08.ইসলামে বৈবাহিক ধর্ষণের অনুমোদন

আধুনিক সভ্য সমাজে নারীরা পুরুষের মতোই সমান অধিকার ভোগ করেন। তারা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্ব এবং সমাজসেবার ক্ষেত্রে পুরুষের সমানভাবে অংশগ্রহণ করছেন। আধুনিক সমাজে এরকম ঘটনা অসংখ্য, যেখানে স্বামী তার স্ত্রীর ইচ্ছা ও অনুমতি ছাড়াই তার সাথে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্কে করে বা স্ত্রীকে তা করতে বাধ্য করে। আধুনিক সভ্য সমাজে এটি ধর্ষণ হিসেবে গণ্য, যদিও ইসলামিক দেশগুলোতে স্বামীকে এই ধর্ষণের বৈধতা দেয়া হয়। ইসলাম ধর্ম অনুসারে, স্বামীর চাহিবা মাত্রই তার সাথে স্ত্রী যৌন কাজ করতে বাধ্য, এরকম আইন আরোপ করে। যা বৈবাহিক ধর্ষণের মত মারাত্মক এবং ভয়াবহ ঘটনার জন্য দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসুন কিছু আলেমের বক্তব্য শুনে নিই,

এবারে আসুন এই সম্পর্কে হাদিসে কী বলা আছে তা পড়ে নিই,

সুনানে ইবনে মাজাহ
তাওহীদ পাবলিকেশন
অধ্যায়ঃ ৯/ বিবাহ
২/১৮৫৩। ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু আবূ আওফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুআয (রাঃ) সিরিয়া থেকে ফিরে এসে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে সাজদাহ করেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ হে মু‘আয! এ কী? তিনি বলেন, আমি সিরিয়ায় গিয়ে দেখতে পাই যে, তথাকার লোকেরা তাদের ধর্মীয় নেতা ও শাসকদেরকে সাজদাহ করে। তাই আমি মনে মনে আশা পোষণ করলাম যে, আমি আপনার সামনে তাই করবো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা তা করো না। কেননা আমি যদি কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ্ ছাড়া অপর কাউকে সাজদাহ করার নির্দেশ দিতাম, তাহলে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সাজদাহ করতে। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! স্ত্রী তার স্বামীর প্রাপ্য অধিকার আদায় না করা পর্যন্ত তার প্রভুর প্রাপ্য অধিকার আদায় করতে সক্ষম হবে না। স্ত্রী শিবিকার মধ্যে থাকা অবস্থায় স্বামী তার সাথে জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে চাইলে স্ত্রীর তা প্রত্যাখ্যান করা অনুচিত।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
It was narrated that: Abdullah bin Abu Awfa said “When Muadh bin Jabal came from Sham, he prostrated to the Prophet who said: ‘What is this, O Muadh?’ He said: ‘I went to Sham and saw them prostrating to their bishops and patricians and I wanted to do that for you.’ The messenger of Allah said: ‘Do not do that. If I were to command anyone to prostrate to anyone other than Allah, I would have commanded women to prostrate to their husbands. By the One in Whose Hand is the soul of Muhammad! No woman can fulfill her duty towards Allah until she fulfills her duty towards her husband. If he asks her (for intimacy) even if she is on her camel saddle, she should not refuse.’ ”

মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পাবলিশারঃ হাদিস একাডেমি
অধ্যায়ঃ পর্ব-১৩ঃ বিবাহ
পরিচ্ছদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ – স্ত্রীদের সাথে সদ্ব্যবহার এবং তাদের প্রত্যেকের (স্বামী-স্ত্রীর) পারস্পরিক হক ও অধিকার সংক্রান্ত
৩২৫৫-(১৮) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি যদি কোনো মানবকে সিজদা করার নির্দেশ দিতাম, তবে স্ত্রীকে তার স্বামীর জন্য সিজদা করার নির্দেশ দিতাম। (তিরমিযী)
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

আসুন সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ থেকে একটি পাতা পড়ে নিই, যেখানে বলা, স্বামীর বিছানা পরিত্যাগ করা স্ত্রীর জন্য হারাম অর্থাৎ স্বামী বিছানায় ডাকা মাত্রই স্ত্রীর সেই ডাকে সাড়া দেয়া অবশ্য কর্তব্য [1]

বৈবাহিক

আসুন এই একই হাদিস রিয়াদুস সালেহীন গ্রন্থ থেকে পড়ি, [2]

বৈবাহিক 1

এই হাদিসগুলো এবং হাদিসের ব্যাখ্যাগুলোতে মূলত বলা হয়েছে যে, নারীর কর্তব্য হলো স্বামীর চাহিদা পূরণ করা, এমনকি স্বামী যদি যৌন চাহিদা প্রকাশ করেন এবং স্ত্রী এতে সাড়া না দেন, তবে সেটা স্ত্রীর পক্ষ থেকে চরম অন্যায় এবং ভয়াবহ পাপের কাজ। অনেকগুলো হাদিসে বলা হয়েছে যে, যদি আল্লাহর পরে কাউকে সিজদা করার নির্দেশ দেওয়া হতো, তবে সেটি স্ত্রীকে তার স্বামীকে করার নির্দেশ দেওয়া হতো। এটি নারীর প্রতি এমন একটি মানসিকতা তৈরি করে যে, তিনি তার স্বামীর সম্পত্তি, এবং তার কাজ হলো শুধু স্বামীর চাহিদা ও ইচ্ছার পূরণ করা, নিজের ইচ্ছার বা সম্মতির কোনো মূল্য নেই। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নারীর প্রতি এক চরম বৈষম্যমূলক এবং অসম্মানজনক মনোভাবের প্রতিফলন।

এই হাদিসে আরও বলা হয়েছে, স্ত্রীর নিজের প্রভুর প্রতি কর্তব্য পূরণ করার মতই তার স্বামীর চাহিদা পূরণ করতে হবে। এটি নারীর নিজস্ব আত্মমর্যাদাকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে এবং তাকে স্বামীর সেবাদাসী হিসেবে বিবেচনা করে। এই হাদিস নারীর ইচ্ছা, স্বাধীনতা, মতামত এবং সম্মানের প্রতি কোনো গুরুত্ব দেয় না এবং তাকে পুরুষের অধীনস্থ ও নিয়ন্ত্রিত রাখার নির্দেশ দেয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, প্রত্যেক ব্যক্তি তার শরীরের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার রাখে এবং কারও জোরপূর্বক বা চাপের মুখে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করানো মানবাধিকার লঙ্ঘন। জাহান্নামের ভয়ভীতি দেখিয়ে কোন নারীকে ধর্ষিত হতে বাধ্য করা চরমভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। জাতিসংঘের “নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ” (CEDAW) নারীর সম্মান, ইচ্ছা ও মতামতকে সম্মান করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু ইসলামের এই হাদিস নারীর ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে তাকে শুধুমাত্র স্বামীর যৌন চাহিদা পূরণের একটি বস্তু হিসেবে বিবেচনা করে, যা সরাসরি নারীর মৌলিক মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করে।

ইসলামের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, নবী মুহাম্মদ এবং তার সাহাবীগণ আসলে তাদের স্ত্রীদের সম্মতির তেমন কোন গুরুত্বই দিতেন না। যৌন সঙ্গমের বিষয়ে স্বামীর ভূমিকা ছিল প্রভুর মত, আর স্ত্রীর ভূমিকা ছিল দাসীবাঁদীর মত। আসুন তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে একটি ঘটনা জেনে নেয়া যাক, যেখানে দেখা যাচ্ছে নবীর প্রখ্যাত সাহাবী উমর তার ঘুমন্ত স্ত্রীর ওপর চেপে বসে এবং তার অনুমতি বা সম্মতির তোয়াক্কা না করেই সঙ্গমে লিপ্ত হয়। বিষয়টি নবীকে জানাবার পরেও নবী তা নিয়ে কোন কথাই বলেন না, অর্থাৎ সেই সময়ে নবীর কাছে এটিই ছিল খুব স্বাভাবিক বিষয় [3]

বৈবাহিক 3

একজন নারী তার শরীরের অধিকার এবং ইচ্ছার প্রতি সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে। যদি স্বামী তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান এবং স্ত্রী এতে সম্মতি না দেন, তবে সেটি স্ত্রীর মৌলিক অধিকার। সেটি যে কারণেই হোক না কেন। একই কথা প্রযোজ্য পুরুষটির বেলাতেও। কিন্তু এই হাদিসে বলা হয়েছে, “যদি স্বামী স্ত্রীর কাছে শারীরিক চাহিদা প্রকাশ করেন এবং স্ত্রী যদি তা প্রত্যাখ্যান করেন, এটি নিষিদ্ধ বা হারাম।” এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি একটি নারীর ইচ্ছা, সম্মতি এবং শারীরিক অধিকারকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে। নারীর ওপর এটি একটি চাপ সৃষ্টি, যেন আল্লাহর অভিশাপের ভয়ভীতির কারণে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সে কাজটি করতে বাধ্য হয়। আর যৌন কাজে কোন ভাবে চাপ প্রয়োগ, ভয়ভীতি দেখানো, এগুলো সবই সংজ্ঞানুসারে ধর্ষণের অন্তর্ভূক্ত। আসুন একটি ভিডিও দেখি,

এবারে আসুন একটি নিউজ পড়ি, [4] [5]

বৈবাহিক ধর্ষণে কিশোরীর মৃত্যু: এরপরও কেন এটি বৈধ?
ছবি: নূরনাহার ও তার স্বামী রাজিব খান।
গত ২৫ অক্টোবর টাঙ্গাইল থেকে আসা ১৪ বছরের এক কিশোরী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য মতে, তার মৃত্যুর কারণ ছিল যোনিপথে অত্যধিক রক্তক্ষরণ।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীর নাম নূরনাহার। টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কাউলজানি ইউনিয়নের কালিয়া গ্রামের মেয়ে নূরনাহার কালিয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। নূরনাহারের পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন লেগেই ছিল। তার বাবা-মা দুই জনেই দিনমজুর হিসেবে সারাদিন কাজ করেন। দিনমজুরির কাজে দিনের বড় একটা সময় তারা বাসার বাইরে থাকতেন। বাড়িতে থাকার সময়টুকু কাটত কলহে। এমন পরিবেশ থেকে নূরনাহারকে দূরে রাখার জন্য মাত্র চার বছর বয়সে তার নানা লাল খান তাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। নূরনাহার তার নানার কাছেই মানুষ হচ্ছিল। লাল খানই নূরনাহারকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। দিনমজুর হিসেবে পাওয়া সামান্য উপার্জন থেকে নাতনির লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ চালাতেন। মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে নূরনাহারের সুনাম ছিল। বার্ষিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সে এ বছর অষ্টম শ্রেণিতে পড়া শুরু করেছিল।
কিন্তু বিধি বাম। করোনার আঘাতে লাল খানের ছোট্ট সংসার পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় গত ২০ সেপ্টেম্বর পার্শ্ববর্তী গ্রামের ৩৪/৩৫ বছরের রাজিব খানের সঙ্গে নূরনাহারের বাল্যবিয়ে হয়। অভিবাসী শ্রমিক রাজিব আরব আমিরাতে কাজ করেন। ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। রাজিব ভালো উপার্জন করেন, এমন কথার ভিত্তিতে নূরনাহারের পরিবার রাজিবের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিতে আগ্রহী হয়। লাল খান ৩০ হাজার টাকা খরচ করে নাতনির বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’র বিধান অনুযায়ী, নূরনাহারের বয়স বিবাহযোগ্য না হওয়ায় (১৮ বছর) উভয় পরিবার বিয়ে নিবন্ধন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ের পর নূরনাহার বাসাইল উপজেলার ফুলকি পশ্চিমপাড়া গ্রামে তার শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়।
একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লাল খান বলেন, ‘আমার নাতনি আমাকে খবর দেয় যে, বিয়ের প্রথম রাত থেকেই তার রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।’ রাজিব তার নববধূর উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা তো করেননি, বরং মেয়েটির গভীর ক্ষতকে উপেক্ষা করে তিনি সহবাস চালিয়ে যান। রক্তপাত না থামায় নূরনাহারের শাশুড়ি তাকে স্থানীয় কবিরাজি দাওয়াই এনে খাওয়ান। পরবর্তীতে নূরনাহারের অবস্থা সংকটাপন্ন হলে ২২ অক্টোবর টাঙ্গাইলের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে তাকে নেওয়া হয় এবং সুকৌশলে পুত্রবধূর যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বাপের বাড়ির লোকের ওপর বুঝিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা চলে যান।
অবস্থার অবনতিতে মেয়েটিকে তারপর মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসার খরচ মেটাতে নূরনাহারের পরিবার হিমশিম খাচ্ছিল। তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে ৬০ হাজার টাকা জোগাড় করে পরিবারের হাতে তুলে দেয়। শেষ পর্যন্ত নূরনাহারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আনা নয়। কিন্তু, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে ২৫ অক্টোবর নূরনাহার পরাজয় স্বীকার করে। পরের দিন ময়নাতদন্ত শেষে নানাবাড়ির নিকটবর্তী স্থানীয় গোরস্থানে তার দাফনকার্য সম্পাদিত হয়। লাল খান তার নাতনির মৃত্যুর জন্য রাজিবকে দায়ী করেছেন। রাজীব তার সদ্যমৃত স্ত্রীর জানাজায় পর্যন্ত যাননি।
নূরনাহারের শাশুড়ি বিলকিস বেগমের বক্তব্য, ‘নূরনাহারকে জিনে ধরেছিল। তাই তার যোনিপথে এত রক্তক্ষরণ হয়েছে।’ বাসাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফিরোজুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, মেয়েদের প্রথম মিলনের ক্ষেত্রে ভয় ও আতঙ্ক বোধ করা খুবই স্বাভাবিক। তা ছাড়া, অপরিণত বয়সে বিয়ে হলে যোনিপথে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য বিলম্ব না করে গাইনোকোলজিস্ট দেখানো জরুরি।
গ্রাম্য সালিশে নূরনাহারের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা টাকা দিয়ে বিষয়টি ‘মিটমাট’ করে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে, জানা গিয়েছে যে, নূরনাহারের পরিবার বাসাইল থানায় শ্বশুরবাড়ির নামে অভিযোগ দাখিল করেছেন। প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য যে, বাল্যবিবাহ সংঘটনের মাধ্যমে নূরনাহারের পরিবারের লোকেরাও বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’র ৮ ধারা অনুযায়ী অপরাধী। যার জন্য তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত করা যায়।
নূরনাহারের পরিবারের একটিবারও মনে হয়নি যে, নূরনাহারের মতো একজন মেধাবী শিক্ষার্থী একদিন তাদের দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি এনে দেবে। তাদের কাছে মোটা টাকা কামানো প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটাই বড় ছিল। অথচ নূরনাহারের নানা কিনা নিজ উদ্যোগে নাতনিকে স্কুলে পড়াচ্ছিলেন! আজও এ সমাজে মেয়ের বিয়ের কাছে তাদের লেখাপড়া, তাদের স্বনির্ভরতা, তাদের দক্ষতা অর্জন হেরে যাচ্ছে।
একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া জরুরি যে, নূরনাহার মারা গেছে তার বরের জবরদস্তিমূলক উপর্যুপরি সঙ্গমের কারণে। কিন্তু, দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের আইনে ১৩ বছরের বেশি বয়সের স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস ধর্ষণ বলে বিবেচিত না। রাজিবের এই পাশবিকতা আমাদের দণ্ডবিধি ১৮৬০’র ৩৭৫ ধারায় (যে ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে) অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না। উপরন্তু, দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী (যেখানে ধর্ষণের শাস্তি বর্ণিত হয়েছে) বৈবাহিক ধর্ষণের শাস্তি কেবল তখনই দেওয়া যেতে পারে, যখন স্ত্রীর বয়স ১২ বছরের কম হবে এবং সেই শাস্তির পরিমাণ মাত্র অনূর্ধ্ব দুই বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা।
এই আইনগুলো আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা। ঔপনিবেশিক শাসনকালে যখন ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা সমাজের সর্বস্তরে বিরাজমান, তখন এই আইনের সৃষ্টি। ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতায় স্ত্রীকে তার ‘স্বামী’ অর্থাৎ মালিকের সহধর্মিণী না, বরং সম্পত্তি ভাবা হতো। সেই সমাজে নিজের স্ত্রীকে যথেচ্ছা ভোগ করার জন্য পুরুষকে দায়বদ্ধ করা ছিল অকল্পনীয়। এমন একটি রক্ষণশীল ধর্ষণের সংজ্ঞা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির মতো আজও আগলে রেখেছি।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা নিরোধের জন্য এই পর্যন্ত তিন বার বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছে। প্রথমে ১৯৮৩ সালে, এরপর ১৯৯৫ এবং সর্বশেষ ২০০০ সালে। কিন্তু, প্রতিবারই আমাদের আইন প্রণেতারা সজ্ঞানে দণ্ডবিধি থেকে বৈবাহিক ধর্ষণের দায়মুক্তি দেওয়া ওই ব্যতিক্রম ধারা বাতিলের পরিবর্তে বহাল রেখেছেন। এই আইনের হোতা যেই ব্রিটিশ, তারা কিন্তু সেই ১৯৯১ সালেই বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি পাকিস্তান (দেশভাগের পর ওই আইন পাকিস্তানেও বলবত ছিল) ২০০৬ সালে বৈবাহিক ধর্ষণের ওই ব্যতিক্রম ধারা বাতিল করেছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা সংক্রান্ত জাতীয় জরিপের (২০১৫ সাল) তথ্য অনুযায়ী, বিবাহিত নারীদের ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ তাদের বৈবাহিক জীবনে স্বামীর কাছে জবরদস্তিমূলক সহবাসের পাশাপাশি অন্যান্য যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া ১৯ হাজার ৯৮৭ জন নারীর মধ্যে পাঁচ হাজার ৩৯০ জন নারী বলেছেন, তাদের স্বামী তাদের ধর্ষণ করেছেন। ধর্ষণের ব্যতিক্রম ধারা বহাল রেখে আমরা এই নারীদের কী বার্তা দিচ্ছি?
আমরা বলছি যে, হাজারো নারী ও কিশোরী যারা নিঃসন্দেহে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন, তাদের বিচার চাওয়ার কোনো অধিকার নেই। আমাদের আইন আমাদের শেখাচ্ছে যে নারী আসলে তার স্বামীর সম্পত্তি। আমরা বলছি যে, কাবিননামায় সই করে বা কবুল বলে বা মন্ত্রপাঠে সাত পাঁকে বাঁধা পড়ে একজন নারী অনন্তকালের জন্য যৌন সম্পর্কের সম্মতি দিয়ে দিচ্ছেন। এ সম্মতি কখনো ফেরত নেওয়া যাবে না। নারীর শরীর খারাপ থাকুক, মর্জি না থাকুক, পরিবেশ না থাকুক, বর ‘চাহিবামাত্র’ নারীকে সহবাস করতেই হবে। তাকে রাজি হতে হবে না। তার রাজি-খুশি নিয়ে আইন চিন্তিত নয়। আমরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি যে, নূরনাহারের মতো বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া কিশোরীরা যখন জবরদস্তিমূলক যৌনসঙ্গমে মারা যাচ্ছে, সেই জবরদস্তিমূলক সহবাস আসলে ধর্ষণ না, কেবল এ কারণে যে ওই পুরুষটি মেয়েটির ‘স্বামী’। জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে। তারপর জোর করে সহবাস করা হবে। কিন্তু নারী ‘না’ বলতে পারবে না।
রাজিব এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের এখন যেই এক অপরাধের জন্য দায়ী করা যাবে, তা হলো বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ৭ নম্বর ধারার অধীনে বাল্যবিবাহ করার অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা। তবে, শাস্তি শুধু জরিমানাও হতে পারে। কাজেই, কোনো পুরুষ যদি মনে করে যে, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে তিনি বৈধ উপায়ে প্রতি রাতে একটি বাচ্চা মেয়েকে সবরকম দায়মুক্তভাবে ভোগ (ধর্ষণ) করবে, তাহলে অন্তত আইনত তার সিদ্ধান্ত সঠিক। আমাদের সমাজে বিয়ে দিয়ে ঘাড় থেকে নামানোর মতো মেয়ের সংখ্যা তো কম নয়! কোনো থানা বা আদালতও বৈবাহিক ধর্ষণের অভিযোগ নিতে পারবে না, ইচ্ছা থাকলেও।
এটাই আমাদের আইন। এটাই আমাদের বাস্তবতা। আমাদের জানতে হবে। আমাদের ঘৃণা করতে হবে। আমাদের আপত্তি জানাতে হবে।
তাকবির হুদা, বাংলাদেশ লিগ্যাল অ্যাইড ও সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) গবেষণা বিশেষজ্ঞ

বৈবাহিক 5

এবারে আসুন একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখি। উল্লেখ্য, এরকম ফেসবুক স্ট্যাটাসের সংখ্যা অগণিত,

বৈবাহিক 7

তথ্যসূত্র

  1. সহিহ মুসলিম শরীফ (প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ বঙ্গানুবাদ), মাকতাবাতুল হাদীছ প্রকাশনী, ১৩তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৬ []
  2. রিয়াদুস সালেহীন, ইমাম নববী, ইসলামিয়া কুরআন মহল প্রকাশনী, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩১ []
  3. তাফসীরে ইবনে কাসীর, ২য় খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ১১২[]
  4. বৈবাহিক ধর্ষণে কিশোরীর মৃত্যু: এরপরও কেন এটি বৈধ? []
  5. ওয়েব আর্কাইভ লিংক বৈবাহিক ধর্ষণে কিশোরীর মৃত্যু: এরপরও কেন এটি বৈধ? []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"