ভূমিকা
অনেক মুসলিম হয়তো জানেন না যে নবী মুহাম্মাদের সমসাময়িক সময়ে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও কিছু ব্যক্তি নবী হওয়ার দাবি করেছিলেন। এই দাবিদারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুসাইলিমা বিন হাবিব, সাজাহ বিনতে আল-হারিস, এবং তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ। এদের প্রত্যেকেই নিজেদের নবী বলে ঘোষণা করেন এবং তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেন। নবুয়ত্যের ব্যবসায়ে ভাগীদার চলে আসায় নবী মুহাম্মদ তাদের তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন এবং তাদের নির্মূল করার নির্দেশও দেন। তাদের বেশিরভাগই ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সময়ে মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে পরাজিত হন। শুধুমাত্র মুসলিমদের সাথে শক্তি সামর্থ্যে কুলিয়ে উঠতে না পেরে, তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নতুবা আজকে হয়তো আমাদের ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো।
মুসলিমদের মধ্যে অনেকেই ঐ সকল নবীর বিরুদ্ধে ইসলামের বিজয়কে মুহাম্মদের মোজেজা এবং ইসলামের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে বলার চেষ্টা করেন। আবার সেইসব মুসলিমই কিন্তু নবীর মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, সেই প্রশ্নের জবাবে বলতে থাকেন যে, নবীর বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হওয়া মানে এই নয় যে, তিনি নবী ছিলেন না! তারা তখন এই যুক্তিও দেন যে, ইতিহাসে অনেক নবীই প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়েছিলেন! তাই জয় পরাজয় বা প্রতিপক্ষের হাতে খুন হওয়া নবীত্ব থেকে কাউকে খারিজ করে না। অর্থাৎ উভয় দিক দিয়েই তারা জয়ী। হারলেও ইসলাম জেতে, জিতলে তো জেতেই!
ইসলামী ইতিহাস এবং বিভিন্ন প্রামাণ্য উৎস থেকে আসুন সেইসময়ের নবীর দাবীদারদের কার্যকলাপ ও পরিণতি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
মুসাইলিমা বিন হাবিব
মুসাইলিমা বিন হাবিব ছিলেন বনু হানিফা গোত্রের একজন প্রভাবশালী নেতা এবং নবুওয়াতের দাবিদার। তার জন্ম ইয়ামামা অঞ্চলে হয়েছিল এবং তার গোত্র ছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। মুসাইলিমার পৈতৃক নাম ছিল ইবনে হাবিব আল-হানিফি। তার নবুওয়াতের দাবি নবী মুহাম্মাদ-এর সমসাময়িক সময়েই উদ্ভূত হয়েছিল, এবং তিনি নিজেকে আল্লাহর প্রেরিত নবী বলে দাবি করেছিলেন। তার অনুসারীদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন “রহমানের রাসুল” নামে। মুসাইলিমা সেসময় পূর্ব আরবের একটি বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো। নবী মুহাম্মাদের থেকেও অধিক বৃহৎ অঞ্চল তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী, মুসাইলিমা ৯ম হিজরিতে মদিনায় একটি প্রতিনিধিদলের সাথে উপস্থিত হন। যদিও প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণ করেছিল, মুসাইলিমা ইসলাম গ্রহণ না করে নিজের নবুওয়াতের দাবি করেছিলেন।
তার দেয়া শিক্ষা বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তবে দাবেস্তান-এ-মাজাহেব নামক গ্রন্থে [1] সেগুলোর নিরপেক্ষ বর্ণনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সে মদ ও শুঁকরের মাংস খেতে নিষেধ করতো, যে কোন দিকে মুখ করে দৈনিক তিনবার ঈশ্বরের উপাসনা করার নির্দেশ দিতো, রমজানের রাতে রোজা রাখার নির্দেশ দিতো এবং খাতনা করাকে অনাবশ্যক বলতো। সেই আল্লাহর বানী মানুষের মধ্যে প্রচার করতো, তার একটি বানীর উদাহরণ হচ্ছে,
“আল্লাহ গর্ভবতী মহিলাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন কেননা তিনি তাদের পেট থেকে চলাচল করতে সক্ষম মানুষ বের করেছেন – নাড়ীভুঁড়ি ও তরল পদার্থের মধ্য থেকে।”
ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসে ইয়ামামার যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী এবং মুসাইলিমার অনুসারীদের মধ্যে লড়াই হয়, যা ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে মুসাইলিমা নিহত হন এবং মুসলিম বাহিনী বিজয় অর্জন করে। ইসলামের ইতিহাসে মুসাইলিমাকে “মুসাইলিমা আল-কাজ্জাব” (মিথ্যাবাদী মুসাইলিমা) বলা হয়, যা তার মিথ্যা নবুওয়াতের দাবির প্রতি একটি ইঙ্গিত। [2]
সাজাহ বিনতে আল-হারিস
সাজাহ বিনতে আল-হারিস ছিলেন একজন নারী যিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করেছিলেন। তিনি তাগলিব গোত্রের নারী ছিলেন এবং তার অনুসারীরা তাকে একজন নবী হিসেবে মান্য করত। সাজাহ ইসলাম গ্রহণ না করে তার নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার করেছিলেন। মুহাম্মাদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর সাজাহ নিজেকে নবী হিসেবে ঘোষণা দেন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। পরবর্তীতে, সাজাহ মুসাইলিমার সাথে একজোট হয়ে তাকে বিয়ে করেন, যার মাধ্যমে তিনি তার প্রভাব আরও বাড়ানোর চেষ্টা করেন।
মুসাইলিমার মৃত্যুর পর সাজাহর প্রভাব দ্রুত হ্রাস পায়। ইতিহাস অনুযায়ী, সাজাহ পরবর্তীতে ইসলামের শাসকদের হাতে আত্মসমর্পণ করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ইসলামী সমাজের সাথে একীভূত হয়ে জীবনের বাকি অংশ কাটান। [3]
তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ
তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ ছিলেন আরেকজন যিনি নবী হওয়ার দাবি করেছিলেন। তিনি আসাদ গোত্রের নেতা ছিলেন এবং তার অনুসারীরা তাকে নবী হিসেবে পূজা করত। ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি প্রথমে নবুওয়াতের দাবি করেছিলেন। তবে তার বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকরের (রা.) অধীনে একাধিক যুদ্ধে লিপ্ত হন। বুজাখার যুদ্ধ ছিল সেই সব লড়াইয়ের অন্যতম, যেখানে তুলায়হা মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে পরাজিত হন।
তুলায়হা পরবর্তীতে আবার ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামী শাসনের অধীনে তার জীবনের বাকি সময় অতিবাহিত করেন। তার পুনরায় ইসলাম গ্রহণের ঘটনা ইসলামী ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। ইসলামের প্রথম যুগের এই ধরনের ঘটনাগুলি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। [4]
উপসংহার
ইসলামের ইতিহাসে নবী মুহাম্মাদের সময়ে এবং তার মৃত্যুর পরও কিছু ব্যক্তি নবী হওয়ার দাবি করেছিলেন। যদিও এদের বেশিরভাগই ইসলামের প্রাথমিক যুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে পরাজিত হন, তাদের বিদ্রোহ এবং নবুওয়াতের দাবি ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। [2], [3], [4].
তথ্যসূত্র
- “The DABISTÁN, or SCHOOL OF MANNERS”। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুলাই ২০১৫ [↑]
- Ibn Hisham, Sirat Rasul Allah, Vol. 2, p. 546[↑][↑]
- Tabari, History of the Prophets and Kings, Vol. 10, p. 23[↑][↑]
- Ibn Kathir, Al-Bidaya wa’l-Nihaya, Vol. 6, p. 322[↑][↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"