১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা নগরীতে একটি সভা বসে। এরপর ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৪টি সভা হয়। বর্তমানে জেনেভা কনভেনশন বলতে বুঝায় এই চারটি সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের সম্মিলিত রূপ। অবাক বিষয় হচ্ছে, মহাবিশ্বের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং অসীম দয়ালু আল্লাহ পাক এবং তার নবী দুইজন মিলেও, মানবিক মানুষের তৈরি করা এই জেনেভা কনভেনশনের খুব সাধারণ শর্তগুলো পূরণ করতে সক্ষম হন নি। তাহলে, আধুনিক মানবিক মানুষের মানবিক বোধ তো আল্লাহর চাইতেও বেশি বলেই মেনে নিতে হয়। অনেকেই বলতে পারেন, সেই সময়ে এরকমই পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক তো সময় বা স্থান দ্বারা সীমাবদ্ধ নন। উনি সময় ও স্থান কালের উর্ধ্বে। হয়তো সেই সময়ের আরবের বর্বর মানুষ মানবিকতার কিছুই জানতো না, সেই কারণে তারা অনেক আজেবাজে কাজই করেছে। কিন্তু আল্লাহ পাকের তো সেই সীমাবদ্ধতা ছিল না। তিনিও কেন এগুলো তার নবীকে করতে বললেন? পাঠকগণ জেনেভা কনভেনশনের কিছু ধারা পড়ে দেখুন-
- প্রথম জেনেভা কনভেনশন, ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দ। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত, যুদ্ধবন্দী, রোগাক্রান্ত সৈন্যদের জীবনের নিরাপত্তা এবং শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে প্রথম জেনেভা কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।
- দ্বিতীয় জেনেভা কনভেনশন, ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ। সমুদ্রস্থ যুদ্ধক্ষেত্রে আহত, রোগাক্রান্ত সৈন্যদের জীবনের নিরাপত্তা এবং শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে ২য় জেনেভা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
- তৃতীয় জেনেভা কনভেনশন, ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ। যুদ্ধবন্দীদের চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ৩য় জেনেভা কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ১২ আগষ্ট।
- চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধকালীন বেসামরিক জনগণকে রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনক্রমে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জেনেভা কনভেনশন কার্যকর হয়। এ কনভেনশন পূর্ববর্তী তিনটি কনভেনশনের সংশোধিত রূপ।
জেনেভা কনভেনশনের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ হচ্ছে,
পার্ট-১ : জেনারেল প্রোভিশান্স
- প্রথম অংশে জেনেভা কনভেনশনের সামগ্রিক গঠনপ্রণালী তথা আওতা বর্ণনা করা হয়েছে।
- ধারা ২- এ ধারায় বলা হয়েছে, স্বাক্ষরভূক্ত দেশ সমূহ এ কনভেনশন দ্বারা বাধ্য হয়েছে যে যুদ্ধকালীন এবং অস্ত্র সংঘাতের সময় যেখানে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, এমনকি অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবস্থান কালীন সময় জেনেভা কনভেনশনকে মেনে নেবে।
- ধারা ৩- এ বলা হয়েছে, যখন কোনো সংঘর্ষ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে স্বীকৃত হবে না, তখন প্রত্যেকটি দলের ন্যূনতম নিরাপত্তার অধিকার থাকবে। যেমন :- বেসামরিক ব্যক্তি বা যারা যোদ্ধা নয়, অস্ত্র পরিত্যাগকারী সৈন্য এবং ঐ সমস্ত সৈন্য যারা আহত বা রোগাক্রান্তের কারণে যুদ্ধ হতে বিরত।
এছাড়া অন্যান্য কারণে যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মানবীয় আচরণ প্রদর্শন করতে হবে। এবং নিম্ন বর্নিত বিষয় সমূহ হতে মুক্ত রাখতে হবে-
- (ক) ব্যক্তি এবং জীবনের প্রতি সহিংসতামূলক আচরণ: বিশেষ ধরনেরসহ সকল ধরনের হত্যা, শারীরিক নির্যাতন, অমানবিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং নির্যাতন।
- (খ) জিম্মি করে রাখা
- (গ) ব্যক্তি মর্যাদার ওপর অমানবিক আচরণ, অমানবিক চিকিৎসা প্রদান।
- (ঘ) মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা এবং বিচার বহির্ভূত অবস্থায় শাস্তি কার্যকর করা।
পার্ট-২ : বিশেষ যুদ্ধকালীন অবস্থায় সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা বা রক্ষণ।
ধারা ১৩ কনভেনশনের দ্বিতীয় অংশে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে একটি দেশের সমগ্র জনগণের নিরাপত্তা সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।
পার্ট-৩ : নিরাপত্তা প্রদানকৃত ব্যক্তিদের মর্যাদা ও চিকিৎসা
- ধারা ৩২ : নিরাপত্তা সহকারে আশ্রিত বা নিরাপত্তা প্রদানকৃত কোনো ব্যক্তি/ ব্যক্তিদেরকে শারীরিক নির্যাতন, গণহত্যা, হত্যা, শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি প্রভৃতি ধরনের অমানবিক নির্যাতন থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় হত্যা, নির্যাতন, দৈহিক শাস্তি, শারীরিক অপব্যবহার, শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি বা বিনাশ সাধনও করা যাবে না।
- ধারা ৩৩ : সমন্বিত শাস্তি ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সমন্বিত শাস্তি একটি যুদ্ধাপরাধ। এ কনভেনশনে বলা হয়েছে- “কোন আশ্রিত ব্যক্তিকে সামষ্ঠিক অপরাধ এমনকি ব্যক্তিগত অপরাধের জন্যও শাস্তি প্রদান করা যাবে না। সমন্বিত শাস্তি, এবং এর মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি ও সন্ত্রাসীমূলক আচরণ তাদের সাথে করা যাবেনা। লুটতরাজ নিষিদ্ধ এবং জীবন ও সম্পত্তির বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আচরণ করা যাবে না।”
- ধারা ৩৯ : ফিরে পাবার অধিকার ”যুদ্ধকালীন সময়ে যে সমস্ত জনগণ তাদের বাস্তু, দেশ ও সম্পদ ত্যাগ করে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে, অস্ত্র বিরতি বা স্থিতিশীলতার পরিবেশ সৃষ্টির পর তাদেরকে তাদের স্ব-অবস্থানে ফেরত নেয়া তাদের অধিকার।”
পার্ট-৪ : কনভেনশনের বাস্তবায়ন
এ অংশে আন্তর্জাতিক মানবহিতৈষী আইনের প্রাতিষ্ঠানিক বা কূটনীতিক অধ্যায়ের সংযোজন রয়েছে, সেই সাথে পারমানবিক, রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্রের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কথাও বলা হয়েছে।