02.বিতর্ক ও বেশি প্রশ্ন করা হারাম

ইসলাম প্রশ্ন, বিতর্ক, মুক্তচিন্তা ও সমালোচনাকে যে নিরুৎসাহিত করে, তা নিছক কাকতালীয় নয়; বরং এটি এক সুস্পষ্ট দমননীতি যা চিন্তার স্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যা করার একটি পুরনো কৌশল। ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামে প্রশ্নহীন অন্ধ আনুগত্য চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নবী মুহাম্মদ নিজেই অতিরিক্ত প্রশ্ন ও বিতর্ককে অপছন্দ করতেন, যা ইসলামের অনুসারীদের জন্য স্পষ্ট বার্তা দেয়—অন্ধভাবে ইসলামের প্রতিটি বিষয় বিশ্বাস করতে হবে, কিন্তু প্রশ্ন করা চলবে না। সত্য কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ হতে ভয় পায় না, বরং মিথ্যাকেই টিকে থাকার জন্য প্রশ্ন দমন করতে হয়। আর মুক্ত চিন্তা দমন করার ক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান খুবই স্পষ্ট।

হাদিসের একাধিক বর্ণনায় দেখা যায়, নবী মুহাম্মদ তার অনুসারীদের বেশি প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছেন। যেমন, মুসলিম শরীফের একটি হাদিসে বলা হয়েছে, “তোমাদের পূর্ববর্তীরা অতিরিক্ত প্রশ্নের কারণে ধ্বংস হয়েছে।” এখানে ‘ধ্বংস’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? চিন্তাশীলতা এবং প্রশ্ন করে জানতে চাওয়া কি ধ্বংসের সমান? এ থেকে স্পষ্ট হয় এই ধর্মটি কেবল অন্ধ বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। একমাত্র সেই মতবাদই প্রশ্নকে ভয় পায়, যেটি নিজে নড়বড়ে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। প্রশ্নহীন আনুগত্যের এই কৌশল ইসলামকে কেবল একটি বিশ্বাসের কাঠামো নয়, বরং একটি ক্ষমতা কায়েমের অস্ত্র বানিয়েছে। ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হোক, সেটা শাসক ও ধর্মীয় নেতারা চায়নি, কারণ একবার প্রশ্নের দরজা খুলে গেলে তাদের কর্তৃত্ব টিকে থাকার কোনো ভিত্তি থাকে না। তাই প্রশ্ন করাকে ‘ফিতনা’ বা বিভ্রান্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাস্তবে, প্রশ্ন করাই জ্ঞানের মূল চালিকাশক্তি, অথচ ইসলাম এটিকে ‘ধ্বংসের’ কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে প্রশ্নহীন দাসত্বকে আদর্শ হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছে। হীরক রাজার দেশে সিনেমাটিতে বলা হয়েছিল, “ওরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে।”

কোরআনের কিছু আয়াত আল্লাহর সৃষ্টি জগত সম্পর্কে চিন্তা ও অনুসন্ধানকে উৎসাহিত করার ভান করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। কুরআনের এক জায়গায় বলা হয়, “ভেবে দেখো, চিন্তা করো,” আবার আরেক জায়গায় স্পষ্ট হুমকি দেওয়া হয় যে, “আল্লাহর কর্তৃত্বের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলোনা।” এই দ্বিচারিতা আসলে ইসলামকে সুরক্ষিত রাখার জন্য, যেন প্রশ্নের তোপের মুখে ইসলামকে না পড়তে হয়। যে সমাজে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ, সেখানে বিজ্ঞান, দার্শনিক চর্চা, এবং মুক্তচিন্তা ধ্বংস হয়ে যায়। ইতিহাস প্রমাণ করে, যখন মুসলিম সভ্যতা মুক্ত চিন্তার পথে হাঁটছিল, তখনই তারা বিজ্ঞান, গণিত, ও দর্শনে অগ্রগতি করেছিল। কিন্তু যখনই ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ প্রশ্নের পথ রুদ্ধ করে দেয়, তখন থেকেই মুসলিম বিশ্ব পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। এর প্রধান কারণ, ইসলাম দার্শনিক যুক্তিবাদী চিন্তাকে শত্রু হিসেবে দেখে, শুধুমাত্র ইসলাম যতটুকু সুযোগ দেয় ততটুকু চিন্তা করতে বলে, সেখানেও আবার চিন্তা করার পরে ঠিক কোন সিদ্ধান্তটি নিতে হবে, তাও বলে দেয়। যদি চিন্তার পরে কোন সিদ্ধান্তটি নিতে হবে সেটি আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেয়া হয়, তাহলে সেই চিন্তার তো আর কোন অর্থই থাকে না।

এই প্রবণতা কেবল মধ্যযুগেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; আজও বহু মুসলিম দেশ ও সমাজে কেউ যদি ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্ন তোলে, তাকে দমন করা হয়, কাফের ঘোষণা করা হয়, এমনকি হত্যা করা হয়। এই ধরনের নিষ্ঠুর ও মধ্যযুগীয় মানসিকতা ইসলামকে শুধু একটি ধর্ম নয়, বরং একটি বুদ্ধিবৃত্তিক কারাগারে পরিণত করেছে। আসল কথা হলো, সত্যিকারের জ্ঞান ও সভ্যতার বিকাশের জন্য প্রশ্ন অপরিহার্য। যদি ইসলাম সত্যের ধর্ম হতো, তাহলে এটি প্রশ্নকে ভয় পেত না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসলাম প্রশ্নকেই তার অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে। তাই যারা যুক্তিবাদী, যারা সত্যের সন্ধানে, তাদের জন্য একমাত্র পথ হলো মুক্ত চিন্তার চর্চা এবং সকল প্রকার ধর্মীয় দমননীতি প্রত্যাখ্যান করা। একমাত্র মুক্তচিন্তাই পারে সমাজকে অন্ধবিশ্বাসের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে। আসুন শুরুতেই একটি হাদিস পড়ি, [1]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৯৬/ কুরআন ও সুন্নাহকে শক্তভাবে ধরে থাকা
হাদিস নম্বরঃ ৭২৯২
৯৬/৩. বেশি বেশি প্রশ্ন করা এবং অকারণে কষ্ট করা নিন্দনীয়।
৭২৯২. মুগীরাহ ইবনু শু‘বাহ (রাঃ)-এর লেখক ওয়াররাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মু‘আবিয়াহ (রাঃ) মুগীরাহ (রাঃ)-এর কাছে লিখে পাঠালেন যে, তুমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা কিছু শুনেছ তা আমার কাছে লিখে পাঠাও। তিনি বলেন, তিনি তাকে লিখলেন যে, আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি সালাতের পর বলতেনঃ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শারীক নেই, সাম্রাজ্য তাঁরই, আর সকল প্রশংসা তাঁরই জন্য, তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান। হে আল্লাহ্! তুমি যা দান করবে তাকে আটকানোর কেউ নেই, আর তুমি আটকাবে তা দেয়ার মত কেউ নেই। ধন সম্পদ তোমার নিকটে সম্পদশালীদের কোন উপকার করবে না।
তিনি আরো লিখেছিলেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তর্কে লিপ্ত হওয়া, বেশি বেশি প্রশ্ন করা ও সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে নিষেধ করতেন। আর তিনি মায়েদের অবাধ্য হতে, কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দিতে ও প্রাপকের পাওনা দেয়া থেকে হাত গুটাতে আর নেয়ার ব্যাপারে হাত বাড়িয়ে দিতে নিষেধ করতেন। আবূ ‘আবদুল্লাহ্ (বুখারী (রহ.)) বলেন, তারা (কাফির) জাহিলীয়্যাতের যুগে স্বীয় কন্যাদেরকে হত্যা করতেন। অতঃপর আল্লাহ তা হারাম করে দেন। (৮৪৪) (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৭৮২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৭৯৪)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

এবারে আসুন সহিহ মুসলিম এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ থেকে [2]

বিতর্ক
বিতর্ক 1
বিতর্ক 3
বিতর্ক 5
বিতর্ক 7
বিতর্ক 9
বিতর্ক 11
বিতর্ক 13

তথ্যসূত্র

  1. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিসঃ ৭২৯২ []
  2. সহিহ মুসলিম শরীফ (প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ বঙ্গানুবাদ), মাকতাবাতুল হাদীছ প্রকাশনী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৫-১৮২ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"