সহবাসের পূর্বে তালাক ও ইদ্দত
কোরআনের বিধান অনুসারে, সহবাসের পূর্বে তালাক দিলে ইদ্দতের বিধান নেই। শুরুতেই এই সম্পর্কিত আয়াতটি দেখে নিই [1] –
হে মুমিনগণ, যখন তোমরা মুমিন নারীদেরকে বিবাহ করবে অতঃপর তাদের সাথে সহবাসের পূর্বেই তালাক দিয়ে দেবে তবে তোমাদের জন্য তাদের কোন ইদ্দত নেই যা তোমরা গণনা করবে। সুতরাং তাদেরকে কিছু উপহার সামগ্রী প্রদান কর এবং সুন্দরভাবে তাদেরকে বিদায় দাও।
এবারে সুরা তালাকের ৪ নম্বর আয়াতটি পড়ি, যেখানে বলা আছে, যেসব স্ত্রী এখনো ঋতুর বয়সে পৌঁছে নি, তাদের ইদ্দত হবে তিনমাস [2] –
যে সব তালাকপ্রাপ্তারা বয়সের কারণে মাসিক থেকে নিরাশ হয়েছে তাদের ইদ্দতের ব্যাপারে যদি তোমরা সন্দিহান হও তাহলে তাদের মেয়াদ তিন মাস বলে গণ্য হবে। তেমনিভাবে যারা ছোট থাকার ফলে মাসিকের বয়সে উপনীত হয় নি তাদের ইদ্দতও তিন মাস। আর গর্ভবতীদের তালাক কিংবা স্বামীর মরণোত্তর ইদ্দত হলো সন্তান প্রসব। বস্তুতঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মান্য করার মাধ্যমে তাঁকে ভয় করে তিনি তার সকল বিষয় ও সমস্যা সহজ করে দেন।
— Bengali Mokhtasar
তোমাদের যে সব স্ত্রীগণ মাসিক ঋতু আসার বয়স অতিক্রম করেছে তাদের (‘ইদ্দাতের) ব্যাপারে যদি তোমাদের সন্দেহ সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে তাদের ‘ইদ্দাতকাল তিন মাস, আর যারা (অল্প বয়স্কা হওয়ার কারণে) এখনও ঋতুবতী হয়নি (এ নিয়ম) তাদের জন্যও। আর গর্ভবতী স্ত্রীদের ‘ইদ্দাতকাল তাদের সন্তান প্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন।
— Taisirul Quran
তোমাদের যে সব স্ত্রীর ঋতুমতী হওয়ার আশা নেই তাদের ইদ্দাত সম্পর্কে তোমরা সন্দেহ করলে তাদের ইদ্দাতকাল হবে তিন মাস এবং যাদের এখনও রজশ্বালা হয়নি তাদেরও। এবং গর্ভবতী নারীদের ইদ্দাতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার সমস্যার সমাধান সহজ করে দিবেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যারা ঋতুবর্তী হওয়ার কাল অতিক্রম করে গেছে, তাদের ইদ্দত সম্পর্কে তোমরা যদি সংশয়ে থাক এবং যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি তাদের ইদ্দতকালও হবে তিন মাস। আর গর্ভধারিনীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।
— Rawai Al-bayan
তোমাদের যে সব স্ত্রী আর ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই [১] তাদের ইদ্দত সম্পর্কে তোমরা সন্দেহ করলে তাদের ইদ্দতকাল হবে তিন মাস এবং যারা এখনো ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি তাদেরও; আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। আর যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ্ তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
তাহলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, যারা ঋতুর বয়সে পৌঁছে নি, তাদের যেহেতু ইদ্দতের কথা বলা আছে, তাই অবশ্যই সহবাসের অনুমতিও দেয়া আছে। নইলে ইদ্দতের নির্দেশই থাকতো না। কারণ সহবাস ছাড়া তো ইদ্দতের প্রয়োজনই নেই।
তাফসীরে ইবনে কাসীর
তাফসীরে ইবনে কাসীরে বলা হয়েছে, অপ্রাপ্তবয়ষ্কা মেয়ের কথা [3] –
তাফসীরে জালালাইন
তাফসীরে জালালাইনেও বলা হয়েছে, অপ্রাপ্তবয়ষ্কতার কারণে যে সব মেয়ে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছায় নি, তাদের কথা [4] –
অর্থাৎ, যারা ঋতুর বয়সে পৌঁছে নি, বা অপ্রাপ্তবয়সী মেয়ে, তাদের ইদ্দতকাল তিনমাস।
তাফসীরে মাযহারী
কাজী মুহাম্মদ ছানাউল্লাহ পানিপথী একজন বিখ্যাত ইসলামিক পন্ডিত, যার লিখিত তাফসীর গ্রন্থের নাম তাফসীরে মাযহারী। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের একজন কাজী (বিচারপতি), মুহাদ্দিস, গবেষক ও বিশিষ্ট মুফাসসির তথা আল-কোরআনের ভাষ্যকার। এবারে সেই তাফসীরে মাযহারী [5] থেকে দেখে নিইঃ
মা’আরেফুল কোরআন
তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের বংশধর মুফতী মুহাম্মদ শফি উসমানী ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও মনীষী । তিনি দারুল উলূম দেওবন্দ এবং দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের মুফতীয়ে আযম বা প্রধান মুফতী (গ্রান্ড মুফতী) ছিলেন। তার বিশ্বখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “মা’আরিফুল কুরআন” বহু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এবারে আসুন মা’আরেফুল কোরআনে দেখি [6] –
তাফহীমুল কুরআন
প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ইসলামে অবদান রাখার জন্যে তাকে ১৯৭৯ সালে বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান [7]। । শুধু তাই নয়, উনি হচ্ছেন আধুনিক সময়ের সবচাইতে প্রসিদ্ধ ইসলামিক স্কলার। একইসাথে, উনি ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি, যার গায়েবানা জানাজা পড়ানো হয়েছিল কাবা শরীফে [8]। এর অর্থ হচ্ছে, উনার লিখিত তাফসীর সারা পৃথিবীতেই প্রসিদ্ধ। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর তাফহীমুল কুরআন গ্রন্থে সূরা তালাকের এই আয়াতের ব্যাখ্যাতে যা লেখা রয়েছে [9] –
তাওযীহুল কুর’আন
পাকিস্তানের প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার আল্লামা মুহাম্মদ তাকী উসমানির কথা আশাকরি বাঙলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের অধিবাসী সকল মুসলিমই অবগত আছেন। বিচারপতি মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকি উসমানি (জন্ম: ১৯৪৩) পাকিস্তানের একজন প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব। তিনি হাদীস, ইসলামী ফিকহ, তাসাউফ ও অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন [10]। উনার লিখিত কোরআনের তাফসীর তাওযীহুল কুরআনে এই আয়াতের কী ব্যাখ্যা দেয়া আছে, সেটি দেখে নিই [11] –
আহকামুল কুরআন
হানাফী মাজহাবের প্রখ্যাত ইমাম আহমাদ ইবনে আলী আবূ বকর আর-রায়ী আল-যাস্সাস রচিত আহকামুল কুরআন গ্রন্থেও একই বিষয় দেখতে পাওয়া যায় [12] –
আরো পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে একই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে যে, এই বিষয়ে পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকল আলেমের ঐক্যমত্য রয়েছে যে, সমস্ত অভিভাবকের জন্য অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মেয়েকে বিবাহ দেয়া ইসলামে সম্পূর্ণ জায়েজ। এই বিষয়ে পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আলেমদের ঐক্যমত্য বা ইজমা রয়েছে [13] –
আলোচ্য আয়াতে এ কথারও প্রমাণ রয়েছে যে, পিতার জন্যে তার ছোট বয়সের কন্যাকে বিয়ে দেয়ার অধিকার আছে এ হিসেবে যে, সমস্ত অভিভাবকের জন্যেই তা জায়েয। আর পিতা তাদের সকলের তুলনায় অতি নিকটবর্তী অভিভাবক। আর বিভিন্ন দেশের আগের ও পরবর্তীকালের ফিকাহবিদদের মধ্যে তার জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য আছে বলে আমরা জানি না। তবে বশর ইবনুল অলীদ শিবরামাতা থেকে বর্ণনা প্রচার করেছেন যে, ছোট বয়সের ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেয়া পিতার জন্যেও জায়েয নয়। এটা আল – আস্সাম – এর মাযহাব। এ মাযহাব যে বাতিল, তা আমরা ইতিপূর্বেই বলেছি। তাছাড়া এ আয়াতটিও এ মাযহাবের বাতুলতা প্রমাণ করে।
বোখারী শরীফ
ইমাম বুখারীর বুখারী শরীফ গ্রন্থে পরিষ্কারভাবেই সূরা তালাকের চার নম্বর আয়াতের অর্থ বলে দেয়া হয়েছে [14] [15]
সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
৬৭/ বিয়ে
পরিচ্ছেদঃ ৬৭/৩৯. কার জন্য ছোট শিশুদের বিয়ে দেয়া বৈধ।
لِقَوْلِهِ تَعَالَى: وَاللاَّئِي لَمْ يَحِضْنَ) فَجَعَلَ عِدَّتَهَا ثَلاَثَةَ أَشْهُرٍ قَبْلَ الْبُلُوغِ
আল্লাহ্ তা‘আলার কালাম ‘‘এবং যারা ঋতুমতী হয়নি’’-(সূরাহ আত-ত্বলাক (তালাক): ৪) এই আয়াতকে দলীল হিসাবে ধরে নাবালেগার ইদ্দাত তিন মাস নির্ধারণ করা হয়েছে।
৫১৩৩. ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁকে বিয়ে করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৬ বছর এবং নয় বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গে বাসর ঘর করেন এবং তিনি তাঁর সান্নিধ্যে নয় বছরকাল ছিলেন। (৩৮৯৪)(আধুনিক প্রকাশনী- ৪৭৫৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৭৫৭)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)
বোখারীর ব্যাখ্যা
এর আরো প্রমাণ পাওয়া যায় বোখারী শরীফের ব্যাখ্যায় [16] থেকে-
ফিকাহ শাস্ত্র আল হিদায়া গ্রন্থ
ইমাম আবু হানিফার মাজহাবের প্রখ্যাত ফিকাহ গ্রন্থ আল হিদায়াতে এই বিষয়ে যা বলা আছে সেটিও দেখে নিই [17] –
ফিকাহ শাস্ত্র আশরাফুল হিদায়া
হানাফি ফিকাহশাস্ত্রে আশরাফুল হিদায়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী কর্তৃক নির্দেশিত এবং বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত আলেমের অনুদিত আশরাফুল হিদায়া গ্রন্থে এই বিষয়ে কী বলা আছে সেটি দেখে নিই [18] –
তথ্যসূত্র
- সুরা ৩৩:৪৯ [↑]
- সুরা ৬৫:৪ [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর, একাদশ খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ১৬৩ [↑]
- তাফসীরে জালালাইন, ষষ্ঠ খণ্ড, ইসলামিয়া কুতুবখানা, পৃষ্ঠা ৫৮৮ [↑]
- তাফসীরে মাযহারী, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ৫৬২, ৫৬৩ [↑]
- মা’আরেফুল কোরআন, খণ্ড ৮ এর ৪৮১, ৪৮৩ নম্বর পৃষ্ঠা [↑]
- “King Faisal Prize” (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-০৫[↑]
- Adams, Charles J. (1983). “Maududi and the Islamic State”. In Esposito, John L. (ed.). Voices of Resurgent Islam. Oxford University Press. ISBN 9780195033403 [↑]
- তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী [↑]
- “Muhammad Taqi Usmani”। The Muslim 500 (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-২৪। [↑]
- তাফসীরে তাওযীহুল কুরআনে, মুফতি মুহাম্মদ তাকী উসমানি, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬৭ [↑]
- আহকামুল কুরআন, ইমাম আহমাদ ইবনে আলী আবূ বকর আর-রায়ী আল-যাস্সাস, অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, খায়রুন প্রকাশনী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৫ [↑]
- আহকামুল কুরআন, ইমাম আহমাদ ইবনে আলী আবূ বকর আর-রায়ী আল-যাস্সাস, অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, খায়রুন প্রকাশনী, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩১ [↑]
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নম্বরঃ ৫১৩৩ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৭৫৭ [↑]
- বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা ও ব্যাখ্যা), খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৯৬-১৯৭ [↑]
- আল হিদায়া, দ্বিতীয় খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ২০১ [↑]
- আশরাফুল হিদায়া, তৃতীয় খণ্ড, মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী, ইসলামিয়া কুতুবখানা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৫৭৬ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"