চক্রাকার কুযুক্তি (Circular Logic বা Circular Reasoning) একটি সাধারণ যুক্তির ত্রুটি, যেখানে কোনো দাবীর সত্যতা প্রমাণ করতে সেই দাবী বা তার সাথে সম্পর্কিত আরেকটি দাবীকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, যুক্তির শুরু এবং শেষ একই স্থানে থাকে। এতে দাবি ও প্রমাণের মধ্যে কোনো নতুন তথ্য বা যৌক্তিক ভিত্তি তৈরি হয় না, ফলে এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ এবং অযৌক্তিক যুক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।
উদাহরণ ১:
দাবী ১: বাইবেল যে সত্য, তার প্রমাণ কী?
উত্তর ১: বাইবেল সত্য কারণ ঈশ্বর বলেছেন বাইবেল সত্য।
দাবী ২: ঈশ্বর যে সত্য, তার প্রমাণ কী?
উত্তর ২: ঈশ্বর সত্য কারণ বাইবেলে লেখা আছে ঈশ্বর সত্য।
এই উদাহরণে দেখা যাচ্ছে, দাবী এবং প্রমাণ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এখানে বাইবেলের সত্যতা প্রমাণের জন্য ঈশ্বরকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, এবং ঈশ্বরের সত্যতা প্রমাণের জন্য বাইবেলকে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি চক্রাকার যুক্তি, যেখানে কোনো নিরপেক্ষ বা বাহ্যিক প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় না। এমন যুক্তি প্রায়শই ধর্মীয় বা দার্শনিক বিতর্কে পাওয়া যায়, তবে এটি বাস্তব বা বৈজ্ঞানিক যুক্তির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এতে মূল দাবী প্রমাণের জন্য প্রমাণিত কোনো যুক্তি বা প্রমাণ উপস্থাপিত হয় না।
চক্রাকার যুক্তির ত্রুটি:
চক্রাকার যুক্তির মূল সমস্যা হলো, এতে যুক্তির প্রতিটি অংশ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল এবং কোনো বাহ্যিক বা নিরপেক্ষ প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় না। এটি একটি ‘Begging the Question’ ফ্যালাসি, যেখানে যুক্তির শুরুতেই যা প্রমাণ করতে হবে, তা ধরেই নেওয়া হয়।
আরও উদাহরণ:
উদাহরণ ২:
প্রশ্ন: কেন আমরা সংবিধান মেনে চলবো?
উত্তর: কারণ সংবিধান বলে আমরা সংবিধান মেনে চলতে হবে।
এখানে যুক্তি চক্রাকারে ঘুরছে। সংবিধানকে মেনে চলার কারণ হিসেবে সংবিধানকেই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা সঠিক যুক্তি নয়। সংবিধান মেনে চলার জন্য বাইরের কারণ, যেমন সামাজিক নিয়ম, নৈতিকতা বা আইনশৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা উচিত।
উদাহরণ ৩:
প্রশ্ন: কেন তোমার শিক্ষক সবসময় সঠিক?
উত্তর: কারণ শিক্ষক সবসময় সঠিক থাকে।
এখানেও একটি চক্রাকার যুক্তির উদাহরণ পাওয়া যায়। শিক্ষকের সঠিকতা প্রমাণের জন্য সঠিকতার দাবীকেই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কোনো নিরপেক্ষ বা বাহ্যিক তথ্য নেই যা শিক্ষককে সঠিক বলে প্রমাণিত করতে পারে।
উদাহরণ ৪:
প্রশ্ন: কেন গণতন্ত্র সেরা শাসনব্যবস্থা?
উত্তর: গণতন্ত্র সেরা কারণ মানুষ গণতন্ত্রকে পছন্দ করে।
এটি চক্রাকার যুক্তির আরেকটি উদাহরণ, যেখানে গণতন্ত্রকে সেরা প্রমাণের জন্য সেই সিস্টেমের জনপ্রিয়তাকেই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে অন্য কোনো প্রমাণ, যেমন গণতন্ত্রের সাফল্য, মানবাধিকার রক্ষা, বা ন্যায়বিচার ইত্যাদির ভূমিকা উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল।
চক্রাকার যুক্তির বৈশিষ্ট্য:
- ১. আত্মনির্ভরশীলতা: চক্রাকার যুক্তিতে কোনো তথ্য প্রমাণ করার জন্য সেই তথ্যকেই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের যুক্তি নতুন কিছু উপস্থাপন করে না বা কোনো প্রমাণ দেয় না।
- ২. বাহ্যিক প্রমাণের অভাব: চক্রাকার যুক্তিতে বাইরের বা স্বাধীন প্রমাণের অভাব থাকে। দাবীটি প্রমাণ করার জন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের যুক্তি বা প্রমাণ থাকে না, যা দাবীর সত্যতা নিশ্চিত করতে পারে।
- ৩. যৌক্তিক ভিত্তি নেই: চক্রাকার যুক্তি প্রমাণিত হতে গেলে তথ্য বা প্রমাণের মাধ্যমে যুক্তির ভিত্তি তৈরি হওয়া প্রয়োজন। চক্রাকার যুক্তিতে কোনো বাস্তব ভিত্তি তৈরি হয় না।
চক্রাকার কুযুক্তি থেকে মুক্ত থাকার উপায়:
- ১. বাহ্যিক প্রমাণ উপস্থাপন: কোনো দাবী প্রমাণ করার জন্য অবশ্যই বাহ্যিক বা স্বাধীন প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে, যা দাবীর সত্যতা নিশ্চিত করবে। দাবীকে প্রমাণ করার জন্য নিজস্ব ভিত্তিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা অযৌক্তিক।
- ২. সমালোচনামূলক চিন্তা: চক্রাকার যুক্তি শনাক্ত করতে সমালোচনামূলক চিন্তা প্রয়োজন। যুক্তির প্রতিটি অংশ পর্যবেক্ষণ করে দেখুন, কোনো অংশই অন্য অংশের ওপর ভিত্তি করে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কি না।
- ৩. নতুন তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ: যুক্তির সত্যতা নিশ্চিত করতে নতুন তথ্য বা প্রমাণের প্রয়োজন। প্রতিটি দাবীর পক্ষে স্বতন্ত্র প্রমাণ থাকা উচিত, যা দাবি এবং প্রমাণের মধ্যে একটি লজিক্যাল সম্পর্ক তৈরি করবে।
উপসংহার:
চক্রাকার কুযুক্তি যুক্তির একটি প্রচলিত ত্রুটি যেখানে দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য সেই দাবীকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়। এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ যুক্তি পদ্ধতি, কারণ এতে নতুন কোনো তথ্য বা প্রমাণ উপস্থাপিত হয় না। যুক্তিবাদ এবং বাস্তব প্রমাণের আলোকে সত্য খুঁজে পাওয়ার জন্য চক্রাকার যুক্তি থেকে মুক্ত থেকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ উপস্থাপন করাই হলো সঠিক পদ্ধতি।