ইসলামের নবী মুহাম্মদের জীবদ্দশাতেই মক্কায় একজন চিকিৎসকের কথা জানা যায়, যিনি ভারতের গুন্দেশপুর এসেছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য। সেই চিকিৎসকের নাম ছিল হারিস ইবনে কালাদা। তিনি মুহাম্মদের আমলের একজন আরব চিকিৎসক। অসংখ্য ইসলামিক গ্রন্থে তার সম্পর্কে কিছু কিছু বিবরণ পাওয়া যায়, তবে বিস্তারিত জানা যায় না। এরকম হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, তিনি সেই সময়ে রীতিমত মানুষের চিকিৎসা করতেন এবং শরীর, স্বাস্থ্য, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ক পরামর্শ দিতেন এবং আলোচনা করতেন। আসুন উনার সম্পর্কে একটি ফতোয়া দেখি,
২১৯৯. প্রশ্ন
আমি একজন আলেমকে স্বাস্থ্য রক্ষার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নিম্নোক্ত হাদীসটি বলতে শুনেছি।
المعدة بيت الداء، والحمية رأس الدواء، وأعط كل بدن ما عودته
(অর্থাৎ) উদর হল সর্বরোগের কেন্দ্র। আর খাদ্য-সংযম সর্বরোগের মহৌষধ। দেহকে তা-ই দাও, যাতে তাকে অভ্যস্ত করেছ। জানার বিষয় হল, এটি কি হাদীস। হাদীস হলে তা কোন কিতাবে আছে? জানিয়ে উপকৃত করবেন।
উত্তর
প্রশ্নোক্ত কথাটি কোথাও হাদীস হিসেবে উল্লেখেতি হলেও হাদীস বিশারদগণ বলেছেন, এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস হিসেবে প্রমাণিত নয়; বরং তা আরবের প্রসিদ্ধ চিকিৎসক হারিস ইবনে কালদাহ-এর উক্তি।
অতএব তা হাদীস হিসেবে বর্ণনা করা যাবে না।
-আলমাকাসিদুল হাসানাহ পৃ. ৬১১; কাশফুল খাফা ২/৯৩; আদ্দুরারুল মুনতাছিরাহ ১৬৮; আল লাআলিল মানসুরাহ ১৪৫; আলফাওয়াইদুল মাজমূআহ ১৬৬; যাদুল মাসীর ৩/১৮৮; রুহুল মাআনী ৫/১১০; তাফসীরে কুরতুবী ৭/১৯২
শুধু তাই নয়, উনার সম্পর্কে কিছু জইফ হাদিসও পাওয়া যায়। জইফ হাদিসগুলো ( অর্থাৎ, এই হাদিসগুলোর বর্ণনাকারী রাবীদের ধারাবাহিকতায় কিছু ত্রুটি পাওয়া গেছে) সঠিক হয়ে থাকলে, মুহাম্মদ তার কাছে মানুষকে চিকিৎসা নেয়ার জন্য পাঠাতেন বলেই মনে হয়। উনি গ্রীসের চিকিৎসকদের গ্রন্থগুলো আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন বলেও কিছু কিছু সূত্র থেকে জানা যায়।
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব ২১: খাদ্য
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
৪২২৪-[৬৬] সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক সময় আমি মারাত্মকভাবে পীড়িত হয়ে পড়লাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার খোঁজ-খবর নিতে তাশরিফ আনলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের হাতখানা আমার দু’ স্তনের মাঝখানে (বুকের উপর) রাখলেন। তাতে আমি আমার কলিজায় শীতলতা অনুভব করলাম। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি একজন হৃদ-বেদনার রোগী। সুতরাং তুমি সাক্বীফ গোত্রীয় হারিস ইবনু কালদাহ্-এর নিকট যাও। সে একজন চিকিৎসক। পরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ সে যেন অবশ্যই মদীনার সাতটি ‘আজওয়াহ্ খেজুর বীচিসহ পিষে তোমার মুখের মধ্যে ঢেলে দেয়। (আবূ দাঊদ)[1]
[1] য‘ঈফ : আবূ দাঊদ ৩৮৭৫, য‘ঈফুল জামি‘উস্ সগীর ২০৩৩, আল মু‘জামুল কাবীর লিতু ত্ববারানী ৫৩৪৬, য‘ঈফুল জামি‘ ২০৩৩।
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ হলো মুজাহিদ সা‘দ হতে বর্ণনা করাটা মুরসাল। আবূ যুর্‘আহ্ আর্ রাযী এমনটিই বলেছেন। বিস্তারিত দেখুন- ‘আওনুল মা‘বূদ ১০/২৫৫ পৃঃ, হাঃ ৩৮৭৫।
হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai’f)
বর্ণনাকারীঃ সা’দ বিন আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ)
সূনান আবু দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২২/ চিকিৎসা
পরিচ্ছেদঃ ১২. আজওয়া খেজুর সম্পর্কে।
৩৮৩৫. ইসহাক ইবন ইসমাইল (রহঃ) …. সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একবার আমি পীড়িত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখার জন্য আসেন। এ সময় তিনি তাঁর হাত আমার বুকের উপর রাখলে আমি তাঁর শৈত্যতা আমার হৃদয়ে অনুভব করি। এরপর তিনি বলেনঃ তুমি হার্টের রুগী। কাজেই তুমি ছাকীফ গোত্রের অধিবাসী হারিছা ইবন কালদার নিকট যাও। কেননা, সে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। আর সে যেন মদীনার আজওয়া খেজুরের সাতটা খেজুর নিয়ে, তা বীচিসহ চূর্ণ করে তোমার জন্য তা দিয়ে সাতটি বড়ি তৈরী করে দেয়।
হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai’f)
বর্ণনাকারীঃ সা’দ বিন আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ)
একইসাথে সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়, নবী মুহাম্মদ তার অনুসারীদের হিন্দুস্থানের চন্দনকাঠ ঔষধ হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছিলেন। যা থেকে বোঝা যায়, ভারতের চন্দনকাঠ সেই সময়ে আরব অঞ্চলে খুব দামী এবং গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হিসেবে পরিগণিত হতো। তাই হিন্দুস্থানের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আরব অঞ্চলের মানুষের আগ্রহ ছিল, এটি মনে করা অস্বাভাবিক নয়।
সুনান আবূ দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২২/ চিকিৎসা
পরিচ্ছেদঃ ১৩. আংগুল দিয়ে গলা দাবানো সম্পর্কে।
৩৮৩৭. মুসাদ্দাদ ও হামিদ ইবন ইয়াহইয়া (রহঃ) …. উম্মু কায়স বিনত মিহসান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা আমি আমার এক ছেলেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট হাযির হই; যার গলা (অসুখের কারণে) আমি মালিশ করেছিলাম। তখন তিনি বলেনঃ তোমরা তোমাদের সন্তানদের গলার আসুখে কেন তাদের গলা মালিশ কর? বরং তোমাদের উচিত (এ রোগের জন্য) হিন্দুস্থানের চন্দনকাঠ ব্যবহার করা। কেননা, তাতে সাত ধরনের রোগ ভাল হয়, যার একটি হলো নিউমোনিয়া। গলা-ফুলা রোগে তা নাকের ছিদ্রে ব্যবহার করবে এবং নিউমোনিয়া হলে তা বড়ি বানিয়ে খাবে।
ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেনঃ চন্দন কাঠের অর্থ- তা চূর্ণ করে বড়ি বানিয়ে খাবে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উম্মু কায়স বিনত মিহসান (রাঃ)
এসব তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, নবী মুহাম্মদের সময় ভারত জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে ছিল, এবং বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ভারত আসতো। ভারত আসলে তারা নিশ্চিতিভাবে ভারতের সভ্যতার সাথেও পরিচিত ছিল। সেই কারণেই, ভারত আরব অঞ্চলের মানুষের জন্য ছিল একটি অত্যন্ত লোভনীয় জায়গা। নবী মুহাম্মদ একটি সহিহ হাদিসে ভারত আক্রমণকারীদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। অর্থাৎ নবীর উম্মতদের মধ্যে যারা ভারত আক্রমণ করবে, তারা যতবড় অপরাধই বা পাপীই হোক না কেন, সকল পাপ তাতে মুছে যাবে, এবং তারা জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পাবে। অথচ, ভারতের সাথে কিন্তু নবী মুহাম্মদের কোন শত্রুতাই ছিল না। ভারতের কেউ কোনদিন নবী মুহাম্মদের পাকা ধানে মইও দেয়নি। এই হাদিসে জিহাদ বলতে তাই আক্রমণাত্মক জিহাদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। আসুন হাদিসটি পড়ে নিই,
সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২৫/ জিহাদ
পরিচ্ছেদঃ ৪১. হিন্দুস্থানের জিহাদ
৩১৭৮. মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন আব্দুর রহীম (রহঃ) … রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গোলাম ছাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মতের দুটি দল আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে জাহান্নাম হতে পবিত্রাণ দান করবেন, একদল যারা হিন্দুস্থানের জিহাদ করবে, আর একদল যারা ঈসা ইবন মারিয়াম (আঃ) এর সঙ্গে থাকবে।
তাহক্বীকঃ সহীহ। সহীহাহ ১৯৩৪, সহীহ জামে’ আস-সগীর ৪০১২।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ সাওবান (রাঃ)
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে এই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাওয়া যায়, [1]
একইরকম বক্তব্য বর্ণিত আছে নুআইম বিন হাম্মাদের হাদিস সংকলন গ্রন্থে। যদিও এই হাদিস গ্রন্থে অনেক সমস্যা থাকার কথা ইসলামি আলেমগণ বলে থাকেন, কিন্তু একই বক্তব্য যেহেতু অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও পাওয়া যায়, তাই এই হাদিসগুলোকে সঠিক হিসেবেই গণ্য করতে হয় [2]
তথ্যসূত্র
- আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৩৩ [↑]
- কিতাবুল ফিতান, নুআইম বিন হাম্মাদ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"