“Appeal to Normality” হেত্বাভাস তখনই ঘটে যখন কোনো কাজ বা চিন্তাকে শুধুমাত্র স্বাভাবিক বা প্রচলিত হওয়ার কারণে সঠিক বা নৈতিক বলা হয়। এই কুযুক্তিতে মূলত অতীতের ঐতিহ্য, সামাজিক প্রথা বা সাধারণভাবে প্রচলিত কাজগুলোর উপর ভিত্তি করে সেই কাজকে সঠিক, ভাল, বা গ্রহণযোগ্য বলে দাবি করা হয়। কিন্তু কোনোকিছুর স্বাভাবিক বা প্রচলিত হওয়া মানেই যে তা নৈতিক বা গ্রহণযোগ্য, এমনটি নয়। এই হেত্বাভাস মানুষের যুক্তিগত চিন্তার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে এবং অন্যায়কে প্রথা বা সমাজের প্রচলিত কাজের দোহাই দিয়ে ন্যায্য করার প্রবণতা তৈরি করে।
উদাহরণসমূহ:
উদাহরণ ১:
- দাবী: ১৪০০ বছর আগে ইসলামিক জিহাদিরা আরবে পরাজিত কাফেরদের হত্যা করে তাদের স্ত্রী কন্যাদের তুলে এনে গণিমতের মাল নাম দিয়ে তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক করতো। এই কাজ করাটিই সেই সময়ে স্বাভাবিক ছিল।
- কুযুক্তি: তাই এই কাজকে খারাপ বলা যাবে না!
এখানে দাবি করা হচ্ছে, যেহেতু ১৪০০ বছর আগে এটি ছিল স্বাভাবিক, তাই এটি খারাপ নয়। কিন্তু কোনো কাজ অতীতে স্বাভাবিক ছিল বা অনেক বেশি মাত্রায় ঘটতো বলেই তা নৈতিক হতে পারে না। অনৈতিক কাজ সবসময়ই অনৈতিক, তা সমাজে বহুল প্রচলিত হলে অনৈতিক। সময়ের সাথে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ ও চিন্তার পরিবর্তন ঘটে। অতীতে প্রচলিত অনেক কাজ আজকের দিনে অসংবেদনশীল ও অনৈতিক হিসেবে ধরা হয়। তাই অতীতের প্রচলিত প্রথা দ্বারা নৈতিকতা নির্ধারণ করা একটি ভুল চিন্তা।
উদাহরণ ২:
- দাবী: বাংলাদেশে বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিই ঘুষ খায়।
- কুযুক্তি: তাই ঘুষ খাওয়ায় খারাপ কিছু নেই!
এখানে বলা হচ্ছে, যেহেতু অধিকাংশ সরকারি কর্মচারী ঘুষ খায়, তাই ঘুষ খাওয়া একটি স্বাভাবিক বা গ্রহণযোগ্য কাজ! কিন্তু এটি একটি কুযুক্তি, কারণ একটি কাজ যদি নৈতিকভাবে ভুল হয়, তবে তা যে সকলেই করে তাতেই তা সঠিক হয়ে যাবে না। দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি, এবং অনেকেই এটি করলেও এটি অনৈতিক এবং বর্জনীয়-ই থাকে।
উদাহরণ ৩:
- দাবী: তারেক জিয়া দুর্নীতি সৃষ্টি করেননি। তার আগেও দুর্নীতি হতো। আওয়ামী লীগও করেছে। দুর্নীতিই এই দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার।
- কুযুক্তি: তাহলে তারেক জিয়া দুর্নীতি করে কী অপরাধ করেছে?
এখানে “দুর্নীতি প্রচলিত ছিল” এবং “সবাই করতো” এই দোহাই দিয়ে দুর্নীতিকে ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে, যা আপিল টু নরমালিটির একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। দুর্নীতি প্রচলিত থাকলেও তা আইন ও নৈতিকতার বিপরীত এবং তা কখনোই সঠিক হতে পারে না।
উদাহরণ ৪:
- দাবী: হযরত মুহাম্মদ ৬ বছরের আয়শাকে বিয়ে করেন এবং ৯ বছরে বৈবাহিক জীবন শুরু করেন। ঐ সময়ে এটি স্বাভাবিক ছিল।
- কুযুক্তি: তাই এই কাজকে খারাপ বলা যাবে না!
এখানে ঐতিহাসিক প্রথার ভিত্তিতে এই কাজকে ন্যায্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সময়ে বহুসংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বাল্যবিবাহ করে থাকলে, একটি অনৈতিক কাজী তারা করেছিল। এটি নৈতিকতা ও শিশু অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল হিসেবে বিবেচিত হবে, কারণ এতে শিশুর কোন মতামত থাকে না। মতামত দেয়ার মত পরিপক্বতাই তাদের নেই। কোনো কাজ ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ছিল বলে তাকে নৈতিক বলা যায় না। সময়ের সাপেক্ষে মানুষের নৈতিকতার ধারণা ও মুল্যবোধ পরিবর্তিত হয়, এবং অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের আজকের নৈতিকতার মানদণ্ডেই বিবেচনা করতে হবে। কোন কাজ নৈতিক নাকি অনৈতিক, তা শুধুমাত্র ঐ কাজটির উপকারী বা ক্ষতিকর দিকের ওপর নির্ভর করে। মানুষের মধ্যে তা কতটা জনপ্রিয় বা অজনপ্রিয়, তার ওপর নয়।
উদাহরণ ৫:
- দাবী: আমি একটু ওবিস। যুক্তরাষ্ট্রে এরকম একটু ওবিস হওয়া নরমাল।
- কুযুক্তি: সুতরাং আমি ঠিকই আছি।
ওবিসিটি যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ হলেও তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ওজনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করলে, এটি কোনোভাবেই সঠিক বা স্বাস্থ্যকর হতে পারে না। কোনো সামাজিক প্রবণতা বা শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক বলে সেটিকে স্বাস্থ্যকর বা নৈতিক বলা যায় না।
উদাহরণ ৬:
- দাবী: গ্রামে সব নারীরই তো বাল্যবিবাহ হচ্ছে, এটা এখানে একটা নরমাল ব্যাপার।
- কুযুক্তি: সুতরাং এতে ক্ষতির কিছু নেই।
বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি এবং এটি গ্রামীণ সমাজে স্বাভাবিক হলেও এটি শিশু অধিকার লঙ্ঘন ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাধা। অনেকেই এই প্রচলনকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিলেও এর সামাজিক ও ব্যক্তিগত ক্ষতিকর প্রভাবগুলি অস্বীকার করা যায় না।
উদাহরণ ৭:
- দাবী: ধর্ষককে ধরে গণপিটুনি দেওয়া এই সমাজে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এমন তো নয় যে, এরকম ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি!
- কুযুক্তি: তাই এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, গণপিটুনি দেওয়া ঠিকই হয়েছে।
গণপিটুনি মব জাস্টিস বা সামাজিক বিচারের অংশ হলেও এর আগের কোনো উদাহরণ থাকা না থাকায় এটি ন্যায়সংগত হয়ে যায় না। ন্যায়বিচারের অভাব থেকে জন্ম নেওয়া এই ধরনের বিচারবহির্ভূত সহিংসতা কখনোই নৈতিক হতে পারে না। এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
৩. আপিল টু নরমালিটি হেত্বাভাসের ক্ষতিকর দিক
“Appeal to Normality” কুযুক্তি কেবলমাত্র প্রচলিত বা স্বাভাবিক হওয়ার কারণে অন্যায় কাজকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে। এটি বিপজ্জনক কারণ এটি মানুষের মধ্যে সৃজনশীল ও সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। যদি সমাজ শুধুমাত্র প্রচলিত বা সাধারণ কাজগুলোর উপর ভিত্তি করে চলে, তাহলে নৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
ক্ষতিকর প্রভাব:
- নৈতিকতার বিকাশে বাধা: আপিল টু নরমালিটি হেত্বাভাস নৈতিকতার নিরপেক্ষ বিকাশে বাধা দেয়। কারণ এটি অন্যায় কাজকে ন্যায্য করার প্রবণতা তৈরি করে, যার ফলে সামাজিক পরিবর্তন ব্যাহত হয়।
- অন্যায়ের বৈধতা: অনেক সময় এ ধরনের যুক্তি ব্যবহার করে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের অন্যায় কাজকে বৈধতা দেয়। যেমন, রাজনৈতিক দুর্নীতি বা ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে অপরাধকে সমর্থন করা।
- বিচারহীনতার প্রসার: অপরাধীকে সামাজিক বিচারের মুখোমুখি না করে স্বাভাবিকতার দোহাই দিয়ে বিচারবহির্ভূত সহিংসতাকে সমর্থন করা হয়, যা সমাজে ন্যায়বিচারের ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৪. উপসংহার
“Appeal to Normality” একটি বিপজ্জনক কুযুক্তি যা সমাজে প্রচলিত বা স্বাভাবিক কাজকে ভিত্তি করে অন্যায় বা অনৈতিক কাজকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে। কোনো কাজ সামাজিকভাবে স্বাভাবিক বা প্রচলিত হলেও তা নৈতিকতার মাপকাঠিতে বিচার করা উচিত। নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ নির্ধারণ করতে হলে শুধু প্রচলনকে নয়, যুক্তি, মানবিকতা, এবং আধুনিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে হবে।