সাম্প্রতিককালে, অনেকেই দাবি করছেন যে কুরআনের নবম সূরা, আত-তাওবা, কেবল যুদ্ধের সময় প্রযোজ্য, শান্তিকালে নয়। এই দাবিটি কতটা সত্য? আসলেই কি সূরা তওবা যুদ্ধের সময় অবতীর্ণ হয়েছিল, নাকি সম্পূর্ণ শাস্তির সময়? এই বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝতে হলে, আমাদের সূরা তাওবার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মুমিনদের একজন প্রিয় লেখক আরিফ আজাদ তার বইতে এই সম্পর্কিত একটি মিথ্যা তথ্য লেখার পরে থেকেই, মুমিনদের মধ্যে এই ধারণাটি জনপ্রিয়তা পায়। আরিফ আজাদ লিখেছে, এই আয়াত নাকি নাজিল হয়েছিল যুদ্ধের উত্তপ্ত সময়ে! কিন্তু এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা। তাই আসুন শুরুতেই প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ ২ বইয়ের এই দাবীটি দেখে নেয়া যাক, [1]
এই আয়াতটির নাজিলের সময়কাল হচ্ছে যুদ্ধ পরবর্তী সময়, মক্কা বিজয়ের পর ৯ম হিজরীর জিলক্বদ মাসে। যখন কারো সাথেই মুসলিমদের উত্তপ্ত যুদ্ধ চলছিল না। সেই সময়ে হযরত মুহাম্মদ হযরত আবু বকরকে হজ্জের আমীর নির্বাচন করে প্রেরণ করেন, যাতে তিনি শরীয়তের বিধান অনুযায়ী লোকজনের হজ্জ আদায়ের ব্যবস্থা করেন। সেই সময়ই চুক্তি ভঙ্গ করার ব্যাপারে সূরা তাওবা বা সুরা বারা’আতের যে চল্লিশ আয়াত নাযিল হয়েছে তা ঘোষণা করেন। এই আয়াত সমূহে এই বিষয়গুলো স্পষ্টভাবেই উল্লেখ ছিল যে, এ বছরের পর মুশরিকরা মসজিদে হারামে প্রবেশ করতে পারবে না, উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করতে পারবে না, যার সাথে আল্লাহর রাসূল কোনো চুক্তি করেছেন তা ঐ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পূর্ণ করা হবে, যাদের সাথে চুক্তি নেই তাদেরকে ইয়াওমুন নাহার বা কুরবানির দিন থেকে চার মাসের সুযোগ দেয়া হলো- যদি এ সময়ের মধ্যে ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে এ সময়ের পর যেখানে পাওয়া যাবে হত্যা করা হবে। অর্থাৎ এই সুরাটি হচ্ছে মুশরিকদের সাথে সম্পস্ত চুক্তি ভঙ্গের সরাসরি আদেশ, চার মাস অতিক্রম হয়ে গেলে সকল মুশরিককে যেখানে পাওয়া যাবে হত্যা করার সুস্পষ্ট বিধান। হযরত আলী আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় হযরত আবু বকরকে হজ্বের আমীর নির্ধারণ করে হযরত মুহাম্মদ হযরত আলীকে দিয়ে এ ঘোষণা দেয়ান। তথ্যসূত্র উল্লেখ করলেই ব্যাপারটি বুঝতে পারবেন, আয়াতটি নাজিলের কারণ এবং প্রেক্ষাপট। [2]
অর্থাৎ, এই আয়াত নাজিল কখনই যুদ্ধকালীন উত্তপ্ত অবস্থায় নয়, বরঞ্চ মক্কা বিজয়ের পরে চুক্তি না থাকা অথবা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া মুশরিকদের মক্কা থেকে বিতাড়িত করার নির্দেশ। ঐ সময় অতিক্রম হওয়ার পরে তাদের যেখানে পাওয়া যাবে জবাই করার সরাসরি হুমকি। আয়াতগুলো নিয়ে আরিফ আজাদ একেবারেই নির্লজ্জ পর্যায়ের মিথ্যাচার করে মিথ্যাচারের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন। আরিফ আজাদ সহ সকল ইসলামিক এপোলোজিস্টকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলতে চাই, ওই আয়াতগুলো কখনই যুদ্ধকালীন শত্রুর মুখোমুখী অবস্থায় নাজিল হওয়া আয়াত নয়। ওগুলো যুদ্ধের পরে মুশরেকদের মক্কা থেকে বিতাড়িত করার, চুক্তি যাদের সাথে আছে তাদের সময় বেঁধে দেয়ার, এবং নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের যেখানেই পাওয়া যাবে হত্যা করার সুনির্দিষ্ট আয়াত। এই নিয়ে যারা মিথ্যাচার করবে, তারা প্রকারান্তরে নাস্তিকদের জবাব দিতে গিয়ে আসলে ইসলামেরই মূল ইমান আকিদারই অবমাননা করবে। আসুন ইবনে কাসীরের সবচাইতে প্রখ্যাত তাফসীরে দেখি, সুরা তওবা কবে কোন পরিস্থিতিতে নাজিল হয়েছিল! শত্রুর মুখোমুখী যুদ্ধের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে, নাকি মক্কা বিজয়ের পরে কোন যুদ্ধ ছাড়াই? ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত তাফসীরে ইবনে কাসীরের সবগুলো খণ্ড ডাউনলোড করতে পারেন। [3]
এবারে আসুন ইসলাম হাউজ থেকে প্রকাশিত ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া সম্পাদিত সূরা আত-তওবার তাফসীর গ্রন্থ থেকে একটি পাতা পড়ে নিই, যেখানে খুব পরিষ্কারভাবে কাফেরদের সাথে চুক্তি ভঙ্গের কথা বলা হয়েছে [4]
তথ্যসূত্র
- প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ -২, আরিফ আজাদ, পৃষ্ঠা ৪৬ [↑]
- সীরাতুল মুস্তফা (সা), খণ্ড ৩ , পৃষ্ঠা ৯৯-১০০ [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) খণ্ড ৪ পৃষ্ঠা ৫১২-৫১৫, ৫২৫-৫২৭ [↑]
- সূরা আত-তওবার তাফসীর, ইসলাম হাউজ, সম্পাদনাঃ ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া, পৃষ্ঠা ১২ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"