33.নবীর প্রতি লাল চাদর চুরির অভিযোগ

ইসলামের ইতিহাসে নবী মুহাম্মদকে সর্বোচ্চ সততার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামিস্টগণ প্রায়শই দাবী করেন, এমনকি আরবের কাফেররাও নাকি চোখ বন্ধ করে নবীকে বিশ্বাস করতেন। “আল-আমিন” বা “বিশ্বস্ত” উপাধি তার সততার প্রমাণ হিসেবে তারা দীর্ঘদিন ধরে উল্লেখ করে আসছে। তবে, কিছু ঐতিহাসিক দলিল ও হাদিসে এমন অভিযোগের আভাস পাওয়া যায় যেখানে নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে বদর যুদ্ধের গনিমতের মাল থেকে একটি নকশী করা লাল চাদর চুরির সন্দেহ প্রকাশিত হয়েছে। যদিও অভিযোগটি প্রমাণিত নয়, কারণ এরপরেই নবীর ফেইক আইডি আল্লাহ নবীর পক্ষে উকালতি করে আয়াত নাজিল করে, এবং নবী যে আসলে চোর না তা সাহাবীদের জানিয়ে দেয়। তবুও এর অস্তিত্ব কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে যা নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

অভিযোগের প্রেক্ষাপট

আসুন শুরুতেই এই সম্পর্কিত আয়াতটি পড়ে নেয়া যাক, [1]

কোন নাবী খিয়ানাত করতে পারে না, যে ব্যক্তি খিয়ানাত করবে, সে খিয়ানাতকৃত বস্তুসহ ক্বিয়ামাতের দিন উপস্থিত হবে, অতঃপর প্রত্যেককে যা সে অর্জন করেছে তা পুরোপুরি দেয়া হবে, কারও প্রতি কোন প্রকার যুলম করা হবে না।
— Taisirul Quran
আর কোন নাবীর পক্ষে কোন বিষয় গোপন করা শোভনীয় নয়; এবং যে কেহ গোপন করবে তাহলে সে যা গোপন করেছে তা উত্থান দিনে আনয়ন করা হবে; অনন্তর প্রত্যেক ব্যক্তি যা অর্জন করেছে তা পূর্ণরূপে প্রদত্ত হবে এবং তারা নির্যাতিত হবেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর কোন নবীর জন্য উচিত নয় যে, সে খিয়ানত করবে। আর যে খিয়ানত করবে, কিয়ামতের দিনে উপস্থিত হবে তা নিয়ে যা সে খিয়ানত করেছে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুরোপুরি দেয়া হবে যা সে উপার্জন করেছে এবং তাদেরকে যুলম করা হবে না।
— Rawai Al-bayan
আর কোনো নবী ‘গলুল’ [১] (অন্যায়ভাবে কোনো বস্তু গোপন) করবে, এটা অসম্ভব। এবং কেউ অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করলে, যা সে অন্যায়ভাবে গোপন করবে কেয়ামতের দিন সে তা সাথে নিয়ে আসবে [২]। তারপর প্রত্যেককে যা সে অর্জন করেছে তা পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হবে। তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না [৩]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

এবারে আসুন একটি হাদিস পড়ি,

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
২৫/ কুরআনের কিরআত ও পাঠের নিয়ম
পরিচ্ছেদঃ কুরআনের কিরআত ও পাঠের নিয়ম
৩৯৭১ ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, ’’আর নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে, তিনি খিয়ানাত করবেন।’’ এই আয়াত বদরের যুদ্ধের সময় অবতীর্ণ হয়েছে, বদরের যুদ্ধের সময় একটা লাল চাঁদর হারিয়ে গেলে কতিপয় লোক বলাবলি করলো, সম্ভবত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিয়েছেন। তখন আল্লাহ এ আয়াত অবতীর্ণ করলেনঃ ’’আর নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে, তিনি খিয়ানাত করবেন। অথচ যে ব্যক্তি খিয়ানাত করবে সে খিয়ানাতকৃত বস্তুসহ কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কৃতকর্মের পূর্ণ বিনিময় পাবে এবং তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করা হবে না।’’ (সূরা আল-ইমরানঃ ১৬১)। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেন, ’ইয়াগুলু’ শব্দের ইয়া-তে যবর হবে।[1]
সহীহ।
[1]. তিরমিযী। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ এই হাদসিটি হাসান গরীব।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)

এবারে আসুন তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে জালালাইন এবং তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে এই আয়াতটির তাফসীর থেকে একটি অংশ দেখে নিই, [2] [3] [4]

লাল
লাল 1
লাল 3

এ থেকে আমরা জানতে পারলাম, বদর যুদ্ধের পর লুটের মাল ভাগ-বন্টন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় এবং নবীর বিরুদ্ধে চাদর চুরির অভিযোগ তোলা হয়। যদিও ইসলামী বর্ণনায় শেষ পর্যন্ত নবীকে নির্দোষ প্রমাণিত করা হয়, কিন্তু এই অভিযোগটি নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দেয়: যদি তিনি সততার সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিলেন বলে সেই সময়ের কাফেরদের কাছে আল আমীন বলে গণ্য হয়ে থাকেন, তবে কেন খোদ নবীর সাহাবীদের পক্ষ থেকেই এমন অভিযোগ উঠল? সাধারণভাবে, একজন অত্যন্ত সৎ ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে চুরি বা অনৈতিক আচরণের অভিযোগ সহজে উঠে আসে না, কারণ তার চারপাশের মানুষ তার সততায় সম্পূর্ণ আস্থাশীল থাকে। এই অভিযোগের অর্থ দাঁড়ায় যে, কমপক্ষে কিছু মানুষের মনে তখনও তার সততা নিয়ে সন্দেহ ছিল। এ প্রশ্নটি ইতিহাসের পাঠকদের ভাবতে বাধ্য করে যে, আসলেই কি নবীর সততা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতো না? দেখা যাচ্ছে, তার সততা নিয়ে খোদ সাহাবীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠতো।

লাল চাদর পরিধানের বিতর্ক

অভিযোগের আরেকটি জটিল দিক হলো নবীর লাল নকশাঙ্কিত চাদর পরার প্রসঙ্গ। বহু হাদিসে দেখা যায়, তিনি নকশা করা লাল চাদর পরিধান করেছেন। অনেকগুলো হাদিসেই এরকম বর্ণনা পাওয়া যায়, যা থেকে বোঝা যায়, লাল চাদরটি নিশ্চিতভাবেই নবীর খুব প্রিয় ছিল। নবী সেই লাল চাদরটি কোথায় পেয়েছিলেন তা অবশ্য জানা যায় না।

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পরিচ্ছেদঃ ২০৭৩. নবী করীম (ﷺ) সম্পর্কে বর্ণনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৩২৯৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৫৫১
৩২৯৯। হাফ্‌সা ইবনু ’উমর (রহঃ) … বারা ইবনু ’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝারি গড়নের ছিলেন। তাঁর উভয় কাঁধের মধ্যবর্তী স্থান প্রশস্ত ছিল। তাঁর মাথার চুল দুই কানের লতি পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। আমি তাঁকে লাল ডোরাকাটা জোড় চাঁদর পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। তাঁর চেয়ে অধিক সুন্দর কাউকে আমি কখনো দেখিনি। ইউসুফ ইবনু আবূ ইসহাক তাঁর পিতা থেকে হাদীস বর্ণনায় বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ বারা’আ ইবনু আযিব (রাঃ)

সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৪। সালাত (নামায)
পরিচ্ছেদঃ ৪৭. সালাত আদায়কারীর সামনে সুতরাহ্ (আড়াল) দেয়া
হাদিস একাডেমি নাম্বারঃ ১০০৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫০৩
১০০৬-(২৪৯/৫০৩) আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ ও যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ) ….. আওন ইবনু আবূ জুহাইফাহ (রাযিঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি (জুহাইফাহ) বলেন, আমি মক্কায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে আসলাম। তিনি তখন আব্‌তাহ (মুহাসসাব) নামক স্থানে লাল চামড়ার তৈরি একটি তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। রাবী বলেন, বিলাল (রাযিঃ) তার উয়ুর পানি নিয়ে আসলেন। কেউ পানি পেল, কেউ পেল না- সে অন্যের কাছ থেকে সামান্য নিয়ে নিল*। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বের হয়ে আসলেন। তার গায়ে লাল রং এর চাঁদর শোভা পাচ্ছিল। আমি যেন তার পায়ের গোছার শুভ্রতা এখনো দেখতে পাচ্ছি। তিনি ওযু করলেন এবং বিলাল (রাযিঃ) আযান দিলেন। আমি তার (বিলালের) অনুসরণ করে এদিকে-ওদিক মুখ ঘুরাতে লাগলাম। সে ডানে বায়ে মুখ ঘুরিয়ে “হাইয়্যা আলাস সলাহ” ও “হাইয়্যা ’আলাল ফালাহ” বলল। রাবী বলেন, অতঃপর একটি বর্শা দাঁড় করিয়ে পুতে দেয়া হলো। তিনি সামনে অগ্রসর হয়ে যুহরের দু’রাকাআত (ফরয) সালাত আদায় করলেন। তার (সুত্রার) সামনে দিয়ে গাধা, কুকুর ইত্যাদি যাচ্ছিল কিন্তু তিনি বাধা দিলেন না। অতঃপর তিনি ’আসরের ফরয সালাতও দু’রাকাআত পড়লেন। মদীনায় ফিরে আসার সময় পর্যন্ত তিনি এভাবে দু’রাকাআত করে সালাত আদায় করেছেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০০০, ইসলামিক সেন্টারঃ ১০১১)
* নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওযুর ব্যবহার করা পানি সাহাবাগণ বারাকাত স্বরূপ ব্যবহার করতেন। সেটারই প্রতিযোগিতা ছিল এটা।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আওন ইবনু আবূ জুহাইফাহ (রহঃ)

সুনান আবূ দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২৭/ পোশাক-পরিচ্ছদ
পরিচ্ছেদঃ ১৮. লাল রং ব্যাবহারের অমুমতি।
৪০২৯. মুসাদ্দাদ (রহঃ) …. হিলাল ইবন আমির (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন একবার আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিনাতে খচ্চরের পিঠ হতে খুতবা দেওয়ার সময় তাঁর গায়ে একটি লাল রঙের চাদর দেখি। এ সময় আলী (রাঃ) তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তা লোকদের কাছে পৌছে দিচ্ছিলেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ হিলাল ইবনু ‘আমির (রহঃ)

মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-২২: পোশাক-পরিচ্ছদ
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
৪৩৬৩-[৬০] হিলাল ইবনু ’আমির (রহঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মিনায় একটি খচ্চরের উপরে বসে খুত্ববাহ্ (ভাষণ) দান করতে দেখেছি। সে সময় তাঁর গায়ে ছিল লাল বর্ণের চাদর, আর ’আলী (রাঃ) তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে লোকেদেরকে তাঁর বক্তব্য শুনাচ্ছিলেন (শুনার ব্যবস্থা করছিলেন)। (আবূ দাঊদ)[1]
[1] সহীহ : আবূ দাঊদ ৪০৭৩, তাহক্বীক মুসনাদে আহমাদ ১৫৯৬২, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৬১৯৬, সুনানুন্ নাসায়ী আল কুবরা ৪০৯৪।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ হিলাল ইবনু ‘আমির (রহঃ)

সহীহ শামায়েলে তিরমিযী
৮. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পোশাক-পরিচ্ছদ
পরিচ্ছেদঃ তিনি লাল রঙ্গের নকশী করা চাদরও পরিধান করতেন:
৪৯. আবু জুহাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লাল নকশী চাদর পরা অবস্থায় দেখেছি। আজও যেন আমি তাঁর উভয় গোড়ালীর ঔজ্জ্বল্য প্রত্যক্ষ করছি।[1]
[1] সহীহ মুসলিম, হা/১১৪৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৭৮১।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সহীহ শামায়েলে তিরমিযী
১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর দৈহিক গঠন
পরিচ্ছেদঃ তিনি ছিলেন পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও চমৎকার :
৭. জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার পূর্ণিমা রাত্রির স্নিগ্ধ আলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লাল চাদর ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম। তখন আমি একবার তাঁর দিকে ও একবার চাদের দিকে তাকাতে থাকলাম। মনে হলো তিনি আমার কাছে পূর্ণিমার চাদের চেয়ে অধিকতর চমৎকার।[1]
[1] মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৭৩৮৩; মারেফাতুস সাহাবা, হা/১৪৩৫; মিশকাত, হা/৫৭৯৪।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

অভিযোগ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইতিহাসের পাঠকরা জানেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও কখনো কখনো অবিশ্বাস বা হিংসা থেকে ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপিত হয়। তবে, নবীর জীবন ও কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। একজন সত্যিকারের ন্যায়পরায়ণ ও সদাচারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের মানে কি তার চারপাশের মানুষদের আস্থার ঘাটতি, নাকি এটি কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক কৌশলের ফল? আমি কোন সিদ্ধান্তে যাচ্ছি না। নবী লাল চাদর চুরি করেছিলেন, এরকমও বলছি না। কারণ সেটি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা এই সময়ে আর সম্ভব না। তবে এটি পরিষ্কার যে, তার বিরুদ্ধে খোদ সাহাবীগণই চুরির অভিযোগ তুলেছিল। এবং একইসাথে, নবী মুহাম্মদের একটি লাল চাদর থাকার বিবরণ পাওয়া যায়, মৃত্যুর সময়ও যেই লাল চাদরটি তার কবরে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। কেন দিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেটি গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। তবে এ উপরের হাদিসগুলো থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, নবীর সম্ভবত খুবই প্রিয় একটি লাল নকশি করা চাদর ছিল। যার কারণে হয়তো মৃত্যুর পরেও সেই চাদরটি তার কবরে দিয়ে দেয়া হয়েছিল! যদিও এত বছর পরে আর এই সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না, কিন্তু অনেক প্রশ্নই জাগে,

সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১২/ জানাযা সম্পর্কিত
পরিচ্ছেদঃ ২৪. কবরে চাদর ব্যবহার
২১১৩। ইয়াহয়া ইবনু ইয়াহহিয়া, আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বা ও মুহাম্মদ ইবনুল মুসান্না (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবরে লাল একটি চাঁদর দেয়া হয়েছিল।
ইমাম মুসলিম (রহঃ) বলেন, রাবী আবূ জামরার নাম নাসর ইবনু ইমরান। আর রাবী আবূ তায়্যাহ এর নাম হল ইয়াযিদ ইবনু হুমায়দ। তাঁরা দু-জন সারাখ্‌স এ মারা যান।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)

সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২১/ জানাজা
পরিচ্ছেদঃ ৮৮/ কবরে কাপড় রাখা
২০১৬। ইসমাঈল ইবনু মাসউদ (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যখন দাফন করা হয়েছিল, তখন তার নীচে একটি লাল চাদরের টুকরা রাখা হয়েছিল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)

মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-৫: জানাযা
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ – মৃত ব্যক্তির দাফনের বর্ণনা
১৬৯৪-[২] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবরে একটি লাল চাদর বিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। (মুসলিম)[1]
[1] সহীহ : মুসলিম ৯৬৭, আত্ তিরমিযী ১০৪৮, নাসায়ী ২০১২, ইবনু আবী শায়বাহ্ ১১৭৫৪, আহমাদ ৩৩৪১, ইবনু হিব্বান ৬৬৩১।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

হিপোক্রেসি বা দ্বিচারিতা

এবারে আসুন সবচাইতে জরুরি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। অসংখ্য হাদিসে যেখানে নবী মুহাম্মদকে লাল রঙ এর একটি চাদর পরিধান করার বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে, যা উপরেই আপনারা দেখলেন, সেই একই নবী লাল রঙ এর চাদর পরিধান করায় একজনার ওপর প্রবল অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সে যেন ঐ চাদরটি আর পরিধান না করে। হিপোক্রেসি কাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কী কই, নবীর জীবন না পড়লে আসলে যেন জানাই সম্ভব নয়। আসুন হাদিসটি পড়ি,

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
২৭/ পোশাক-পরিচ্ছদ
পরিচ্ছেদঃ ১৯. লাল রং ব্যবহার করা
৪০৬৬। আমর ইবনু শু’আইব (রহঃ) থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে একটি টিলা থেকে নামছিলাম। তিনি আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন, তখন আমার পরিধানে ঈশৎ লালের সাথে পীত বর্ণের একটি চাদর ছিলো। তিনি বললেনঃ তোমার গায়ে এ চাদর কেন? আমি তাঁর অসন্তুষ্টি বুঝতে পারলাম এবং বাড়ীতে এসে দেখলাম, পরিবারের লোকজন চুলায় রান্না করছে।
আমি চাদরটা আগুনে ফেলে দিলাম। অতঃপর আমি সকালে তাঁর নিকট আসতেই তিনি প্রশ্ন করলেনঃ হে আল্লাহ বান্দা! তোমার ঐ চাদরটি কি করেছো? আমি তাঁকে বিষয়টি অবহিত করলাম। তিনি বললেন, তুমি বরং সেটা তোমার পরিবারের কোনো নারীকে ব্যবহার করতে দিতে। কেননা নারীদের জন্য এতে কোনো অসুবিধা নেই।[1]
হাসান।
[1]. ইবনু মাজাহ, আহমাদ।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
বর্ণনাকারীঃ আমর ইবনু শু‘আয়ব (রহঃ)

উপসংহার

নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে চাদর চুরির অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও, তার অস্তিত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সত্যকে সামনে আনে: সর্বোচ্চ স্তরের চারিত্রিক সুনাম অর্জন করে থাকলে, সন্দেহ বা প্রশ্ন বা চুরির অভিযোগ ওঠা সম্ভব না। প্রশ্ন থেকে যায়— একদম বদর যুদ্ধে নবীর অনুসারী সাহাবীগণ, যারা ইসলামে সর্বোচ্চ সম্মানিত, সেইসব সাহাবীদের পক্ষ থেকে লাল চাদর চুরির অভিযোগ কীভাবে ওঠে? যদি তিনি সত্যিই অমলিন সততার মূর্ত প্রতীক হতেন, তবে এমন অভিযোগ কখনও ওঠার কথা নয়। আবার, পরবর্তী জীবনে লাল চাদর পরার মতো কর্মকাণ্ডও এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আরও জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করে। এ সমস্ত বিষয় ইসলামের ইতিহাস ও নবীর জীবন নিয়ে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করে।


তথ্যসূত্র

  1. সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৬১ []
  2. তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫২ []
  3. তাফসীরে জালালাইন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৩৮ []
  4. তাফসীরে ইবনে কাসীর, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৫১-৬৫২ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"