25.ব্যাখ্যা ও অজুহাত বা ন্যায্যতাকে গুলিয়ে ফেলা

কোন ঘটনার ব্যাখ্যা (explanation), অজুহাত (excuse) এবং ন্যায্যতা প্রদান(justification) তিনটি আলাদা বিষয়। ঘটনার ব্যাখ্যা, অজুহাত এবং ন্যায্যতা—এই তিনটি সম্পূর্ণ আলাদা ধারণা হলেও প্রায়ই মানুষ এদের মধ্যে পার্থক্য গুলিয়ে ফেলে। কোনো ঘটনা বা কর্মকাণ্ডের সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে এই তিনটি বিষয়কে সঠিকভাবে বুঝতে এবং আলাদা করতে হবে। একটি ঘটনা কেন ঘটেছে, তা জানতে ব্যাখ্যা প্রয়োজন, কিন্তু সেই ঘটনা বা কাজ সঠিক ছিল কি না, তা নির্ধারণের জন্য ন্যায্যতা দরকার। অন্যদিকে, অপরাধমূলক কাজকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার জন্য অজুহাত ব্যবহার করা হয়।

ব্যাখ্যা, ন্যায্যতা এবং অজুহাতের মধ্যে পার্থক্য:

  1. ব্যাখ্যা (Explanation):
    ব্যাখ্যা হলো এমন একটি বিবরণ যা কোনো ঘটনার কারণ বা প্রেক্ষাপট তুলে ধরে। এটি কোনো কার্যকলাপের পেছনের কারণ বা উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন কেউ ট্রাফিক নিয়ম ভেঙে রাস্তায় লালবাতি অমান্য করে গেছে। এর ব্যাখ্যা হতে পারে যে, তিনি জরুরি অবস্থায় ছিলেন, যেমন হাসপাতালে রোগী নিয়ে যেতে হচ্ছিল। ব্যাখ্যা ঘটনাটির কারণ এবং প্রেক্ষাপট তুলে ধরে, কিন্তু কাজটির নৈতিক বা আইনি বৈধতা সম্পর্কে কিছু বলে না।
  2. ন্যায্যতা (Justification):
    ন্যায্যতা প্রদান তখন করা হয়, যখন আমরা একটি কাজকে যুক্তি দিয়ে বৈধ এবং সঠিক বলে প্রমাণ করতে চাই। এটি একটি নির্দিষ্ট কাজের পক্ষে যুক্তিসঙ্গত কারণ উপস্থাপন করে এবং বোঝায় যে, সেই কাজটি যে পরিস্থিতিতে করা হয়েছে তা সঠিক বা গ্রহণযোগ্য ছিল। উপরের উদাহরণে, যদি জরুরি পরিস্থিতি থাকায় ট্রাফিক নিয়ম ভাঙাকে “ন্যায্য” বলা হয়, তবে তা হচ্ছে কাজটির ন্যায্যতা প্রতিপাদন। যেমন, কোনো জরুরি অবস্থায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকে কখনও কখনও আইনও ন্যায্যতা হিসেবে মেনে নিতে পারে।
  3. অজুহাত (Excuse):
    অজুহাত হলো, যখন কেউ একটি ভুল কাজের জন্য কারণ দেখিয়ে দোষ এড়াতে চায়। এটি এমন একটি প্রচেষ্টা যা কাজটির ভুল দিককে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি বলে যে, তারা ট্রাফিক নিয়ম ভাঙার সময় কেবলমাত্র “বেখেয়ালে” ছিল, তখন এটি একটি অজুহাত। এখানে কোনো জরুরি বা ন্যায্য কারণ নেই, বরং নিজের দোষ ঢাকতে অজুহাত খোঁজা হচ্ছে।


লজিক্যাল ফ্যালাসি: ব্যাখ্যাকে ন্যায্যতা এবং অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা

অনেক সময় আমরা ব্যাখ্যাকে ন্যায্যতা হিসেবে ভুল করে নিই, যা একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি। কোনো ঘটনা বা অপরাধের কারণ জানতে চাওয়া বা তা ব্যাখ্যা করা মানে তা ন্যায্য প্রমাণ করা নয়। এটি ঘটনার প্রেক্ষাপট এবং কারণ বোঝার প্রয়াস মাত্র।

উদাহরণ এবং বিশ্লেষণ:

  1. গণহত্যার ঘটনা (প্রথম উদাহরণ):
    বক্তা ১ – পাকিস্তানীরা ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল।
    বক্তা ২ – আপনার এইসব ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে হবে। পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে। প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে! সেসব না বুঝে আপনি এই কথা বলতে পারেন না।
    বক্তা ১ – গণহত্যার আপনি কী ব্যাখ্যা দিতে পারেন?
    বক্তা ২ – ঐ সময় খুব কঠিন সময় ছিল। ভারতের দালালরা পাকিস্তানকে ভাঙতে চেয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল পাকিস্তানের ক্ষতি করতে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কেন হয়েছিল জানেন? সেই সময়ে কিছু বাঙালি দুর্বৃত্ত পাকিস্তানের সংবিধান লঙ্ঘন করেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। সেই সময়ে দেশপ্রেমিক পাক সেনাবাহিনী কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করে।
    লক্ষ্য করে দেখুন, একটি গণহত্যাকে ন্যায্যতা প্রদান(Justification) করতে বক্তা ২ নানা রকম অজুহাত তৈরি করছেন। গণহত্যার সপক্ষে তিনি অজুহাত তৈরি করে সেগুলোকে ব্যাখ্যা মনে করছেন। কিন্তু ন্যায্যতা প্রদান, ব্যাখ্যা এবং অজুহাত একদমই আলাদা বিষয়। এই দুটো গুলিয়ে ফেলাকে Confusing an explanation with an excuse বলা হয়। উল্লেখ্য, গণহত্যা বা জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সম্প্রদায় ধরে নিধন চালানো কোন ব্যাখ্যাতেই বৈধ বলে গণ্য হয় না। কোন অবস্থাতেই ন্যায্যতা পায় না।
  2. সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কিত ঘটনা (দ্বিতীয় উদাহরণ):
    – ভাবি, আপনার ছেলে কিন্তু আমাকে মোটেও সম্মান করেনা।
    – কারণ সে মনে করে আপনার “আপনার চেহারা ডাইনির মত, যে বাচ্চাদের সহ্য করতে পারে না”।
    – কিন্তু এটা কোন অজুহাত হতে পারে না।
    – না, এখানে অজুহাতের কিছু নেই, এটা কেবলই তার আপনাকে পছন্দ না করার কারণ।
    এখানে বাচ্চাটি মহিলাটিকে কেন সম্মান করে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে মাত্র, কিন্তু বাচ্চাটি যে ঠিকই ভাবছে বা ন্যায্য কাজটি করছে বা বাচ্চার ভাবনাটাই যে ঠিক বা ন্যায্য সেটা বলা হয় নি, যা মহিলাটি ধরে নিয়েছিলেন।
  3. বিবর্তন এবং ধর্ষণ (চতুর্থ উদাহরণ):
    – তুমি কেন বিগফুটকে মানুষ ও বানরের মধ্যকার মিসিং লিংক বলে মনে করছ?
    – কারণ বিবর্তনগত প্রক্রিয়ায় দুটো প্রজাতির মধ্যবর্তী প্রজাতিকেই মিসিং লিংক বলে।
    এখানে মিসিং লিংক কাকে বলে তার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, মানে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, কিন্তু কেন সে বিগফুটকেই মিসিং লিংক বলে মনে করে এর ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়নি।
  4. ধর্ষণের কারণ হিসেবে জিনকে চিহ্নিত করাঃ
    – ধর্ষণের পিছনে বিবর্তনগত কারণ রয়েছে। জীববিজ্ঞানী থর্নহিল ও এনথ্রোপলজিস্ট পালমার বলেন, একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ হারেম-বিল্ডিং স্ট্রাগলের কারণে লুজাররা ধর্ষণকে বিকল্প জিন প্রমোটিং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে ব্যবহার করলে সুবিধা পাওয়া যায়, আর এর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মে আসায় পুরুষেরা ধর্ষণের প্রবণতা লাভ করেছে।
    – এভাবে বলে তুমি ধর্ষণকে জাস্টিফাই(Justification) করছ, যেন ধর্ষণ খুব ন্যাচারাল, এটা হতেই পারে!
    ধর্ষণের ইভোল্যুশনারি এক্সপ্লানেশন ধর্ষণের ব্যাখ্যা দেয়, অর্থাৎ মানুষ কেন ধর্ষণপ্রবণ হয় তার ব্যাখ্যা এখান থেকে পাওয়া যায়। কিন্ত এই ব্যাখ্যা কখনই ধর্ষণকে জাস্টিফাই করে না, বা ন্যায্যতা প্রদান করে না। অর্থাৎ ধর্ষণের পেছনে প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে বলেই এটা নৈতিক এমন কিছু বলে না। আর সেই সাথে ইভোল্যুশন থেকে আসা প্রবণতা ধর্ষণের জন্য কোন এক্সকিউজ বা অজুহাতও হতে পারে না। এটা তাই অপরাধই থাকবে, কারণ মানুষের মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা থাকলেও নিজেকে কন্ট্রোল করার অপশন আছে। বিবর্তনের দ্বারা মানুষ নৈতিকতা ও সামাজিকতার বৈশিষ্ট্যই লাভ করেছে।
    এছাড়া মানুষের আচরণ কেবল জিনই নয়, পরিবেশও নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া অপরাধ অর্থ সমাজের জন্য ক্ষতিকর কাজ, আর অপরাধী অর্থ যে এই ক্ষতিকর কাজটি করেছে। রেস্টোরেটিভ জাস্টিসের বিধান অনুসারে অপরাধী যাতে অপরাধ থেকে নিবৃত হয় তাই শাস্তির প্রয়োজন, যেখানে শাস্তি অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত করবার একটি প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে কেন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তাতে কিছু আসে যায় না, অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এখন অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত করার ব্যবস্থা করতে হবে, এটাই মুখ্য, তাই এক্সকিউজ বা এক্সপ্লানেশনে কিছু আসছে যাচ্ছে না।
    তবে বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধানে এবং মানুষের চরিত্র বুঝবার জন্য স্বাধীনভাবে বিবর্তনগত কারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে যেখানে নৈতিক সিদ্ধান্ত আরোপনের মাধ্যমে এটা ঠিক কি ভুল- এই বিষয়ক মন্তব্য করার কিছু নেই, বরং এই অনুসন্ধান অপরাধ নিবৃতির কাজে সহায়তা করতে পারে, যা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
    উপরের উদাহরণে একটি ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান এবং সেই ঘটনাকে জাস্টিফাই করার জন্য ব্যাখ্যা প্রদানকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। তাই এটি একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি।তাহলে আমরা ব্যাখ্যা প্রদান এবং অজিহাতের মধ্যে পার্থক্য কীভাবে করবো?
    অজুহাত > ধরুন, যখন কেউ বলবে, মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে, এখানে মেয়েটিরই দোষ ছিল। মেয়েটাই হয়তো কম কাপড় পরেছে, ছেলেটিকে উত্তেজিত করেছে, মেয়েটারই চরিত্রে দোষ আছে ইত্যাদি।
    বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা > লক্ষ বছরের বিবর্তনের ধারায় বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে ধর্ষণের ইচ্ছা পরিলক্ষিত হয় বলে গবেষনায় দেখা গেছে। বিবর্তনের ধাপে ধাপে যেই প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটছে, সেখানে শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী একজন পুরুষ, যারা সাধারণত অন্য পুরুষের সাথে লড়াইতে কুলিয়ে ওঠে নি, তারা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। সেখান থেকে হওয়া বাচ্চারা সেইসব জিন বহন করেছে। সেই সাথে পারিপার্শ্বিক ঘটনা, সামাজিক নিয়মকানুন এবং শিক্ষা সেই সব বাচ্চাদের ভেতরে সেই সব জিন সচল করতে সাহায্য করেছে।
    বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যখন দেয়া হচ্ছে, সেটি কাজটির ন্যায্যতা প্রদান নয়। এখানে কোনভাবেই কাজটি নৈতিক নাকি অনৈতিক, সেই সিদ্ধান্তে যাওয়া হয় না। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যও তা নয়। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য এইসব ঘটনার পেছনে কারণ অনুসন্ধান করা। যখন কারণগুলো সঠিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে, সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যাবে তার উপায়ও মিলতে থাকবে।

কেন এই পার্থক্য বোঝা গুরুত্বপূর্ণ?

  1. নৈতিকতা এবং আইন প্রয়োগ:
    নৈতিক বা আইনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ব্যাখ্যা, ন্যায্যতা এবং অজুহাতের মধ্যে পার্থক্য জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো অপরাধের পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু সেই ব্যাখ্যা কখনোই সেই অপরাধকে ন্যায়সঙ্গত করবে না। আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধের কারণ বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও, শাস্তি প্রদানের সময় সেই কাজের ন্যায্যতা খোঁজা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন চোর কেন চুরি করেছিল তা ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু সেই ব্যাখ্যা চুরিকে বৈধতা দিতে পারে না।
  2. বৈজ্ঞানিক এবং সামাজিক গবেষণা:
    বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রায়ই বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, যেমন বিবর্তনের ব্যাখ্যা বা অপরাধমূলক প্রবণতার গবেষণা। তবে, এই ব্যাখ্যাগুলো কোনো অপরাধকে ন্যায্যতা প্রদান বা বৈধতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। উদাহরণস্বরূপ, মানব ইতিহাসে কেন যুদ্ধ হয়েছে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, কিন্তু তা কখনোই যুদ্ধকে ন্যায্য প্রমাণ করে না।
  3. সমাজের অগ্রগতি:
    অনেক ক্ষেত্রে অজুহাত দেখিয়ে অপরাধকে ন্যায্য করার চেষ্টা সমাজে অগ্রগতির পথে বাধা তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবাদ বা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে অজুহাত দিয়ে বৈধতা দেওয়া হলে সমাজের উন্নতি ব্যাহত হয়। তাই অপরাধের ব্যাখ্যা দিতে পারলেও, তা ন্যায্যতা বা বৈধতা পাওয়ার যোগ্য নয়।

উপসংহার:

ঘটনার ব্যাখ্যা, ন্যায্যতা এবং অজুহাত তিনটি আলাদা বিষয়। ব্যাখ্যা কেবল ঘটনাটি কেন ঘটেছে তার কারণ তুলে ধরে; ন্যায্যতা কোনো কাজকে সঠিক প্রমাণ করতে চায়; আর অজুহাত হলো দোষ ঢাকার চেষ্টা। এই তিনটি ধারণা গুলিয়ে ফেললে আমরা ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি এবং অপরাধমূলক কাজকে সমর্থন করতে পারি। তাই চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো যুক্তি এবং প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা, কিন্তু তা ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করতে গিয়ে অজুহাত খোঁজা এড়িয়ে চলা।