ভূমিকা
ধার্মিকদের লিখিত বিভিন্ন বইপত্রে সর্বদাই একজন নাস্তিক প্রফেসরের সন্ধান মেলে, যে পুরো ক্লাসের সামনে নিজের নাস্তিকতার কথা বলতে শুরু করে। সেই ক্লাসেই ঘটনাচক্রে একজন মুসলিম ছাত্র উপস্থিত থাকে, সে ঐ নাস্তিক প্রফেসরকে যুক্তিতর্ক এবং ভরপুর জ্ঞান বিজ্ঞান দিয়ে এমন নাস্তানাবুদ করে, যার ফলে সেই নাস্তিক প্রফেসর সব ছাত্রের সামনে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়, এবং ইসলামের জয় হয়! এরকম গল্প আপনারা প্রায়ই পাবেন, বিভিন্ন সস্তা বইপত্রে, বিভিন্ন ফেসবুক স্ট্যাটাসে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাস্তিকরা যখন নিয়মিত লাইভ করে, আস্তিকদের আমন্ত্রণ জানায় সরাসরি বিতর্কে অংশ নিতে, তখন সেই মুসলিম ছাত্রের আর দেখা মেলে না। যেসব মুসলিম সেইসব লাইভ অনুষ্ঠানে আসেন, তারা এতটাই হাস্যকর যুক্তি তুলে ধরেন যে, তাদের মুসলিম বন্ধুরা পর্যন্ত তাদের সমর্থন করতে চান না। গত কয়েকবছর ধরে নাস্তিকরা ফেসবুক এবং ইউটিউব লাইভে আস্তিকদের বারবার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে, এমনকি এইসব গল্পের লেখকদেরও বারবার নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা বেশিরভাগই আসতে সাহস করেনি। যারা এসেছিলেন, তাদের পরিণতি কী হয়েছে সেটি দর্শকরাই ভাল বলতে পারবেন।
নাস্তিক প্রফেসরের মিথ
“নাস্তিক প্রফেসরের মিথ” হলো একটি কিংবদন্তি যা বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রচার মাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এই ধরনের গল্পগুলো ধার্মিকদের মধ্যে একটি সুপ্ত আনন্দ সৃষ্টি করে, যেখানে একজন নাস্তিক প্রফেসর তার নাস্তিকতার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে হেরে যান এবং একজন মুসলিম ছাত্রের বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিক্রিয়ার সামনে বোকা বনে যান। গল্পে প্রফেসরকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তিনি খুব সাধারণ এবং দুর্বল যুক্তি দিচ্ছেন, যেখানে মুসলিম ছাত্রের প্রতিটি প্রতিক্রিয়া সুস্পষ্ট ও সঠিক। এই ধরনের গল্পগুলো মূলত ধার্মিক পাঠকদের মনে সান্ত্বনা প্রদান করতে নির্মাণ করা হয়। এইসব গল্পের লেখক সস্তা কৌশলে নাস্তিক প্রফেসরকে দিয়ে এতটাই বোকা বোকা কথা বলান যে, ধার্মিক পাঠকগণ সেসব পড়ে নাস্তিক প্রফেসরের বোকামি দেখে বড়ই আনন্দ পান। এসব গল্পে দেখানো হয়, সেই নাস্তিক প্রফেসর ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেন এবং এরপর একজন জ্ঞানী মুসলিম কমবয়সী ছাত্র তাকে পুরো শ্রেণির সামনে বোকা বানিয়ে বিতর্কে জিতে যান!
বাস্তবতার সঙ্গে গল্পের সামঞ্জস্যের অভাব
এই ধরনের গল্পে বেশ কয়েকটি মৌলিক ত্রুটি রয়েছে, যা বাস্তব জগতের যুক্তি বা বিজ্ঞানভিত্তিক বিতর্কের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। প্রথমত, এখানে “স্ট্রোম্যান আর্গুমেন্ট” কৌশল ব্যবহার করা হয়। স্ট্রোম্যান আর্গুমেন্ট বলতে বোঝায়, যেখানে বিপক্ষ পক্ষের যুক্তিকে দুর্বলভাবে উপস্থাপন করা হয়, এরপর সেই দুর্বল যুক্তিকে আক্রমণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, গল্পগুলোতে নাস্তিক প্রফেসরকে এমন সব যুক্তি দিতে দেখানো হয়, যা বাস্তব জীবনে কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি সহজেই বলবেন না। উদাহরণস্বরূপ, গল্পে প্রফেসরকে দিয়ে বলানো হয়, “নাস্তিকরা যা দেখতে পায় না, তা বিশ্বাস করে না।”
স্ট্রোম্যান আর্গুমেন্ট এবং বাস্তব বিতর্কের তফাত:
বাস্তবে নাস্তিক যুক্তিবাদীরা কখনোই এই ধরনের সরলীকৃত দাবি করেন না। বরং, তারা বলে থাকেন যে, কোনো বিষয়কে বিশ্বাস করার আগে নৈর্ব্যক্তিক প্রমাণ বা যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ থাকা উচিত। তাদের দাবি এই নয় যে, আমরা যা দেখি না তা মেনে নিতে পারি না, বরং পরীক্ষাযোগ্য প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছু বিশ্বাস করা বা মেনে নেয়া উচিত নয়। কারণ তা করা হলে সেটি হবে অন্ধবিশ্বাস। বিজ্ঞানও এই নীতির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। বিজ্ঞানীরা যেমন বাতাস, জীবাণু, এবং ব্ল্যাকহোল বিশ্বাস করেন, কারণ সেগুলোর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে। তবে ঈশ্বরের মতো অলৌকিক সত্তার ক্ষেত্রে, নাস্তিকরা যুক্তিসঙ্গত প্রমাণের অভাবে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেন। যেই আস্তিকগণ এই ধরণের যুক্তি তুলে ধরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান, তাদের যদি বলা হয়, ঈশ্বর গতকাল রাতে মারা গেছেন, তারা সেটি মানতে চাইবেন না। প্রমাণ চাইবেন। তখন যদি বলা হয়, তোমরা দেখা ছাড়া কোন কিছু বিশ্বাস করো না কেন?
গল্পের বুদ্ধিবৃত্তিক ফাঁকফোকর:
এই ধরনের গল্পগুলোতে নাস্তিকদের মূল যুক্তিগুলোকে উপেক্ষা করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তারা বোকার মত কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এরকম উদ্ভট কথা কোন নাস্তিকই বলে না। তাদের যুক্তির মূলে থাকে, কোনো বিষয়কে মেনে নেওয়ার আগে সেটির পক্ষে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ থাকা জরুরি। স্ট্রোম্যান আর্গুমেন্টের মাধ্যমে নাস্তিকদের ভুলভাবে উপস্থাপন করা সহজ হলেও, এর মাধ্যমে প্রকৃত বিতর্কের কোনো সমাধান আসে না। এ ধরনের গল্পের মুসলিম ছাত্রদের যুক্তি চমকপ্রদ ও মজবুত দেখালেও, বাস্তব জীবনের যুক্তিবাদীদের বিতর্কে সেইসব কৌশলগুলো তেমন কার্যকর হয় না।
এই মিথের মূল সমস্যা হলো “স্ট্রোম্যান আর্গুমেন্ট” ব্যবহার করা। স্ট্রোম্যান আর্গুমেন্ট হলো এমন একটি কৌশল, যেখানে বিপক্ষ পক্ষের অবস্থানকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়, তারপর সেই ভুল অবস্থানকে আক্রমণ করে সহজে পরাজিত করা হয়। এই গল্পগুলোতে নাস্তিক প্রফেসরকে তার যুক্তি না দিয়ে বোকামির মতো কথা বলানো হয়, যাতে মুসলিম ছাত্রের যুক্তি সহজেই জিতে যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, কোনো নাস্তিক এই ধরনের যুক্তি দেয় না যে, “শুধু চোখে দেখা জিনিসই সত্য”। বরং নাস্তিকেরা বলে যে, যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ ছাড়া কিছু মেনে নেওয়া উচিত নয়।
প্রমাণের গুরুত্ব এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি:
একটি সাধারণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, কোনো কিছু মেনে নেওয়ার জন্য তার পক্ষে পরীক্ষাযোগ্য প্রমাণ থাকা উচিত। প্রমাণ পাওয়া গেলে, বিজ্ঞানীরা তাদের মত পরিবর্তন করেন। যেমন, জীবাণু বা ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ঈশ্বরের ধারণার পক্ষে এমন কোনো পরীক্ষাযোগ্য প্রমাণ নেই, যা নাস্তিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ফলে তারা প্রমাণের অভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান।
উপসংহার:
“নাস্তিক প্রফেসরের মিথ” ধর্মীয় গল্প হিসেবে কিছুক্ষণ আনন্দদায়ক হলেও, বাস্তব যুক্তি এবং প্রমাণের আলোকে এর কোনো স্থায়ী ভিত্তি নেই। এই গল্পগুলো মূলত স্ট্রোম্যান আর্গুমেন্টের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, যেখানে নাস্তিকদের প্রকৃত অবস্থান বিকৃত করে দেখানো হয়। প্রকৃতপক্ষে, বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদী চিন্তাধারায় প্রমাণের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি, এবং পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছু বিশ্বাস করা বিজ্ঞানসম্মত নয়। এ ধরনের মিথ্যা গল্প শুধু ধার্মিকদের জন্য মানসিক প্রশান্তির উৎস হতে পারে, কিন্তু তা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।