04.অন্য উপাস্যদের গালি দেয়া নিষেধ?

ভূমিকা

অনেক মুমিন দাবি করেন যে, কোরআনের একটি আয়াতে [1] অন্য ধর্মের উপাস্যদের গালাগালি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা ইসলাম ধর্মের সহিষ্ণুতা ও সৌহার্দ্য প্রদর্শন করে। তবে এই দাবিটি একপাক্ষিক মিথ্যাচার এবং প্রেক্ষাপটের সম্পূর্ণ তথ্য তুলে ধরে না। ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপট বুঝলে বোঝা যায়, এই নিষেধাজ্ঞাটি কোনো মহানুভবতা বা অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য নয়, বরং পরিস্থিতিগত দুর্বলতার কারণে গ্রহণ করা একপ্রকার কৌশলগত সিদ্ধান্ত। ইসলামের ইতিহাসের একাধিক ঘটনা এবং তাফসীর গ্রন্থসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুহাম্মদ সেই সময়ের কাফেরদের উপাস্য দেবদেবীকে গালি দিতেন এবং তাদের অবমাননা করতেন। কিন্তু যখন মক্কার কাফেরগণ পাল্টা হুমকি দিল যে, তারা যদি তাদের দেবতাদের গালাগালি করা বন্ধ না করেন, তবে তারাও মুহাম্মদের আল্লাহকে গালি দেবে, তখন পরিস্থিতির চাপে এই আয়াতটি নাজিল হয়। এই প্রবন্ধে, আমরা এই ঘটনাটির প্রেক্ষাপট, মুহাম্মদের কাজের পেছনের কারণ এবং ইসলামিক শাসনের পরবর্তী পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করবো, যা এই দাবির প্রকৃত স্বরূপকে উন্মোচিত করবে।

আয়াতটির প্রেক্ষাপট

যে আয়াতটি মুমিনগণ প্রায়ই উল্লেখ করেন, তা হলো সূরা আন’আম, আয়াত ১০৮: “তোমরা তাদের (অন্য ধর্মাবলম্বীদের) মিথ্যা উপাস্যদের গালি দিয়ো না, যাতে তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি না দেয়।” প্রাথমিকভাবে দেখে মনে হতে পারে, আয়াতটি ইসলামের অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান করছে। কিন্তু তাফসীর ও ইসলামের প্রাচীন ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, মুহাম্মদ আগ বাড়িয়ে মক্কার কাফেরদের দেবদেবীকে গালিগালাজ করতেন, তাদের মূর্তিপূজাকে বিদ্রূপ করতেন এবং তাদের উপাস্যদের অসম্মান করতেন [2]। এই কারণে মক্কার কাফেররা মুহাম্মদকে হুমকি দেয় যে, যদি তিনি তাদের দেবতাদের অসম্মান করতে থাকেন, তবে তারাও মুহাম্মদের আল্লাহকে গালি দিবে। পরিস্থিতি তখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যে, মুহাম্মদ তাঁর নিজের আল্লাহর সম্মান রক্ষা করতে বাধ্য হন এবং এই গালাগালি বন্ধের নির্দেশ দেন।

আসুন সেই প্রেক্ষাপটটি জেনে নিই শায়খুল মুফাসসিরীন, ফক্বীহুল উম্মত আল্লামা ছানাউল্লাহ পানীপথীর তাফসীরে মাযহারী থেকে [3]

হজরত ইবনে আব্বাস থেকে বাগবী বর্ণনা করেছেন, যখন এই আয়াত “ইন্নাকুম ওয়ামা তা’বুদুনা মিন্দুনিল্লাহি হাসবু জাহান্নাম’ (নিশ্চয় তোমরা এবং আল্লাহকে ছেড়ে তোমরা যাদের উপাসনা করো— সকলে জাহান্নামের ইন্ধন) অবতীর্ণ হলো, তখন মুশরিকেরা বললো, হে মোহাম্মদ! আমাদের প্রভু প্রতিমাগুলোর দোষ বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকো। নইলে আমরাও তোমার প্রভুর দোষ বর্ণনা করবো। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে এই আয়াতটি। আয়াতের প্রথমেই বলা হয়েছে—‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা, তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞানতাবশতঃ আল্লাহকেও গালি দিবে।’
আল্লামা সুদ্দী বর্ণনা করেছেন, মৃত্যুর প্রাক্কালে আবু তালেবের নিকট উপস্থিত হলো কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ। বললো, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে আমাদের সঙ্গে বিবাদ করতে নিষেধ করে দিন। ভাবতে লজ্জা হয়, আপনার মৃত্যুর পর আমরা যদি মোহাম্মদকে হত্যা করি তবে লোকে বলবে তার চাচাই তাকে নিরাপদে রাখতো। এখন চাচা নেই বলে কাপুরুষেরা তাকে হত্যা করেছে। ওই নেতাদের দলে ছিলো আবু সুফিয়ান, আবু জেহেল, নজর বিন হারেস, উমাইয়া বিন খাল্‌ফ, উবাই বিন খাল্‌ফ, উকবা বিন আবী মুয়ীত, আমর ইবনে আস এবং আসওয়াদ বিন আবুল বুখতারী। তারা আরো বললো, আপনি আমাদের প্রিয় নেতা। কিন্তু মোহাম্মদ আমাদেরকে ও আমাদের পূজনীয় প্রতিমাগুলোকে কষ্ট দিচ্ছে। যদি আপনি পছন্দ করেন, তবে মোহাম্মদকে এ কাজ থেকে বিরত রাখুন। সে যেনো আমাদের দেবদেবীর বিরুদ্ধে কিছু না বলে। আমরাও তার আল্লাহ্ সম্পর্কে কিছু বলবো না ।
আবু তালেব রসুল স. কে ডেকে বললেন, তোমার সম্প্রদায়ের লোকদের ইচ্ছা— তুমি আমাদের ও আমাদের প্রভুদের সম্পর্কে আপত্তিকর কিছু বলবে না। আমরাও তোমার প্রভু সম্পর্কে কোনো অন্যায় মন্তব্য করবো না। আর এরা তো ন্যায্য কথাই বলছে। সুতরাং প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র আমার! তুমি এদের কথা মেনে নাও।
রসুল স. বললেন, তোমরা শুধু আমার একটি কথা মেনে নাও। মানলে তোমরা লাভ করবে সমগ্র আরবের কর্তৃত্ব। অনারবেরাও হয়ে যাবে তোমাদের নেতৃত্বের অধীন।। আবু জেহেল বললো, তোমার পিতার কসম! এরূপ একটি কথা কেনো দশটি কথা মানতে আমরা রাজী। রসুল স. বললেন, তোমরা কেবল বলো ‘লা
ইলাহা ইল্লাল্লহ্’। কিন্তু কুরায়েশ নেতারা এই পবিত্র কলেমা উচ্চারণ করতে অস্বীকৃত হলো এবং তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করলো সেখান থেকে। আবু তালেব বললেন, বৎস! তুমি এছাড়া অন্য কথা বলো— যা তারা মানতে পারে । রসুল স. বললেন, আমার এক হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি এ কথা বলা থেকে বিরত
তাফসীরে মাযহারী/২৭৯

থাকবো না। কুরায়েশ নেতারা নতুন করে প্রস্তাব দিলো, তুমি আমাদের প্রতিমাগুলোকে গালমন্দ করা থেকে বিরত থাকো। না হলে আমরা তোমাকে ও তোমার নির্দেশদাতাকে গালি দিবো। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হলো— আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে, তাদেরকে তোমরা গালি দিও না, কেননা, তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞানতাবশতঃ আল্লাহকেও গালি দিবে।
এই আয়াতে প্রকাশ্যতঃ অংশীবাদীদের দেবদেবীদেরকে মন্দ বলতে নিষেধ করা হয়েছে। এ রকম নির্দেশ দেয়া হয়েছে কেবল আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলকে গালমন্দ থেকে রক্ষা করার জন্য। কারণ অজ্ঞ ও অবাধ্যরা এতে করে আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলকে গালাগাল করবে। আয়াতের বর্ণনাদৃষ্টে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, চূড়ান্ত পর্যায়ের অবাধ্যদেরকে পরিত্যাগ করা অত্যাবশ্যক। তাদেরকে কিছু না বলাই উত্তম। সত্য মিথ্যার ন্যূনতমবোধও তাদের নেই ।
তাফসীরে মাযহারী/২৮০

গালি
গালি 1

এবারে এই আয়াতের তাফসীর দেখে নিই ইবনে কাসীরের তাফসীর থেকে [4] । ইবনে কাসীরের তাফসির থেকেও যা জানা যায় তা হচ্ছে, মুসলিমরাই আগে পৌত্তলিকদের প্রতিমাগুলোকে গালাগালি শুরু করে। তখন বাধ্য হয়ে পৌত্তলিক কোরাইশরা মুহাম্মদের চাচা আবু তালিবের কাছে বিচার দেয়, এবং তাদের দেবদেবীকে গালি দিতে নিষেধ করে। সেই সাথে এটিও হুমকি দেয়, মুহাম্মদ তাদের দেবদেবীকে গালি দিলে তারাও মুহাম্মদের আল্লাহকে গালি দিবে। তখন নিতান্তই বাধ্য হয়ে, তাফসীরের ভাষ্য অনুসারে “উপকার থাকা সত্ত্বেও” কাফেরদের প্রতিমাগুলোকে গালি দেয়া থেকে বিরত থাকার আয়াত নাজিল হয়, যেহেতু সেই সময়ে মুসলিমরা সংখ্যালঘু ছিল!

গালি 3
গালি 5

মুহাম্মদের সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ

এই আয়াতের প্রেক্ষাপট থেকে স্পষ্ট হয় যে, এটি মুহাম্মদের আধ্যাত্মিক উচ্চমনের পরিচায়ক নয়; বরং পরিস্থিতিগত চাপের ফলাফল। মুহাম্মদ তার অনুসারীদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন, কারণ তিনি চাননি মক্কার পৌত্তলিকরা আল্লাহকে গালি দিক। এটি সম্পূর্ণভাবে নিজ ধর্মের সম্মান রক্ষা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নেওয়া একটি কৌশল ছিল। অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বা তাদের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

যদি মুহাম্মদ নিজে থেকেই অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে চাইতেন, তবে তিনি প্রথম থেকেই মক্কার দেবতাদের গালাগালি করা থেকে বিরত থাকতেন। তার কাজের উদ্দেশ্য ছিল তার আল্লাহকে অসম্মান থেকে রক্ষা করা, এবং কোনোক্রমেই কাফেরদের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা নয়। এই আয়াতটি নাজিল হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল মক্কার পৌত্তলিকদের প্রতিক্রিয়া রোধ করা, যাতে তারা পাল্টা মুহাম্মদের আল্লাহকে গালি না দেয়। এই বিষয়টি বোঝা যায় মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের পরে, মুহাম্মদের সম্মুখেই আবু বকরের নোংরা গালাগালি শুনলে।

আসুন সেই বিষয়টি এবারে পড়ে নেয়া যাক। নিচের হাদিস পড়ুন, যেই হাদিসটির সময়কাল হচ্ছে মক্কা থেকে হিজরতের পরে। অর্থাৎ সূরা আনআ’ম এর ওই আয়াতটি নাজিলের অনেক পরের ঘটনা। হাদিস থেকে জানা যায়, নবী মুহাম্মদের সম্মুখেই আবু বকর কাফেরদের দেবদেবী নিয়ে অত্যন্ত অশালীন এবং কুরুচিপূর্ণ গালাগালি করতেন। নবীরও সেখানে নিরব সম্মতি ছিল, নইলে নবী আবু বকরকে তখনই থামাতেন। ফাতহুল বারী গ্রন্থের লেখক ইবনু হাজার আসকালানি এই হাদিসের ব্যাখ্যাতে বলেন, নবী সেই সময়ে আবু বকরের এই কাজে নিরব সম্মতি জানিয়েছিলেন [5]। এই হাদিসটি অত্যন্ত দীর্ঘ বিধায় কিছু অংশ এখানে দেয়া হচ্ছে, আগ্রহী পাঠকগণ বাদবাকি অংশ মূল বই থেকে পড়ে নিতে পারেন। কাফেরদের সাথে যত শত্রুতাই থাকুক না কেন, যত যুদ্ধই হোক না কেন, কাফেরদের দেবদেবী বা ধর্ম নিয়ে এরকম অবমাননাকর, নোংরা এবং কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য কোন সভ্য মানুষ কীভাবে বলতে পারে? [6] [7]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪৬/ শর্তাবলী
পরিচ্ছেদঃ ১৭০১. যুদ্ধরত কাফিরদের সাথে জিহাদ ও সন্ধির ব্যাপারে শর্তারোপ এবং লোকদের সাথে কৃত মৌখিক শর্ত লিপিবদ্ধ করা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ২৫৪৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৭৩১ – ২৭৩৩
২৫৪৭। …
তখন আবূ বকর (রাঃ) তাকে বললেন, তুমি লাত দেবীর লজ্জাস্থান চেটে খাও। আমরা কি তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যাব?

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ মারওয়ান ইবনু হাকাম (রহঃ)

গালি 7

ক্ষমতা পাওয়ার পর মুহাম্মদের অবস্থান

প্রাথমিক অবস্থায়, যখন মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীরা মক্কায় দুর্বল অবস্থানে ছিলেন, তখন তিনি কৌশলগতভাবে সহিষ্ণুতার বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু যখন তিনি মক্কা বিজয় করেন এবং তাঁর হাতে পূর্ণ ক্ষমতা আসে, তখন তাঁর অবস্থান সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। সহিষ্ণুতা ও সম্মান প্রদর্শনের সেই মিথ্যা আড়াল মুহূর্তেই ভেঙে যায়। তিনি মক্কার সমস্ত মূর্তি ও দেবদেবীর মন্দির ধ্বংস করেন এবং সেইসব ধর্মীয় উপাস্যদের প্রতি কোনো সম্মান দেখাননি। তার আদেশে মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হয় এবং উপাস্য মন্দিরগুলোকে ধ্বংস করে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, প্রাথমিক অবস্থায় এই আয়াতটি ছিল শুধুমাত্র কৌশলগত এক পদক্ষেপ, যা মূলত শক্তি অর্জনের পরপরই বাতিল হয়ে যায়।

মক্কাবিজয়ের পরে অর্থাৎ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার পরে মুহাম্মদ দলবল পাঠিয়ে কোন পূর্ব শত্রুতা ছাড়াই অসংখ্য দেবদেবীর মুর্তি এবং উপাসনালয় ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছেন, এরকম উদাহরণ অনেকগুলোই আছে। আসুন আর-রাহীকুল মাখতূম থেকে পড়ি, সেখানে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে সৈন্য পাঠিয়ে নবী মূর্তি, উপাসনালয় এবং সেই সব মূর্তির পুজা কারী মানুষদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করতেন। এমনকি মহিলাদেরও বাদ দিতেন না। অবস্থা এমন খারাপ হয়েছিল যে, নবী নিজেই খালিদ বিন ওয়ালিদের ওপর এত হত্যাকাণ্ড দেখে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাহলে অন্য উপাস্যদের গালি দেয়া যাবে না, এরকম কথা কতটুকু অর্থবহন করে? যারা বলেন, অন্য উপাস্যদের ইসলামে গালি দিতে নিষেধ করা হয়েছে, তারা কী বলতে চান, গালি দেয়া নিষেধ তবে সেইসব মূর্তি ভাঙ্গা জায়েজ? [8]

বিভিন্ন অভিযান ও প্রতিনিধি প্রেরণ (السَّرَايَا وَالْبُعُوْثِ):
১. মক্কা বিজয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কাজকর্ম সুসম্পন্ন করার পর যখন তিনি কিছুটা অবকাশ লাভ করলেন তখন ৮ম হিজরীর ২৫ রমযান উযযা নামক দেব মূর্তি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে একটি ছোট সৈন্যদল প্রেরণ করলেন। উযযা মূর্তির মন্দিরটি ছিল নাখলা নামক স্থানে। এটি ভেঙ্গে ফেলে খালিদ (রাঃ) প্রত্যাবর্তন করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,‏ (‏هَلْ رَأَيْتَ شَيْئًا‏؟‏‏)‏‘তুমি কি কিছু দেখেছিলে?’ খালিদ (রাঃ) বললেন, ‘না’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করলেন, ‏(‏فَإِنَّكَ لَمْ تَهْدِمْهَا فَارْجِعْ إِلَيْهَا فَاهْدِمْهَا‏)‏ ‘তাহলে প্রকৃতপক্ষে তুমি তা ভাঙ্গ নি। পুনরায় যাও এবং তা ভেঙ্গে দাও।’ উত্তেজিত খালিদ (রাঃ) কোষমুক্ত তরবারি হস্তে পনুরায় সেখানে গমন করলেন। এবারে বিক্ষিপ্ত ও বিস্ত্রস্ত চুলবিশিষ্ট এক মহিলা তাঁদের দিকে বের হয়ে এল। মন্দির প্রহরী তাকে চিৎকার করে ডাকতে লাগল। কিন্তু এমন সময় খালিদ (রাঃ) তরবারি দ্বারা তাকে এতই জোরে আঘাত করলেন যে, তার দেহ দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তিনি এ সংবাদ অবগত করালে তিনি বললেন, ‏(‏نَعَمْ، تِلْكَ الْعُزّٰى، وَقَدْ أَيِسَتْ أَنْ تَعْبُدَ فِيْ بِلَادِكُمْ أَبَدًا‏) ‘হ্যাঁ’, সেটাই ছিল উযযা। এখন তোমাদের দেশে তার পূজা অর্চনার ব্যাপারে সে নিরাশ হয়ে পড়েছে (অর্থাৎ কোন দিন তার আর পূজা অর্চনা হবে না)।
২. এরপর নাবী কারীম (সাঃ) সে মাসেই ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ)-কে ‘সুওয়া’ নামক দেবমূর্তি ভাঙ্গার জন্য প্রেরণ করেন। এ মূর্তিটি ছিল মক্কা হতে তিন মাইল দূরত্বে ‘রিহাত’ নামক স্থানে বনু হুযাইলের একটি দেবমূর্তি। ‘আমর যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছেন তখন প্রহরী জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কী চাও?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর নাবী (সাঃ) এ মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার জন্য আমাদের নির্দেশ প্রদান করেছেন।’
সে বলল, ‘তোমরা এ মূর্তি ভেঙ্গে ফেলতে পারবে না।’
‘আমর (রাঃ) বললেন, ‘কেন?’
সে বলল, ‘প্রাকৃতিক নিয়মেই তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হবে।’
‘আমর (রাঃ) বললেন, ‘তোমরা এখনও বাতিলের উপর রয়েছ? তোমাদের উপর দুঃখ, এই মূর্তিটি কি দেখে কিংবা শোনে?’
অতঃপর
মূর্তিটির নিকট গিয়ে তিনি তা ভেঙ্গে ফেললেন এবং সঙ্গীসাথীদের নির্দেশ প্রদান করলেন ধন ভান্ডার গৃহটি ভেঙ্গে ফেলতে। কিন্তু ধন-ভান্ডার থেকে কিছুই পাওয়া গেল না। অতঃপর তিনি প্রহরীকে বললেন, ‘বল, কেমন হল?’
সে বলল, ‘আল্লাহর দ্বীন ইসলাম আমি গ্রহণ করলাম।’
৩. এ মাসেই সা‘দ বিন যায়দ আশহালী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে বিশ জন ঘোড়সওয়ার সৈন্য প্রেরণ করেন মানাত দেবমূর্তি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। কুদাইদের নিকট মুশাল্লাল নামক স্থানে আওস, খাযরাজ, গাসসান এবং অন্যান্য গোত্রের উপাস্য ছিল এ ‘মানত’ মূর্তি। সা‘দ (রাঃ)-এর বাহিনী যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছেন তখন মন্দিরের প্রহরী বলল, ‘তোমরা কী চাও?’
তাঁরা বললেন,
‘মানাত দেবমূর্তি ভেঙ্গে ফেলার উদ্দেশ্যে আমরা এখানে এসেছি।’
সে বলল, ‘তোমরা জান এবং তোমাদের কার্য জানে।’
সা‘দ মানাত মূর্তির দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে
একজন উলঙ্গ কালো ও বিক্ষিপ্ত চুল বিশিষ্ট মহিলাকে বেরিয়ে আসতে দেখতে পেলেন। সে আপন বক্ষদেশ চাপড়াতে চাপড়াতে হায়! রব উচ্চারণ করছিল।
প্রহরী তাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মানাত! তুমি এ অবাধ্যদের ধ্বংস কর।’
কিন্তু
এমন সময় সা‘দ তরবারির আঘাতে তাকে হত্যা করলেন। অতঃপর মূর্তিটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিলেন। ধন-ভান্ডারে ধন-দৌলত কিছুই পাওয়া যায় নি।
৪. উযযা নামক দেবমূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলার পর খালিদ বিন ওয়ালীদ (সাঃ) প্রত্যাবর্তন করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ৮ম হিজরী শাওয়াল মাসেই বনু জাযামাহ গোত্রের নিকট তাঁকে প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণ না করে ইসলাম প্রচার। খালিদ (রাঃ) মুহাজির, আনসার এবং বনু সুলাইম গোত্রের সাড়ে তিনশ লোকজনসহ বনু জাযীমাহর নিকট গিয়ে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। তারা (ইসলাম গ্রহণ করেছি) বলার পরিবর্তে (আমরা স্বধর্ম ত্যাগ করেছি, আমরা স্বধর্ম ত্যাগ করেছি) বলল। এ কারণে খালিদ (রাঃ) তাদের হত্যা এবং বন্দী করতে আদেশ দিলেন। তিনি সঙ্গী সাথীদের এক একজনের হস্তে এক এক জন বন্দীকে সমর্পণ করলেন। অতঃপর এ বলে নির্দেশ প্রদান করলেন যে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁর নিকটে সমর্পিত বন্দীকে হত্যা করবে। কিন্তু ইবনু উমার এবং তাঁর সঙ্গীগণ এ নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। অতঃপর যখন নাবী কারীম (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হলেন তখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন। তিনি দু’ হাত উত্তোলন করে দু’বার বললেন, ‏(‏اللهم إِنِّيْ أَبْرَأُ إِلَيْكَ مِمَّا صَنَعَ خَالِدًا) ‘হে আল্লাহ! খালিদ যা করেছে আমি তা হতে তোমার নিকটে নিজেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করছি।’(1)
এ পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র বনু সুলাইম গোত্রের লোকজনই নিজ বন্দীদের হত্যা করেছিল। আনসার ও মহাজিরীনগণ হত্যা করেন নি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে প্রেরণ করে তাদের নিহত ব্যক্তিদের শোণিত খেসারত এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন। এ ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করে খালিদ (রাঃ) ও আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ)-এর মাঝে কিছু উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং সম্পর্কের অবণতি হয়েছিল। এ সংবাদ অবগত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,
‏(‏مَهَلًّا يَا خَالِدُ، دَعْ عَنْكَ أَصْحَابِيْ، فَوَاللهِ لَوْ كَانَ أَحَدٌ ذَهَبًا، ثُمَّ أَنْفَقَتْهُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ مَا أَدْرَكَتْ غُدْوَةَ رَجُلٍ مِّنْ أَصْحَابِيْ وَلَا رَوْحَتَهُ‏)‏‏
‘খালিদ থেমে যাও, আমার সহচরদের কিছু বলা হতে বিরত থাক। আল্লাহর কসম! যদি উহুদ পাহাড় সোনা হয়ে যায় এবং তার সমস্তই তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করে দাও তবুও আমার সাহাবাদের মধ্য হতে কোন এক জনেরও এক সকাল কিংবা এক সন্ধ্যার ইবাদতের নেকী অর্জন করতে পারবে না।(2)

নবীর মূর্তি ধংস
নবীর বর্বরতা

শুধু এইটুকুতেই শেষ নয়। আলীর প্রতি এবং পরবর্তীদের প্রতি নবীর নির্দেশও আমরা দেখে নিই [9]

সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১০/ কাফন-দাফন
পরিচ্ছেদঃ কবর সমান করে দেওয়া।
১০৪৯. মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার (রহঃ) ….. আবূ ওয়াইল (রহঃ) থেকে বর্ণিত যে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু আবূল- হায়্যাজ আল-আসা’দী (রহঃ) কে বলেছিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন, আমি তোমাকেও সেই দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করছি। তা হলো, কোন উঁচু কবরকে (মাটি) সমান করা ব্যতীত ছাড়বেনা, আর কোন প্রতিকৃতি বিধ্বংস করা ব্যতীত ছাড়বে না। – আল আহকাম ২০৭, ইরওয়া ৭৫৯, তাহযীরুস সাজিদ ১৩০, মুসলিম, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ১০৪৯ [আল মাদানী প্রকাশনী]
এই বিষয়ে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও হাদীস বর্ণিত রয়েছে। ইমাম আবূ ঈসা (রহঃ) বলেন, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসটি হাসান। কোন কোন আলিম এতদনুসারে আমল করেছেন। তারা যমীনের উপর কবর উচূঁ করে বাঁধা অপছন্দনীয় বলে মনে করেন। ইমাম শাফিঈ (রহঃ) বলেন, যতটুকু উঁচু করলে এটিকে কবর বলে চিনা যায় তদপেক্ষা কবরকে উঁচু করা আমি পছন্দ করি না। তবে চি‎হ্নস্বরূপ কিছু উঁচু করার দরকার এই জন্য যে, এটিকে যেন কেউ পদদলিত না করে বা এর উপর যেন কেউ না বসে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ ওয়াইল (রহঃ)

ধর্মীয় কাহিনীর যৌক্তিক অসঙ্গতি

এই ঘটনা ধর্মীয় কাহিনীর যৌক্তিক অসঙ্গতি এবং মুহাম্মদের সিদ্ধান্তের পিছনের প্রকৃত উদ্দেশ্য তুলে ধরে। যদি মুহাম্মদ সত্যিই অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের পক্ষপাতী হতেন, তবে তার আচরণ শুধু দুর্বল অবস্থায় নয়, বরং ক্ষমতার শীর্ষে থাকাকালীনও সেই একই থাকত। কিন্তু, মক্কা বিজয়ের পর তার আচরণে উল্টো চিত্র ফুটে ওঠে। দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস এবং মন্দিরগুলোর নিশ্চিহ্নকরণ তার মূল অবস্থানের পরিপন্থী প্রমাণ করে যে, প্রাথমিক অবস্থায় তাঁর সহিষ্ণুতা প্রদর্শন কেবলমাত্র পরিস্থিতিগত দুর্বলতার কারণে ছিল।

ধর্মীয় স্বার্থরক্ষার কৌশল

মুহাম্মদ এর প্রাথমিক নির্দেশনা এবং পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলি স্পষ্টতই কৌশলগত এবং পরিস্থিতিগত ছিল। ধর্মের নামে তার এইসব পদক্ষেপগুলো আসলে নিজের ধর্মীয় স্বার্থ রক্ষা এবং নিজেদের ধর্মের বিরোধীদের পরাজিত করার উদ্দেশ্যে করা। পরবর্তীতে যখন মুসলমানরা শক্তি অর্জন করে এবং মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অন্য ধর্মের প্রতি মুহাম্মদের অবস্থান সম্পূর্ণ বদলে যায়। এই পরিবর্তন প্রমাণ করে যে, তার নির্দেশনার পেছনে যে সহিষ্ণুতা ও সৌহার্দ্য প্রদর্শনের যে বার্তা ছিল, তা প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার অভাবের কারণে ছিল, এবং প্রকৃত অর্থে অন্য ধর্মের প্রতি তার সম্মান প্রদর্শনের অভিপ্রায় ছিল না।

উপসংহার

মুহাম্মদ এবং মক্কার কাফেরদের মধ্যে এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, প্রাথমিক অবস্থায় সহিষ্ণুতার বার্তা দেওয়া এবং পরে ক্ষমতা লাভের পর সেই সহিষ্ণুতার অভাব দেখানো এক ধরনের কৌশল ছিল। এটি ছিল পরিস্থিতির চাপে নেওয়া সিদ্ধান্ত, যা ক্ষমতা লাভের পরই বাতিল হয়ে যায়। আয়াতটির প্রেক্ষাপট এবং পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে স্পষ্ট হয় যে, এটি সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতার কোনো উদাহরণ নয়, বরং নিজ ধর্মের সম্মান রক্ষা করার জন্য এক রণকৌশল। তাই এই ঘটনা এবং কোরআনের ঐ আয়াতটি ধর্মীয় স্বার্থে গ্রহণ করা একটি কূটকৌশল এবং এটি ইসলামের সহিষ্ণুতার প্রমাণ দেয় না।


তথ্যসূত্র

  1. সূরা আনআ’ম, আয়াত ১০৮ []
  2. ধর্ম অবমাননা, সাম্প্রদায়িকতা এবং মূর্তি ভাঙ্গার সুন্নত  []
  3. তাফসীরে মাযহারী, হাকিমাবাদ খানকায়ে মোজাদ্দেদিয়া প্রকাশনী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭৮, ২৭৯, ২৮০ []
  4. তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৬৬, ৮৬৭[]
  5. Fath Al Bari 5/340 []
  6. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ২৫৪৭ []
  7. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪, হাদিসঃ ২৫৪৭ []
  8. আর-রাহীকুল মাখতূম, আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ), তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ৪৬৬, ৪৬৭ []
  9. সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), হাদিস নম্বরঃ ১০৪৯ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"