ভূমিকা
চিকিৎসা পেশা মানবজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বপূর্ণ পেশাগুলোর একটি। একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব কেবল রোগ নিরাময়েই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মানবিকতা, নৈতিকতা এবং দায়িত্ববোধের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। চিকিৎসকদের জন্য প্রাচীনকাল থেকে কিছু নৈতিক নীতিমালা নির্ধারিত রয়েছে, যা তাঁদের আচরণ ও পেশাগত নৈতিকতাকে সংজ্ঞায়িত করে। চিকিৎসকদের এই নৈতিক শপথকে বলা হয় হিপোক্রেটিক শপথ (Hippocratic Oath)। শপথটি চিকিৎসকদের জন্য একটি গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে এবং তাঁদের পেশাগত নৈতিকতার মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
হিপোক্রেটিক শপথের ইতিহাস প্রায় ২,৫০০ বছর পুরনো। এটি প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটসের (Hippocrates) নামে নামকরণ করা হয়েছে, যিনি আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার জনক হিসেবে পরিচিত। যদিও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শপথটির ভাষা ও কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে, তবে এর মূল আদর্শ আজও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। চিকিৎসকদের কাছে এই শপথ শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি তাঁদের দায়িত্ব ও মূল্যবোধের প্রতীক।
হিপোক্রেটিক শপথের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
হিপোক্রেটিক শপথের উৎপত্তি হয় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে, যখন চিকিৎসাবিদ্যা ধীরে ধীরে বিজ্ঞানভিত্তিক ভিত্তি লাভ করছিল। হিপোক্রেটস ছিলেন একজন গ্রিক চিকিৎসক এবং দার্শনিক, যিনি তাঁর যুগের চিকিৎসকদের জন্য একটি নৈতিক গাইডলাইন প্রস্তুত করেন। প্রাচীনকালে, চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল অনেকাংশেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু হিপোক্রেটস চিকিৎসাকে ধর্মীয় আচার ও প্রভাব মুক্ত করে একটি সেক্যুলার, বিজ্ঞানসম্মত এবং মানবিক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
হিপোক্রেটিক শপথ মূলত গ্রীক ভাষায় লিখিত হয়েছিল এবং এতে চিকিৎসকদের পেশাগত জীবন পরিচালনার জন্য কিছু মৌলিক নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথটি চিকিৎসকদের জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ যৌনরুচি নির্বিশেষে রোগীর কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত এবং এটি পরবর্তী যুগে চিকিৎসাবিদ্যার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
হিপোক্রেটিক শপথের মূল উপাদান
হিপোক্রেটিক শপথে সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে—
- রোগীর কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া – চিকিৎসকের প্রধান দায়িত্ব হলো রোগীর সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে তাঁকে সেবা প্রদান করা।
- কোনো রোগীকে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতি না করা – চিকিৎসকরা শপথ করেন যে তাঁরা কোনোভাবেই রোগীর ক্ষতি করবেন না (“Do no harm”)।
- রোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করা – একজন চিকিৎসক কখনোই তাঁর রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য তৃতীয় পক্ষের কাছে প্রকাশ করতে পারেন না, যতক্ষণ না তা রোগীর স্বার্থে প্রয়োজন হয়।
- নৈতিক ও মানবিকভাবে চিকিৎসা প্রদান করা – চিকিৎসকের কাছে সব রোগী সমান, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সবাইকে ন্যায়সঙ্গতভাবে চিকিৎসা প্রদান করা চিকিৎসকের দায়িত্ব। কোন অবস্থাতেই কোন চিকিৎসক রোগীর ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ কিংবা যৌনরুচির ওপর ভিত্তি করে কোন ধরণের বৈষম্য, কিংবা চিকিৎসা না করার মনোভাব প্রকাশ করতে পারবেন না।
- শিক্ষা ও জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো – চিকিৎসা বিদ্যা একটি ক্রমবিকাশশীল বিজ্ঞান, তাই চিকিৎসকদের নিয়মিতভাবে নতুন জ্ঞান অর্জন করতে হয় এবং তা পরবর্তী প্রজন্মের চিকিৎসকদের কাছে হস্তান্তর করতে হয়।
আধুনিক যুগে হিপোক্রেটিক শপথের পরিবর্তন
যদিও প্রাচীন হিপোক্রেটিক শপথ চিকিৎসকদের জন্য একটি নৈতিক আদর্শ নির্ধারণ করেছিল, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, বিজ্ঞান ও নৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের কারণে এর কিছু অংশ সংশোধন করা হয়েছে। আজকের দিনে অনেক মেডিকেল স্কুল হিপোক্রেটিক শপথের পরিবর্তিত সংস্করণ গ্রহণ করেছে, যেখানে আধুনিক চিকিৎসার চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউজেনিক্স বা অনৈতিক গবেষণার মতো বিষয়গুলো চিকিৎসকদের নৈতিকতার পরিপন্থী বলে বিবেচিত হয়, যা মূল শপথে উল্লেখ ছিল না।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা শিক্ষার্থীরা যে শপথ গ্রহণ করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো জেনেভা ঘোষণার শপথ (Declaration of Geneva), যা ১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত হয় এবং এতে হিপোক্রেটিক শপথের মূল চেতনাকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সমালোচনা ও বিতর্ক
হিপোক্রেটিক শপথের কিছু অংশ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিয়ে চিকিৎসক মহলে মতবিরোধ দেখা যায়—
- চিকিৎসকদের স্বার্থ ও রোগীর কল্যাণের দ্বন্দ্ব – কিছু চিকিৎসক মনে করেন, শপথের কিছু অংশ বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা কঠিন, বিশেষ করে যেখানে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
- ইউথানেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যু – প্রাচীন হিপোক্রেটিক শপথে বলা হয়েছে, “আমি কখনোই কাউকে প্রাণঘাতী ওষুধ দেব না,” কিন্তু আধুনিক সমাজে ইউথানেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যু কিছু দেশে বৈধ করা হয়েছে, যা চিকিৎসকদের জন্য নৈতিক দোটানার সৃষ্টি করে।
- গোপনীয়তার সীমারেখা – বর্তমান যুগে ডিজিটাল স্বাস্থ্য রেকর্ড ও রোগীর তথ্য সংরক্ষণ প্রযুক্তির কারণে গোপনীয়তা রক্ষা করা আগের মতো সহজ নয়, যা নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
উপসংহার
হিপোক্রেটিক শপথ চিকিৎসকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ও পেশাগত দিকনির্দেশনা, যা তাঁদের দায়িত্ব ও মূল্যবোধকে সংজ্ঞায়িত করে। চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা চিকিৎসকদের রোগীদের প্রতি মানবিক ও দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করতে উদ্বুদ্ধ করে। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শপথের ভাষা ও কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে, তবে এর মূল নৈতিক আদর্শ আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে নানাবিধ নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, যা চিকিৎসকদের নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে, চিকিৎসকের প্রধান দায়িত্ব সব সময়ই রোগীর কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখা। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে হিপোক্রেটিক শপথের পরিবর্তিত সংস্করণ অনুসরণ করা হয়, যা সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। তবে শপথের মূল আদর্শ—রোগীর কল্যাণ, গোপনীয়তা রক্ষা, এবং মানবিক চিকিৎসা প্রদান—চিকিৎসকদের পেশাগত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থেকে গেছে।
চিকিৎসকদের নৈতিকতা ও পেশাগত আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য হিপোক্রেটিক শপথ একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে। চিকিৎসকদের জন্য এটি শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি তাঁদের দায়িত্ববোধের প্রতিচ্ছবি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই শপথের ভাষা পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত চেতনা চিরকাল অপরিবর্তিত থাকবে।
তথ্যসূত্রঃ
১. Edelstein, Ludwig. The Hippocratic Oath: Text, Translation, and Interpretation. Johns Hopkins University Press, 1943.
২. Smith, Wesley D. Hippocrates: A Reference Guide to His Life and Works. Oxford University Press, 2020.
৩. World Medical Association. Declaration of Geneva.
৪. Miles, Steven H. The Hippocratic Oath and the Ethics of Medicine. Oxford University Press, 2004.
৫. Pellegrino, Edmund D. “The Medical Profession as a Moral Community,” Journal of the American Medical Association, Vol. 267, No. 15, 1992.