“অপ্রমাণের বোঝা কুযুক্তি” হচ্ছে একটি সাধারণ যুক্তির ত্রুটি বা কুযুক্তি, যেখানে কেউ কোন দাবী উত্থাপন করে কোন প্রমাণ সরবরাহ না করে অপর পক্ষকেই তার দাবীটি ভুল প্রমাণের জন্য উৎসাহিত করে, এবং সেটি করতে না পারলে তার দাবীটিকে মেনে নেয়ার আহবান জানায়। “অপ্রমাণের বোঝা কুযুক্তি” বা Burden of Proof বা “অপ্রমাণের বোঝা” যুক্তিবিদ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কুযুক্তি, যা সাধারণত বিতর্ক বা যুক্তি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এই কুযুক্তি দ্বারা বোঝা যায়, যে ব্যক্তি কোনো দাবী করছে, সেই ব্যক্তির ওপরই প্রমাণ উপস্থাপনের দায়িত্ব বর্তায়। অপরপক্ষকে তার দাবী অপ্রমাণ করতে হবে না। অর্থাৎ, দাবীকর্তারই তার বক্তব্যের যথার্থতা নিশ্চিত করতে হবে, প্রমাণ দিতে হবে যে তার দাবী সত্য।
ঘটনা-১
দাবী: আমি তোমার কাছে দশ লক্ষ টাকা পাই।
প্রশ্ন: টাকা যে পাও, তার প্রমাণ কী? কোনো কাগজপত্র বা এভিডেন্স আছে?
কুযুক্তি: আমি যে টাকা পাই না, তা কি তুমি প্রমাণ করতে পারবে?
এই ঘটনায় দাবী করা হয়েছে, “আমি তোমার কাছে দশ লক্ষ টাকা পাই।” সাধারণত এমন ধরনের আর্থিক দাবীতে চুক্তিপত্র বা অন্যান্য প্রমাণ থাকা উচিত। প্রশ্নকারী যুক্তিযুক্তভাবে প্রমাণের দাবী করছে—টাকা পাওয়ার কোনো লিখিত কাগজপত্র বা চুক্তি কি আছে?
দাবীকারী তার পক্ষের প্রমাণ না দিয়ে প্রশ্নকারীকে চ্যালেঞ্জ করছে, “আমি যে টাকা পাই না, তা কি তুমি প্রমাণ করতে পারবে?” এটি অপ্রমাণের বোঝা অন্যের ওপর চাপানোর একটি উদাহরণ। দাবীকর্তার উচিত তার দাবীকে প্রমাণ করা, কিন্তু তিনি প্রমাণের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন এবং অপ্রমাণের বোঝা অন্যের উপর চাপাচ্ছেন। অর্থাৎ, তার দাবি প্রমাণিত না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাবিটি বাতিল হবে।
ঘটনা-২
দাবী: আমি রোজ সকালে আকাশে উড়তে পারি।
প্রশ্ন: উড়তে পারো, তার প্রমাণ কী?
কুযুক্তি: আমি রোজ সকালে উড়তে যে পারি না, তা তুমি প্রমাণ করতে পারবে?
এখানেও দাবীকর্তা একটি অদ্ভুত ও অসম্ভব দাবি করেছেন—”আমি রোজ সকালে আকাশে উড়তে পারি।” প্রশ্নকারী যৌক্তিকভাবে প্রমাণের দাবী করেছে, যেমন উড়ার ছবি বা ভিডিও ইত্যাদি। কিন্তু দাবীকর্তা আবারো প্রমাণের দায়িত্ব অস্বীকার করে উল্টো প্রশ্ন করছে, “আমি উড়তে পারি না, তা তুমি প্রমাণ করতে পারবে?”
এটি স্পষ্টতই অপ্রমাণের বোঝা চাপানোর উদাহরণ। দাবীকর্তা অসাধারণ এক দাবি করছেন, কিন্তু সেটি প্রমাণের জন্য উপযুক্ত কোনো প্রমাণ দিচ্ছেন না। এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ যুক্তি কারণ অসাধারণ দাবি অসাধারণ প্রমাণের দাবী করে।
ঘটনা-৩
দাবী: স্যুপারম্যানের সাথে আমার প্রতিদিন কথা হয়।
প্রশ্ন: স্যুপারম্যান যে আছে, তার প্রমাণ কী?
কুযুক্তি: স্যুপারম্যান নেই, তা প্রমাণ করতে পারবে?
এই উদাহরণে দাবীকর্তা বলেছেন, “স্যুপারম্যানের সাথে প্রতিদিন কথা হয়।” এটি একটি কাল্পনিক চরিত্রের সাথে সম্পর্কিত দাবি, যা বাস্তবতার সাথে মেলে না। প্রশ্নকারী সঠিকভাবে জানতে চেয়েছে, “স্যুপারম্যান আছে, তার প্রমাণ কী?” কিন্তু দাবীকর্তা প্রমাণ না দিয়ে আবারও প্রশ্নকারীকে চ্যালেঞ্জ করছে, “তুমি প্রমাণ করতে পারবে স্যুপারম্যান নেই?”
এটিও অপ্রমাণের বোঝা চাপানোর একটি ক্লাসিক উদাহরণ। দাবীকর্তার দায়িত্ব ছিল প্রমাণ করা যে স্যুপারম্যান সত্যিই আছে, কিন্তু তিনি তা না করে প্রতিপক্ষকে তার দাবিটি অপ্রমাণ করার দায়িত্ব দিচ্ছেন।
অপ্রমাণের বোঝা (Burden of Proof) এর মূলনীতি
যুক্তিবিদ্যায় এবং বিতর্কের ক্ষেত্রে “অপ্রমাণের বোঝা” এই ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মূলনীতি হলো:
- দাবী উত্থাপনের দায়: যে ব্যক্তি কোনো দাবি উত্থাপন করেন, তারই দায়িত্ব সেই দাবী প্রমাণ করার। অন্য কেউ সেই দাবী অপ্রমাণ করার জন্য বাধ্য নয়।
- যথাযথ প্রমাণের প্রয়োজন: দাবীর সপক্ষে যথাযথ প্রমাণ না থাকলে সেই দাবীকে গ্রহণযোগ্য বা সঠিক বলে বিবেচনা করা যায় না।
- বিশেষ দাবী, বিশেষ প্রমাণ: কোনো অসাধারণ বা বিশেষ দাবী করা হলে, সেটির সপক্ষে বিশেষ বা শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করা প্রয়োজন। যেমন, কেউ যদি দাবি করে যে সে আকাশে উড়তে পারে, তবে তার জন্য শক্তিশালী প্রমাণ, যেমন ভিডিও বা প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য প্রয়োজন।
- অপ্রমাণের বোঝা চাপানো: প্রমাণের অভাবে কেউ যদি প্রতিপক্ষকে তার দাবী অপ্রমাণ করতে বাধ্য করে, তাহলে এটি যুক্তি ত্রুটির উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়।
কুযুক্তির পরিচয়: অপ্রমাণের বোঝা চাপানো
অপ্রমাণের বোঝা চাপানোর কৌশল প্রায়শই তর্কবিতর্ক বা মিথ্যা দাবীগুলি প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহৃত হয়। দাবীকর্তা যখন নিজে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তিনি অপ্রমাণের দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেন। এতে তার দাবীকে সঠিক প্রমাণ করতে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও, প্রশ্নকারীকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা হয়। যুক্তিবিদ্যায় এটি একটি কুযুক্তি হিসেবে পরিচিত এবং এর মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।
উপসংহার
“অপ্রমাণের বোঝা” হলো যুক্তি এবং বিতর্কের ক্ষেত্রে প্রমাণের সঠিক দায়িত্বের ধারণা। যে কেউ কোনো দাবী করে, তারই দায়িত্ব সেই দাবী প্রমাণ করা, অন্যের ওপর প্রমাণের দায় চাপানো যৌক্তিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। উপরোক্ত ঘটনাগুলিতে প্রতিটি দাবীকর্তা প্রমাণ না দিয়ে অপ্রমাণের দায় অন্যের ওপর চাপিয়েছেন, যা যুক্তির নিয়মের পরিপন্থী। সঠিক প্রমাণ ছাড়া কোনো দাবী গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, এবং এরকম দাবী খারিজ হওয়াই যুক্তিসঙ্গত।