করতে মুহাম্মদ আরবে প্রচলিত নানা উপকথার সাথে মিলিয়ে নিজের উদ্ভাবিত নানা গল্পের সৃষ্টি করেছিল। যেখানে ইব্রাহিম বলে কেউ ছিল বা সে মক্কায় এসেছিল এরকম কোন বাস্তব প্রমাণই পাওয়া যায় না, সেখানে মুহাম্মদের প্রচারিত গল্পে ইব্রাহিমকে মক্কায় এসে কাবার পুনঃনির্মাণ করেছিল বলে দাবী করা হয়। সেই সাথে, নিজেকে ইসমাইলের বংশধর দাবী করার মধ্যেও তার ইহুদিদের নবী হওয়ার বাসনা প্রকাশ পায়। প্রাচীন প্যাগান ধর্মগুলোর নানা অনুষ্ঠান, প্রথা নিয়ে খানিকটা অনুসন্ধান করলেই দেখা যায়, হজ্বের পুরো অনুষ্ঠানই প্যাগান ধর্মগুলো থেকে ইসলামীকরণের মাধ্যমে নেয়া।
সবচাইতে ভয়াবহ যেই বিষয়টা ছিল, সেই মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে হারিয়ে গিয়েছিল হাজার বছরের আরবের সংস্কৃতি, সভ্যতা, আচার অনুষ্ঠান। মক্কা বিজয়ের পরে কাবায় একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় মুহাম্মদ এবং ইসলামের। নষ্ট করা হয় শত শত বছরের আরব শিল্পকলা , সাহিত্য, কবিতা, ক্রমশ নিষিদ্ধ করা হয় সংগীত, অন্যান্য সকল ধর্মকেই। এমনকি, পুরনো বই পুস্তকও ধ্বংস করা হয় ইসলাম অবমাননার দায়।
তথ্যসূত্র
- ইসলামি শরিয়া রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার [↑]
- মুখতাসার যাদুল মাআদ, আল্লামা ইমাম ইবনে কাইয়্যিম জাওজিয়্যা, ওয়াহিদীয়া ইসলামিয়া লাইব্রেরি, পৃষ্ঠা ২৩৩ [↑]
- তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১২ [↑]
- তাফসীরে জালালাইন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৪ [↑]
- তাফসীরে জালালাইন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০১ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"