22.যমজ বাচ্চাদের যুক্তিবাদী কথোপকথন

দুই যমজ ভাই, যারা এখনো জন্মায় নি, মায়ের পেটের ভেতর বসে গল্প করছে। পেটের ভেতরের আঁধার জগৎটাই তাদের জানা পৃথিবী। সেখানে তারা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে, কিন্তু বাইরের পৃথিবীর কথা তারা জানে না। একজন যমজ ভাই, যার নাম আহান, মায়ের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান। সে বলল, “কোনো মা নেই। আমরা পেটের ভেতরে থেকে এমনি এমনি সৃষ্টি হয়েছি। এখানে যা কিছু আছে, তা এমনিতেই ঘটছে।”

অন্যজন, হৃদয়, বেশ অবাক হয়ে বলল, “কী বলছো ভাই! মা আছে। আমরা তার পেটের ভেতর আছি। সে না থাকলে আমরা এখানে থাকতাম কীভাবে? পেটের বাইরেও একটা বিশাল জগৎ আছে, যেখানে আলো আছে, আকাশ আছে, মানুষ আছে। আর এই সবকিছুর স্রষ্টা আমাদের মা।”

আহান কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। সে জবাব দিল, “যা কিছু আছে, তা আমাদের চোখের সামনে আছে। মাকে তো আমরা দেখি না, শুনিও না। সুতরাং মা বলে কেউ নেই। আর বাইরের পৃথিবী? সে তো কল্পনা! আমরা এমনিতেই এখানে আছি।”

হৃদয় মাথা নেড়ে বলল, “না ভাই, আমি বিশ্বাস করি মা আছে। এই পেটের ভেতরে আমরা এমনি এমনি আসিনি। আমাদের স্রষ্টা আমাদের মা। বাইরের পৃথিবীও ঠিক তেমনই বাস্তব। আর আমাদের জন্মের পর আমরা সেই পৃথিবীতেই যাব।”

আহান তীব্র হাসি দিয়ে বলল, “তুমি কেমন বোকা! যদি বাইরের পৃথিবী থাকত, তবে আমরা তার প্রমাণ পেতাম। এখানে পেটের ভেতর কোনো প্রমাণ নেই।”

হৃদয় একটু চুপ করে রইল। তারপর সে বলল, “শোনো ভাই, প্রমাণ না থাকলেও সত্যকে অস্বীকার করা যায় না। আমাদের মা আছে, বাইরের পৃথিবীও আছে। আমরা হয়তো এখন বুঝতে পারছি না, কিন্তু যখন সময় আসবে, আমরা সেই পৃথিবীতে চলে যাব।”

আহান আবারও প্রতিবাদ করে বলল, “আচ্ছা, যদি সত্যিই মা থাকে, তবে তার স্রষ্টা কে? তিনি কীভাবে এলেন? এবং বাইরের পৃথিবীর স্রষ্টা কে?”

হৃদয় ধৈর্য ধরে উত্তর দিল, “মা আদি, অনন্ত। উনি সবকিছুর স্রষ্টা, তার কোনো স্রষ্টা নেই।”

আহান কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। সে প্রশ্ন করে, “উনি আদি, অনন্ত – তার কোনো প্রমাণ কোথায়? হতে পারে, তার আগে আরও কেউ ছিল, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। হয়তো মা নিজেই জানেন না তারও স্রষ্টা আছে। আর যদি কোনো স্রষ্টা থাকতেই হয়, তবে তারও একজন স্রষ্টা থাকা জরুরি। নইলে সে আসলো কীভাবে? আমাদের এই একই গল্প তো তার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়। আমাদের মা হয়তো এমন এক বিশ্বে আছেন, যেখান থেকে তার স্রষ্টার প্রমাণ মিলছে না। এবং তার স্রষ্টারও একজন স্রষ্টা থাকতে হবে। নইলে তার অস্তিত্ব কীভাবে আমরা ব্যাখ্যা করবো? এভাবে গল্পটি একের পর এক চলতে থাকবে।”

হৃদয় বলল, “না, কোথাও না কোথাও তো থামতে হবে। কারণ এই সৃষ্টির ধারার একটা আদি কারণ আছে। আমাদের মা সেই আদি কারণ। তার বাইরে আর কেউ নেই।”

আহান আবারও যুক্তি দিল, “কিন্তু কীসের ভিত্তিতে তুমি বলছো যে থামতে হবে? কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই তুমি শুধু বিশ্বাস করছো যে, মা আদি কারণ। হয়তো মা’রও আগে আরেকজন মা আছেন, বা অন্য কেউ আছে, তারও আগে কেউ আছে। এভাবে এই স্রষ্টা ধারাটি অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে।”

হৃদয় একটু চুপ করে থেকে বলল, “ভাই, আমাদের সীমিত জ্ঞানে সবকিছু বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, মায়ের বাইরে আর কোনো স্রষ্টা নেই। এই বিশ্বাসই আমাদের জন্য যথেষ্ট।”

আহান হেসে বলল, “তুমি শুধু বিশ্বাস আর রূপকথার গল্পের ওপর নির্ভর করছো। আমরা যদি সত্যিকারের প্রমাণের ভিত্তিতে এই সবকিছু জানতে চাই, তাহলে আমাদের বিজ্ঞান আর যুক্তির পথ বেছে নিতে হবে। শুধু বিশ্বাস আর কল্পনার জগতে আটকে থাকলে চলবে না। বাইরের পৃথিবী যদি সত্যিই থাকে, তবে একদিন আমরা তাকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে পারবো।”

হৃদয় হতাশ হয়ে বলল, “তাহলে তুমি মায়ের অস্তিত্বে বিশ্বাস করো না?”

আহান বলল, “যতক্ষণ প্রমাণ না পাচ্ছি, ততক্ষণ আমার যৌক্তিক অবস্থান হবে, মানছি না। আমি প্রমাণ চাচ্ছি। প্রমাণ ছাড়া আমি বিশ্বাস করবো না। অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে হবে, মেনে নিতে হবে কোন প্রমাণ ছাড়াই, এরকম রূপকথার গল্পে বিশ্বাস করা কোন যৌক্তিক অবস্থান নয়। তা গল্পটি শুনতে যতি ভাল লাগুক না কেন। আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে, আর তার জন্য প্রমাণের প্রয়োজন।”

হৃদয় চুপ হয়ে গেল। কিন্তু তার ভেতরে বিশ্বাস অটুট রইল যে, একদিন তাদের মা আর বাইরের পৃথিবীর অস্তিত্ব প্রমাণ হবে। কিন্তু আহান বিশ্বাস করল না, সে অপেক্ষা করতে লাগল সেই প্রমাণের জন্য।


এই গল্পের মতোই, পৃথিবীর অনেক মানুষ আছে, যারা সৃষ্টির আদি কারণ এবং ধার্মিকদের বিশ্বাসের কথিত স্রষ্টার অস্তিত্বের ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন তোলে। তারা বলে, যদি আল্লাহ আদি হন, তাহলে তারও কি কোনো স্রষ্টা নেই? স্রষ্টা ছাড়া তার উদ্ভব হল কীভাবে? আল্লাহ কী তার কোন স্রষ্টাতে বিশ্বাস করেন না? তিনি কী নাস্তিক? তিনি কীভাবে বুঝলেন, তার কোন স্রষ্টা নেই? তিনিও হয়তো মায়ের পেটের শিশুর মত, তার জগতকেই সে একমাত্র জগত ভেবে ভুল করছে। তার জগতের বাইরে হয়তো আরেকটি জগত রয়েছে! তার মৃত্যুর পরে হয়তো কাল্লাহ নামক এক সত্ত্বা পর-পরকালে তার বিচার করবে। অর্থাৎ, আস্তিকদের তৈরি যমজ বাচ্চাদের গল্পটি তো আল্লাহর ক্ষেত্রেও ব্যবহার যোগ্য। অন্যদিকে বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করে, আল্লাহ আদি, তিনি সৃষ্টির মূল কারণ। সে এমনি এমনি হয়ে গেছে। তার অস্তিত্ব এমনি এমনিতেই হয়েছে, কোন কারণ ছাড়া! সে হিসেবে, আল্লাহও একজন নাস্তিক! এবং এরপরে আবার সেই যমজ বাচ্চাদের গল্পটি শুরু হবে।