বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ব্রাদার রাহুল হোসেন নামক এক ব্যক্তিকে নিয়মিত দেখা যায়। একসময় মোবাইল ফোনের দোকান চালানো এবং মোবাইলে গান লোড করার কাজ করা এই ব্যক্তি বর্তমানে ধর্মপ্রাণ মানুষদের বিশ্বাসকে পুঁজি করে ভালই অর্থ উপার্জন করছে। তার প্রচারিত বিভ্রান্তিকর তথ্য ও অসত্য বক্তব্য সংরক্ষণ করা জরুরি, যাতে এসব বিষয় সহজেই একত্রে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা যায়। এই কারণে তার সমস্ত মিথ্যাচারগুলোকে একত্রিত করা হলো, যেন যুক্তিবাদী পাঠক শ্রোতাগণ সব একসাথে সবকিছু খুঁজে পান। এই লিস্টটিতে পরবর্তীতে আরও তথ্য প্রমাণ যুক্ত করা হবে, আপাতত কয়েকটি তথ্য প্রমাণ একত্র করে রাখা হচ্ছে। আগ্রহী পাঠক এবং দর্শকগণ পরিবর্তীতে আবারো লেখাটি দেখেবন বলে প্রত্যাশা রাখি।

ভবিষ্যপুরাণ সম্পর্কে মিথ্যাচার
ভবিষ্য পুরাণ সম্পর্কে এই ধর্মব্যবসায়ী বলেছেন, সেখানে নাকি নবী মুহাম্মদের প্রশংসা করা হয়েছে। কোনভাবেই নাকি সেখানে নবী মুহাম্মদকে পিশাচ হিসেবে চিত্রিত করা হয়নি! আসুন শুরুতেই রাহুলের বক্তব্য শুনে নিই,
মূল ভবিষ্য পুরান গ্রন্থটি এখানে যুক্ত করা হলো। বইটির ৩৭৬ পৃষ্ঠা থেকে মূল বইয়ের পাতাগুলো তুলে দেয়া হলো আগ্রহী পাঠকের জন্য। বইটির ডাউনলোড লিঙ্কও দেয়া হচ্ছে [1] –





মেটাফিজিক্স সম্পর্কে অকাট মূর্খতা
শুরুতেই মেটাফিজিক্যাল শব্দটির অর্থ আমাদের জেনে নেয়া জরুরি। মেটাফিজিক্যাল শব্দটি মেটাফিজিক্স (Metaphysics) থেকে এসেছে, যা প্রাচীনকালের দার্শনিক চিন্তার একটি শাখা হিসেবে গণ্য হতো। মেটাফিজিক্যাল (Metaphysical) অর্থ হচ্ছে, যা কিছু ভৌত জগতের বাইরে বা বাস্তব বস্তুগত জগতের উর্ধ্বে। আমাদের দৃশ্যমান বাস্তব জগতের মৌলিক প্রকৃতি, অস্তিত্ব, সত্তা, সময়, স্থান, কারণ ও কার্যকারণ ইত্যাদি নিয়ে মেটাফিজিক্সে আলোচনা করা হয়।
মেটাফিজিক্যাল শব্দের ব্যবহার
- দার্শনিক অর্থে: মেটাফিজিক্যাল বলতে বোঝায় এমন বিষয়, যা ভৌত বাস্তবতার (Physical Reality) বাইরের জগৎ নিয়ে আলোচনা করে। এটি বস্তুগত নয় বরং বিমূর্ত ধারণার সাথে সম্পর্কিত। যেমন:
- আত্মা আছে কি না?
- সৃষ্টির মূল কারণ কী?
- জীবনের প্রকৃত অর্থ কী?
- জান্নাত জাহান্নাম আছে কিনা?
- জ্বীন পরী আছে কিনা?
- সাধারণ অর্থে: কোনো কিছুকে যদি বিমূর্ত বা বাস্তবতার বাইরে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবে সেটিকে মেটাফিজিক্যাল বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ:
- “করিমের চিন্তাগুলো সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা কঠিন।” – এখানে তার চিন্তাগুলো মেটাফিজিক্যাল বা সত্যিকার অর্থে বস্তুগতভাবে অস্তিত্বশীল নয় তবে সেগুলো তার মগজে রয়েছে।
- ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক অর্থে: মেটাফিজিক্যাল ধারণাগুলো সাধারণত ঈশ্বর, আত্মা, অনন্ত জীবন, পুনর্জন্ম ইত্যাদির মতো অদৃশ্য বা অতীন্দ্রিয় বিষয়গুলোর সাথে যুক্ত।
এবারে আসুন ব্রাদার রাহুলের মুখ থেকে মেটাফিজিক্যাল কাকে বলে তা বুঝি,
নয় বছরের সহবাস নিয়ে মিথ্যাচার
ব্রাদার রাহুল দাবী করেছে, নয় বছরে বাসরের কথা লিখিত থাকলেও, সহবাসের কথা নাকি কোথাও নেই। নাস্তিকরা নাকি বিকৃত মস্তিষ্ক, তা বাসর বলতে তারা সহবাস বুঝে নিয়েছে। আসলেই কী তা?
সুনান আবু দাউদ শরীফে খুব পরিষ্কারভাবেই বলা আছে যে, মদিনায় আসার পরেই নবীর সাথে তার সহবাস হয়, তখন তার বয়স নয় বছর [2] [3]
সূনান আবু দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৩৬/ আদব
পরিচ্ছেদঃ ৬১. দোলনায় চড়া সম্পর্কে।
৪৮৫১. মূসা ইবন ইসমাঈল (রহঃ) …. আইশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা যখন মদীনায় আসি, তখন আমার কাছে কয়েকজন মহিলা আসে, আর সে সময় আমি দোলনায় দোল খাচ্ছিলাম। এ সময় আমার মাথার চুল ছোট ছিল। তারা আমাকে নিয়ে গিয়ে সুন্দররূপে সুসজ্জিত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে আসে। এ সময় তিনি আমার সাথে সহবাস করেন, আর তখন আমার বয়স ছিল নয় বছর।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা বিনত আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)

সূরা তালাকের বিকৃত ও মিথ্যা তাফসীর
এই বিষয়ে ব্রাদার রাহুল মিথ্যাচারের প্রায় সকল সীমানাই অতিক্রম করে ফেলেছে। কারণ সমস্ত ইসলামিক ধ্রুপদী স্কলারই যেখানে একমত, সেখানে ব্রাদার রাহুল একদম উল্টো কথা দাবী করে বসে আছে। আসুন শুরুতেই শুনি, রাহুল কী বলে।
এবারে সুরা তালাকের ৪ নম্বর আয়াতটি পড়ি, যেখানে বলা আছে, যেসব স্ত্রী এখনো ঋতুর বয়সে পৌঁছে নি, তাদের ইদ্দত হবে তিনমাস [4]। উল্লেখ্য, এই বিষয়ে সমস্ত তাফসীর এবং ফিকাহ শাস্ত্রে লিখিত বিধান এই লেখাটিতে একত্রিত করা আছে [5]
যে সব তালাকপ্রাপ্তারা বয়সের কারণে মাসিক থেকে নিরাশ হয়েছে তাদের ইদ্দতের ব্যাপারে যদি তোমরা সন্দিহান হও তাহলে তাদের মেয়াদ তিন মাস বলে গণ্য হবে। তেমনিভাবে যারা ছোট থাকার ফলে মাসিকের বয়সে উপনীত হয় নি তাদের ইদ্দতও তিন মাস। আর গর্ভবতীদের তালাক কিংবা স্বামীর মরণোত্তর ইদ্দত হলো সন্তান প্রসব। বস্তুতঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মান্য করার মাধ্যমে তাঁকে ভয় করে তিনি তার সকল বিষয় ও সমস্যা সহজ করে দেন।
— Bengali Mokhtasar
তোমাদের যে সব স্ত্রীগণ মাসিক ঋতু আসার বয়স অতিক্রম করেছে তাদের (‘ইদ্দাতের) ব্যাপারে যদি তোমাদের সন্দেহ সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে তাদের ‘ইদ্দাতকাল তিন মাস, আর যারা (অল্প বয়স্কা হওয়ার কারণে) এখনও ঋতুবতী হয়নি (এ নিয়ম) তাদের জন্যও। আর গর্ভবতী স্ত্রীদের ‘ইদ্দাতকাল তাদের সন্তান প্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন।
— Taisirul Quran
তোমাদের যে সব স্ত্রীর ঋতুমতী হওয়ার আশা নেই তাদের ইদ্দাত সম্পর্কে তোমরা সন্দেহ করলে তাদের ইদ্দাতকাল হবে তিন মাস এবং যাদের এখনও রজশ্বালা হয়নি তাদেরও। এবং গর্ভবতী নারীদের ইদ্দাতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার সমস্যার সমাধান সহজ করে দিবেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যারা ঋতুবর্তী হওয়ার কাল অতিক্রম করে গেছে, তাদের ইদ্দত সম্পর্কে তোমরা যদি সংশয়ে থাক এবং যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি তাদের ইদ্দতকালও হবে তিন মাস। আর গর্ভধারিনীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।
— Rawai Al-bayan
তোমাদের যে সব স্ত্রী আর ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই [১] তাদের ইদ্দত সম্পর্কে তোমরা সন্দেহ করলে তাদের ইদ্দতকাল হবে তিন মাস এবং যারা এখনো ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি তাদেরও; আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। আর যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ্ তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
ইমাম বুখারীর বুখারী শরীফ গ্রন্থে পরিষ্কারভাবেই সূরা তালাকের চার নম্বর আয়াতের অর্থ বলে দেয়া হয়েছে [6] [7]
সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
৬৭/ বিয়ে
পরিচ্ছেদঃ ৬৭/৩৯. কার জন্য ছোট শিশুদের বিয়ে দেয়া বৈধ।
لِقَوْلِهِ تَعَالَى: وَاللاَّئِي لَمْ يَحِضْنَ) فَجَعَلَ عِدَّتَهَا ثَلاَثَةَ أَشْهُرٍ قَبْلَ الْبُلُوغِ
আল্লাহ্ তা‘আলার কালাম ‘‘এবং যারা ঋতুমতী হয়নি’’-(সূরাহ আত-ত্বলাক (তালাক): ৪) এই আয়াতকে দলীল হিসাবে ধরে নাবালেগার ইদ্দাত তিন মাস নির্ধারণ করা হয়েছে।
৫১৩৩. ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁকে বিয়ে করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৬ বছর এবং নয় বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গে বাসর ঘর করেন এবং তিনি তাঁর সান্নিধ্যে নয় বছরকাল ছিলেন। (৩৮৯৪)(আধুনিক প্রকাশনী- ৪৭৫৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৭৫৭)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)

প্যাথলজিক্যাল লায়ার নাকি স্টুপিড?
এই লোক আসলে প্যাথলিজিক্যাল লায়ার নাকি একজন স্টুপিড, তা বলা বেশ মুশকিলের ব্যাপার। তাই সেটি নির্ধারনের দায়িত্ব দর্শক শ্রোতা এবং পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
বিতর্কে নাস্তানাবুদ হয়ে নাস্তিকদের হুমকি
আসাদ নূরের সাথে লাইভ বিতর্কের পরে অনেক নাস্তিকই ব্রাদার রাহুলের মিথ্যাচারগুলো এক এক করে ধরিয়ে দিতে শুরু করে। সেইসময়ে ক্ষিপ্ত হয়ে সে নাস্তিকদের হত্যার হুমকি, বাসায় চলে আসা এবং ঠিকানা প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি দেয়া শুরু করে।
তথ্যসূত্র
- ভবিষ্য পুরান, মহর্ষি কৃষদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বিরচিতম, অনুবাদ এবং সম্পাদনাঃ শ্রীমৎ স্বামী পরমাত্মানন্দনাথ ভৈরব (গিরি), পৃষ্ঠা ৩৭৬-৩৮০ [↑]
- সুনান আবু দাউদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৪৮৫১ [↑]
- আবু দাউদ শরীফ, পঞ্চম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৫২১ [↑]
- সুরা ৬৫:৪ [↑]
- বাল্যবিবাহ, পেডোফিলিয়া এবং ইসলাম – আয়িশা কি ৯ বছর বয়সে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছেছিলেন? [↑]
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিসঃ ৫১৩৩ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৪৭৫৭ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"