ইসলামে কিছু কাজকে হালাল (জায়েজ) এবং কিছু কাজকে হারাম (নিষিদ্ধ) বলা হয়েছে। ইসলামে হালাল হারামের এই বিধানগুলো সম্পর্কে দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যা খুবই মৌলিক এবং নৈতিকতার ধারণার সাথে সম্পর্কিত, তা আমাদের সামনে চলে আসে। প্রশ্নটি হচ্ছে, এই হালাল-হারামের নিয়ম কেন? এর পেছনের কারণ কী? কেন চুরি করা বা ডাকাতি করা হারাম? কেন গরীব লোককে কিছু খাদ্য দেয়া হালাল? এইসব বিষয় কি আল্লাহ শুধু ইচ্ছা করে বলেই কিছু কাজকে নিষিদ্ধ করেছেন, নাকি এর পেছনে কোন যুক্তি আছে? কোন কাজ হারাম অর্থ কী এই যে, কাজটি যেহেতু মানুষের জন্য ক্ষতিকর, সেই যুক্তিতে আল্লাহ হারাম করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কথা মনে রাখতে হবে। আল্লাহ সবকিছুর মালিক, তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই হয়। এই ইচ্ছা করার ক্ষেত্রে তিনি কী সম্পূর্ণ স্বাধীন, নাকি যুক্তির অধীন? অর্থাৎ, কোন একটি কাজ যদি খারাপ না হতো, আল্লাহ কী যুক্তির বাইরে গিয়ে শুধুমাত্র তার ইচ্ছা অনিচ্ছার ভিত্তিতে সেটি হারাম করতে পারতেন? বা ধরুন কোন একটি কাজ যৌক্তিকভাবে খারাপ। আল্লাহ কী সেটি চাইলেই হালাল করতে পারতেন? আল্লাহর কী এই বিষয়ে স্বেচ্ছাচারিতা বা সার্বোভৌমত্ব রয়েছে? এখানে যুক্তি প্রাধান্য পায় নাকি আল্লাহর ইচ্ছা?
ইসলামে আল্লাহর এইসব বিধানের পেছনে যুক্তি থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। ইসলামে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়কে হারাম করার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, আবার অনেক কিছুর ক্ষেত্রে কোন কারণ উল্লেখ করা হয়নি। সারা পৃথিবীর ইসলামে বিশ্বাসী মানুষেরা বিশ্বাস করে, যেগুলোর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর কারণ তো জানা গেলই; আর যেগুলোর কারণ আল্লাহ বা নবী উল্লেখ করেনি, সেগুলোও আসলে খারাপ বলেই আল্লাহ বা নবী হারাম করেছে, আমরা শুধুমাত্র তার কারণ জানি না। কারণ আমাদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। এটি সত্য বলে মেনে নিলে এটি মানতে হবে যে, আল্লাহ যুক্তির অধীন। অর্থাৎ অযৌক্তিক কোন কিছু ইচ্ছা করা আল্লাহর পক্ষে সম্ভব নয়। এবারে আসুন একটি হাদিস পড়ি। এই হাদিসে আল্লাহ বলছেন যে, তাকদীরের বিষয়াদি আল্লাহ নির্ধারণ করে রাখেন কারো পরোয়া না করেই। আল্লাহ সদম্ভে ঘোষণা করেন, তিনি কারোরই পরোয়া করেন না, যা ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই করেন [1]
তাহলে, ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান কিংবা হালাল হারামের বিষয়গুলো আসলে কিসের ওপর নির্ভর করে? যেমন ধরুন, চুরি করা ডাকাতি করা যে হারাম, এগুলো কী এই কাজগুলো মন্দ সেই কারণে আল্লাহ হারাম করেছেন, নাকি আল্লাহর শুধুমাত্র ইচ্ছা হয়েছে তাই হারাম করেছে। হালাল হারাম করার বিষয়ে আল্লাহ কী যুক্তি তথ্য প্রমাণের মুখাপেক্ষী, নাকি তার যেমন ইচ্ছা তেমন তিনি হালাল হারাম করতে পারেন? এই ক্ষেত্রে আল্লাহর কী সার্বোভৌমত্ব রয়েছে, যা ইচ্ছা বলার বা করার সামর্থ্য রয়েছে, নাকি তিনি যুক্তির অধীন?
এই প্রসঙ্গে নিচের হাদিসটি পড়া এবং বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসুন হাদিসটি পড়ি। হাদিসটিতে বলা হয়েছে যে, কিছু মুসলিমের অতিরিক্ত এবং হয়তো নবীর কাছে কিছু বিরক্তিকর প্রশ্নের কারণে নবী কিছু বিষয়কে হারাম ঘোষণা করেছিলেন। হাদিসটিতে বেশি বেশি প্রশ্ন করাকে অপছন্দনীয় বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে বেশি বেশি প্রশ্ন করা। সেটি যাইহোক। হাদিসটিতে বলা হয়েছে, কোন কোন মুসলিম আছে যারা নবীকে কিছু প্রশ্ন করতো। তর্কের খাতিরে ধরেই নিচ্ছি যে, সেগুলো খুবই উদ্ভট প্রশ্ন ছিল। কিন্তু হাদিসের পরের অংশে লেখা রয়েছে যে, এইসব প্রশ্নের কারণে নবী কিছু কিছু জিনিস হারাম করে দিয়েছিলেন। এবং সেই সকল জিনিস হারাম করার কারণ হিসেবে নবী সেইসব প্রশ্নকারীকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, এদের বেশি বেশি প্রশ্নের কারণেই ঐ বিষয়গুলো হারাম করে দেয়া হল। অর্থাৎ, সেইসব বিষয়ে ঐসব মুসলিম প্রশ্ন না করলে, নবীকে প্রশ্ন করে বিরক্ত না করলে, সেগুলো নবী হারাম করতেন না। সেগুলো আগে হালালি ছিল, পরে হালালই থাকতো। ঐসব প্রশ্নের কারণেই সেগুলো হারাম হয়ে গেল! খুব অদ্ভুত বিষয়। একটু গভীর ভাবে চিন্তা করুন। এই হাদিসের মধ্যে নৈতিকতার আলোচনায় বিশাল এক দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে।
সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৯৬/ কুরআন ও সুন্নাহকে শক্তভাবে ধরে থাকা
পরিচ্ছেদঃ ৯৬/৩. বেশি বেশি প্রশ্ন করা এবং অকারণে কষ্ট করা নিন্দনীয়।
এবং আল্লাহর বাণীঃ তোমরা সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যা প্রকাশিত হলে তোমরা দুঃখিত হবে। (সূরাহ আল-মায়িদাহ ৫/১০১)
৭২৮৯. আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুসলিমদের সর্বাপেক্ষা বড় অপরাধী ঐ লোক যে এমন বিষয়ে প্রশ্ন করে যা আগে হারাম ছিল না, কিন্তু তার প্রশ্ন করার কারণে তা হারাম করা হয়েছে। [মুসলিম ৪৩/৩৭, হাঃ ২৩৫৮, আহমাদ ১৫৪৫] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৭৭৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৭৯১)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ সা’দ বিন আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ)
আসুন এবারে হাদিসটির ব্যাখ্যা পড়ে নেয়া যাক, [2]
তথ্যসূত্র
- মিশকাতুল মাসাবীহ ( মিশকাত শরীফ), আধুনিক প্রকাশনী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৬ [↑]
- সহজ নসরুল বারী শরহে সহীহ বুখারী, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ১৩৭ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"