ভূমিকা
ইসলাম ধর্মে হত্যা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকার দাবির নিয়ে প্রায়শই কুরআনের ৫:৩২ আয়াতটি উদ্ধৃত করা হয়। বলা হয় যে, এই আয়াতে মানবজীবনের মূল্য এবং তা রক্ষার ব্যাপারে ইসলামিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে আয়াতটির প্রকৃত অর্থ এবং প্রসঙ্গ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি মূলত ইসরায়েল বংশীয়দের জন্য প্রযোজ্য ছিল এবং তা একটি ইহুদি ধর্মগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। ইসলামী গ্রন্থসমূহে অনেক সময় এটি ভুলভাবে উপস্থাপিত হয় এবং এর প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে উদ্ধৃত করা হয়। এই আয়াতটি খুব ভালভাবে বিশ্লেষণ করলে এবং আয়াতটিতে ব্যবহৃত শব্দের অর্থগুলো ভালভাবে বুঝলে এর অর্থ খুব পরিষ্কার হয়ে যায়। আসুন সেই আয়াতটি শুরুতে পড়ে নেয়া যাক [1] ,
এ কারণেই আমি বানী ইসরাঈলের জন্য বিধান দিয়েছিলাম যে, যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা যমীনে সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করবে সে যেন তামাম মানুষকেই হত্যা করল। আর যে মানুষের প্রাণ বাঁচালো, সে যেন তামাম মানুষকে বাঁচালো। তাদের কাছে আমার রসূলগণ সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছিল, এরপরও তাদের অধিকাংশই পৃথিবীতে বাড়াবাড়িই করেছিল।
— Taisirul Quran
এ কারণেই আমি বানী ইসরাঈলের প্রতি এই নির্দেশ দিয়েছি যে, যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে অন্য প্রাণের বিনিময় ব্যতীত, কিংবা তার দ্বারা ভূ-পৃষ্ঠে কোন ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার ব্যতীত, তাহলে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করে ফেলল; আর যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে রক্ষা করল, তাহলে সে যেন সমস্ত মানুষকে রক্ষা করল; আর তাদের (বানী ইসরাঈলের) কাছে আমার বহু রাসূলও স্পষ্ট প্রমাণসমূহ নিয়ে আগমন করেছিল, তবু এর পরেও তন্মধ্য হতে অনেকেই ভূ-পৃষ্ঠে সীমা লংঘনকারী হয়ে গেছে।
— Sheikh Mujibur Rahman
এ কারণেই, আমি বনী ইসরাঈলের উপর এই হুকুম দিলাম যে, যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল। আর অবশ্যই তাদের নিকট আমার রাসূলগণ সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে। তা সত্ত্বেও এরপর যমীনে তাদের অনেকে অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারী।
— Rawai Al-bayan
এ কারণেই বনী ইসরাঈলের উপর এ বিধান দিলাম যে, নরহত্যা বা যমীনে ধ্বংসাত্মক কাজ করার কারণ ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে [১] সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করল [২], আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল [৩]। আর অবশ্যই তাদের কাছে আমার রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলেন, তারপর এদের অনেকে এরপরও যমীনে অবশ্যই সীমালংঘনকারী।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
তালমুদ আর তাওরাত
প্রথমেই জেনে নেয়া প্রয়োজন, এই আয়াতটি উৎস আসলে কোথায়। কুরআনের আয়াতটি সঠিকভাবে বোঝার জন্য এর পেছনের প্রেক্ষাপট জানা জরুরি, যা আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের গল্পের সাথে সম্পর্কিত। কাবিল তার ভাই হাবিলকে হত্যার পর এ বিধানটি ইহুদিদের জন্য একটি শিক্ষণীয় বার্তা হিসেবে এসেছে। আয়াতটি আসলে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তালমুদ থেকে গৃহীত, যা ছিল ইহুদি রাবাইদের লেখা।উল্লেখ্য, ইহুদিদের কাছে তালমুদ কোনো ঐশীগ্রন্থ নয়; এটি মূলত ইহুদি পণ্ডিতদের সংকলিত ব্যাখ্যা ও আইন, যা ইহুদি জীবনধারা এবং নৈতিকতার ওপর প্রভাব ফেলে। তাওরাত এবং তালমুদের মধ্যে পার্থক্য এখানে বোঝা খুব জরুরি। আব্রাহামিক ধর্ম মতে, তাওরাত আসলে ছিল ঈশ্বর থেকে প্রেরিত গ্রন্থ, আর তালমুদ হচ্ছে ইহুদি রাবাইদের লিখিত ব্যাখ্যা বা আইনগ্রন্থ। ঠিক যেমন ইসলামের কোরআন যা আল্লাহ প্রেরিত আর ও হাদিস যা মুহাম্মদ ও সাহাবীগণ বলে গেছে। ইসলামের নবী মুহাম্মদ সম্ভবত তাওরাত আর তালমুদের পার্থক্য জানতেন না, সেই কারণে তিনি কোরআনে আয়াত নাজিল করে ফেলেছেন এই বলে যে, আল্লাহ নাকি ইহুদিদের ওপর এই বিধানটি নাজিল করেছিল! অথচ, এই বিধানটি ইহুদিদের ঈশ্বর থেকে প্রাপ্ত কোন বিধান নয়।
কুরআনে এ আয়াতটি থেকে খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, ইসলামের আল্লাহ নিজেই জানতেন না যে, পূর্ব যুগে ইহুদিদের তিনি আসলে কী বিধান নাজিল করেছিলেন! এই আয়াতটি কোরআনে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বলা হয়েছে, ইহুদিদের জন্য এই বিধান দেয়া হয়েছিল যে, মানব হত্যা ভয়ঙ্কর অপরাধ। এটি ইসলামের সুনির্দিষ্ট বিধান নয়, বরং ইহুদি ঐতিহ্য থেকে নেওয়া একটি বক্তব্য, যেখানে আল্লাহ ভুল করে বলেন যে, তিনি নাকি এই বিধানটি ইহুদিদের জন্য পাঠিয়েছিলেন। যেখানে এই বিধানটি ইহুদি রাবাইদের দ্বারা লিখিত বলেই প্রমাণ মেলে। আসুন তালমুদে কী বলা ছিল তা দেখে নেয়া যাক,
“FOR THIS REASON WAS MAN CREATED ALONE, TO TEACH THEE THAT WHOSOEVER DESTROYS A SINGLE SOUL OF ISRAEL, SCRIPTURE IMPUTES [GUILT] TO HIM AS THOUGH HE HAD DESTROYED A COMPLETE WORLD; AND WHOSOEVER PRESERVES A SINGLE SOUL OF ISRAEL, SCRIPTURE ASCRIBES [MERIT] TO HIM AS THOUGH HE HAD PRESERVED A COMPLETE WORLD.”
পরবর্তী আয়াতের নির্দেশনা
কোরআনের এই আয়াতটি মূলত সহিংসতা পরিহার এবং মানব জীবনের মূল্য ও জীবন রক্ষার কথা বললেও, এর পরবর্তী আয়াতগুলোতে ইসলামী শাস্ত্রের কঠোরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আয়াত ৫:৩৩-৩৪-তে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, তাদের জন্য শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড, শূলে চড়ানো, হাত-পা কাটা বা দেশান্তরিত করা। ৩২, ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আয়াতের নির্দেশনা থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামে ‘ফিতনা’ বা ‘ফাসাদ’ সৃষ্টি করা সর্বোচ্চ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত, যার শাস্তি অনেক কঠোর। তাই ফিতনা ফ্যাসাদ আসলে কাকে বলে, তার সংজ্ঞা জানা এই আয়াতটি বোঝার জন্য সবচাইতে জরুরি। এবারে আসুন এরপরের আয়াতটিও পড়ে নিই, কারণ এই আয়াতটিতেও সেই একই শব্দ فَسَادًا বা ফ্যাসাদিন বা ফিতনা ফ্যাসাদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে [2]
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আর যমীনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে বেড়ায় তাদের শাস্তি হল এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে, অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। এ হল তাদের জন্য দুনিয়াতে লাঞ্ছনা, আর তাদের জন্য আখেরাতে রয়েছে মহাশাস্তি।
— Taisirul Quran
যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, আর ভূ-পৃষ্ঠে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শুলে চড়ান হবে, অথবা এক দিকের হাত ও অপর দিকের পা কেটে ফেলা হবে, অথবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে; এটাতো দুনিয়ায় তাদের জন্য ভীষণ অপমান, আর আখিরাতেও তাদের জন্য ভীষণ শাস্তি রয়েছে।
— Sheikh Mujibur Rahman
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং যমীনে ফাসাদ করে বেড়ায়, তাদের আযাব কেবল এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে কিংবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। এটি তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে মহাআযাব।
— Rawai Al-bayan
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় তাদের শাস্তি কেবল এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে বা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে বা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে বা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে [১]। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও আখেরাতে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে [২]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
ফিতনা ফ্যাসাদ কাকে বলে
‘ফাসাদ’ শব্দটি আরবি ভাষায় বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা, বা অনৈতিকতার প্রতীক। তবে ইসলামী আইনশাস্ত্রে এর সংজ্ঞা খুব বিস্তৃত। প্রাচীন তাফসিরগুলোতে দেখা যায় যে, ‘ফাসাদ’ শব্দটি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, পথ রোধ, সম্পদ লুণ্ঠন, এবং এমনকি ইসলাম থেকে সরে যাওয়ার সাথেও যুক্ত করা হয়েছে। ইবন কাসিরের তাফসিরে বলা হয়েছে, ‘ফাসাদ’ মানে আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতা, যা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। অতএব, এটি শুধুমাত্র যুদ্ধ ও হত্যার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং ধর্মীয় অনুশাসন না মানা এবং ঈমান থেকে সরে যাওয়া সম্পর্কেও এটি প্রযোজ্য।
এই আয়াতে যেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সেই শব্দটি হচ্ছে فَسَادٍۢ বা ফ্যাসাদিন অর্থাৎ ফিতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টির কারণ ব্যাতীত। ফিতনা ফ্যাসাদের ইসলামিক অর্থ আমরা একটু পরে জেনে নিবো। আপাতত জেনে নিই, ইসলামের দৃষ্টিতে সবচাইতে বড় অন্যায় বা অপরাধের কাজটি কী! আসুন কোরআনের কিছু আয়াত দেখে নিই, [3] [4]
স্মরণ কর, যখন লুকমান তার ছেলেকে নসীহত ক’রে বলেছিল- হে বৎস! আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শিরক কর না, শিরক হচ্ছে অবশ্যই বিরাট যুলম।
— Taisirul Quran
স্মরণ কর, যখন লুকমান উপদেশাচ্ছলে তার পুত্রকে বলেছিলঃ হে বৎস! আল্লাহর সাথে কোন শরীক করনা। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে চরম যুলম।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর স্মরণ কর, যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘প্রিয় বৎস, আল্লাহর সাথে শিরক করো না; নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলম’।
— Rawai Al-bayan
আর স্বরণ করুন যখন লুকমান উপদেশ দিতে গিয়ে তার পুত্রকে বলেছিল, ‘হে আমার প্রিয় বৎস! আল্লাহর সাথে কোনো শির্ক করো না। নিশ্চয় শির্ক বড় যুলুম [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে অংশী স্থাপনকারীকে ক্ষমা করবেননা এবং তদ্ব্যতীত যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং যে কেহ আল্লাহর অংশী স্থির করে সে মহাপাপে আবদ্ধ হল।
— Sheikh Mujibur Rahman
নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে।
— Rawai Al-bayan
নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক [১] করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন [২]। আর যে-ই আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে এক মহাপাপ রটনা করে।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
অর্থাৎ জানা গেল, ইসলামের দৃষ্টিতে সবচাইতে জঘন্য অপরাধ হচ্ছে শিরকের অপরাধ। একজন শিরককারী বিধর্মী তাই কোনভাবেই ইসলামের দৃষ্টিতে নিরাপরাধ নয়। এবারে আসুন পড়ে নিই, ফিতনা ফ্যাসাদ কাকে বলে। ইসলামের জিহাদের মূল ধারণা বোঝার জন্য শুরুতেই সূরা আনফালের ৩৯ নম্বর আয়াতটির তাফসীর পড়ে নিই। এই তাফসীরটি আপনারা পাবেন তাফসীরে মাযহারী পঞ্চম খণ্ডে। হানাফী মাযহাবের একনিষ্ঠ অনুসারী বিশ্ববিখ্যাত সুন্নি ইসলামী পন্ডিত আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথীর লেখা এই তাফসীর কোরআনকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ [5] –
এবং তোমরা তাহাদিগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে থাকিবে যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহের দ্বীন সামগ্রীকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যদি তাহারা বিরত হয় তবে তাহারা যাহা করে আল্লাহ্ তাহার সম্যক দ্রষ্টা।
যদি তাহারা মুখ ফিরায় তবে জানিয়া রাখ যে আল্লাহ্ই তোমাদিগের অভিভাবক এবং কত উত্তম অভিভাবক এবং কত উত্তম সাহায্যকারী ।
( সূরা আনফালঃ ৩৯, ৪০ )
প্রথমে বলা হয়েছে এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকবে যতক্ষণ না ফেতনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফেতনা অর্থ বিশৃংখলা। আর পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিশৃংখলা হচ্ছে শিরিক ( অংশীবাদিতা )। আলোচ্য বাক্যে ফেতনা অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কথার অর্থ-মুশরিকেরা যতক্ষণ পর্যন্ত শিরিক পরিত্যাগ না করবে, অথবা মুসলমানদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে জিযিয়া দিতে সম্মত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রাম করতে হবে তাদের বিরুদ্ধে। আলোচ্য নির্দেশনাটিতে এ রকম বলা হয়নি যে, সকল অংশীবাদী ও অবিশ্বাসীকে যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করতে হবে। এ রকম মনে করা হলে আলোচ্য আয়াতটি চলে যাবে জিযিয়া দিতে সম্মত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোরো না। সুতরাং – এই আয়াতের নির্দেশনাটি দাঁড়াচ্ছে এ রকম অবিশ্বাসীরা ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত অথবা জিযিয়া প্রদানের মাধ্যমে পূর্ণ অনুগত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এখানে দ্বীন প্রতিষ্ঠার অর্থ হবে শক্তি , বিজয় এবং একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা। ‘ দ্বীন ‘ শব্দের এ রকম অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে কামুস গ্রন্থে।
হজরত মেকদাদ বিন আসওয়াদ বর্ণনা করেছেন, রসুল স . বলেছেন, এক সময় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে পৃথিবীর সকল গৃহে। অবিশ্বাস ও অংশীবাদিতা হয়ে যাবে ইসলামের সম্পূর্ণ অধীন। সকল শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য হবে কেবল আল্লাহর।
হজরত ইবনে ওমর কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, রসুল স . বলেছেন, আমাকে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ওই সময় পর্যন্ত সংগ্রাম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে-যতক্ষণ না তারা বলে, ‘ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ’ প্রতিষ্ঠা করে নামাজ এবং প্রদান করে জাকাত। যে এ রকম করবে আমার পক্ষ থেকে তার জীবন ও সম্পদ হয়ে যাবে সুরক্ষিত। আল্লাহ্ই তাদের অভ্যন্তরীণ হিসাব গ্রহণ করবেন ( তিনি বিচার করবেন , তারা তাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্যে , না অন্তরের তাগিদে ইসলাম গ্রহণ করেছে )। বোখারী ও মুসলিম। হজরত আবু হোরায়রা থেকে ছয়জন সাহাবী হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। আল্লামা সুয়ুতী বলেছেন , হাদিসটি সুবিদিত ( মুতাওয়াতির )।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ইসলামের দৃষ্টিতে শিরক হচ্ছে সবচাইতে বড় ফেতনা, সবচাইতে বড় অপরাধ। তাই সূরা মায়িদার ৩২ নম্বর আয়াতটি কোনভাবেই একজন শিরককারী অমুসলিমের ওপর প্রযোজ্য হবে না। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে তারা শিরককারী, তাই সবচাইতে বড় ফিতনাবাজ। তারা ইসলামের দৃষ্টিতে নিরাপরাধ মানুষ হিসেবে গণ্য নয়। প্রখ্যাত বাংলাদেশের আলেম এবং ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম পণ্ডিত ড. আবু বকর মুহাম্মদ যাকারিয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত মো আব্দুল কাদেরের বই বাংলাদেশে প্রচলিত শির্ক বিদ‘আত ও কুসংস্কার পর্যালোচনা গ্রন্থে পরিষ্কারভাবেই বলা আছে যে, শিরক হচ্ছে হত্যাযোগ্য অপরাধ। যারা শিরক করে, তাদের রক্ত মুসলিমদের জন্য হালাল [6]।
উপসংহার
কুরআনের আয়াত ৫:৩২ প্রায়ই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয় এবং সাধারণভাবে মানবিক মূল্যবোধের উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তবে, এর প্রকৃত প্রসঙ্গ, ফিতনা ফ্যাসাদ শব্দটির অর্থ এবং এর সাথে যুক্ত কঠোর শাস্তির বিধানগুলোও বিবেচনা করা জরুরি। এটি স্পষ্ট করে যে, ইসলামে ‘ফাসাদ’ সৃষ্টির জন্য গুরুতর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, যা শুধু একটি মানবতা বিরোধী বার্তা দেয় না বরং একটি কঠোর আইনশাস্ত্রের অংশ হিসেবে কাজ করে। ইসলামী আইন এবং ধ্রুপদী তাফসিরের আলোকে কুরআনের আয়াতের প্রকৃত অর্থ ও প্রভাব সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়।
তথ্যসূত্র
- সূরা মায়িদা, আয়াত ৩২ [↑]
- সূরা মায়িদা, আয়াত ৩৩ [↑]
- সূরা লুকমান, আয়াত ১৩ [↑]
- সূরা নিসা, আয়াত ৪৮ [↑]
- তাফসীরে মাযহারী, হাকিমাবাদ খানকায়ে মোজাদ্দেদিয়া প্রকাশনী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৭-১২০ [↑]
- বাংলাদেশে প্রচলিত শির্ক বিদ‘আত ও কুসংস্কার পর্যালোচনা ২. শির্কের পরিণতি [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"