“No True Scotsman” কুযুক্তি, যা বাংলায় বলা যায় “সহি ইসলাম নহে” কুযুক্তি, একটি বহুল ব্যবহৃত যুক্তিগত ভুল যা মূলত নিজের গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা আদর্শের সমালোচনা থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই কৌশলে, একজন ব্যক্তি কোনো নেতিবাচক ঘটনার জন্য দায় স্বীকার না করে, ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে সেই গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে গণ্য করেন না। এটি একটি প্রায়ই ব্যবহৃত কৌশল, বিশেষ করে যখন কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ নৈতিক বা আইনগত কোনো অপরাধ করে।
“No True Scotsman” বলতে বুঝায়, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি কোনো অপ্রত্যাশিত বা অপ্রীতিকর কাজ করে, তবে তাকে সেই গোষ্ঠীর সঠিক বা আসল সদস্য হিসেবে গণ্য করা হয় না। মূলত, এটি সমস্যার মুখোমুখি না হয়ে সমস্যা এড়ানোর একটি সহজ কৌশল।
- ১. “No True Scotsman” কুযুক্তির উদাহরণঃ কয়েকটি সাধারণ উদাহরণ দেখানো যাক যেখানে এই কুযুক্তি প্রয়োগ হয়:
- ক. দাবি: “জামাতে ইসলামির একজন নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন।”
- কুযুক্তি: “উনি সত্যিকারের জামাতি নহেন।”
- এখানে দেখা যাচ্ছে, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি জামাতে ইসলামির সদস্য হলেও, তার অপরাধের জন্য জামাতি গোষ্ঠী দায়ী না হয়ে তাকে ‘সহি জামাতি নহে’ বলে দাবি করা হচ্ছে। এভাবে গোষ্ঠীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
- খ. দাবি: “আওয়ামী লীগের এক নেতা দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন।”
- কুযুক্তি: “উনি সহিহ আওয়ামী লীগার নহেন।”
- দুর্নীতি করা ব্যক্তি আওয়ামী লীগের সদস্য হলেও, দলের দুর্নীতির অভিযোগকে অস্বীকার করতে তাকে ‘সহি আওয়ামী লীগার’ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে না।
- গ. দাবি: “মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বার্মিজরা অত্যাচার চালাচ্ছে।”
- কুযুক্তি: “যারা অত্যাচার করছে তারা সহিহ বার্মিজ নহেন।”
- বার্মিজ জাতি হিসেবে কাজটি সমগ্র বার্মিজ গোষ্ঠীর দায় হিসেবে গৃহীত না হয়ে তাদের অপ্রত্যাশিত আচরণকে ‘সহি বার্মিজ নয়’ বলে দাবি করা হচ্ছে।
- ঘ. দাবি: “প্যালেস্টাইনে ইসরাইল আবারো আক্রমণ করেছে।”
- কুযুক্তি: “ওরা সহি ইসরাইলী নহেন।”
- এখানে ইসরাইলী জঙ্গি হামলাকে এড়িয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, আক্রমণকারীরা ‘সহি ইসরাইলি’ নয়।
- ঙ. দাবি: “হোলি আর্টিজানে ইসলামি জঙ্গিরা আক্রমণ করেছে।”
- কুযুক্তি: “ওরা সহি মুসলমান নহেন।”
- ইসলামের নামে আক্রমণ চালানো হলেও, আক্রমণকারীদের ইসলাম থেকে আলাদা করা হচ্ছে, যেন ইসলাম ও মুসলিম সম্প্রদায় এই ঘটনার জন্য দায়ী না থাকে।
- ২. “No True Scotsman” কুযুক্তি কীভাবে কাজ করে?
- এই কুযুক্তির মধ্যে মূল কৌশল হলো, কোনোকিছু ব্যাখ্যা না করেই একটি দাবি প্রত্যাখ্যান করা এবং নতুন করে দাবি করা যে অপরাধী ব্যক্তি ‘সহি সদস্য’ নন। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী একটি অপরাধ বা অপ্রত্যাশিত কাজ করলে, সেই গোষ্ঠী সহজেই তার থেকে নিজেদের আলাদা করে দাবি করে যে, “যেহেতু সে এই অপরাধ করেছে, সেহেতু সে সহি সদস্য নয়।” এই ধরনের যুক্তি সমস্যার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও তার সমাধান না করে, তার থেকে সহজে দূরে সরে যাওয়ার পথ সৃষ্টি করে।
- ৩. যুক্তি ও নৈতিকতার সাথে সংঘর্ষ
- “No True Scotsman” কুযুক্তি নৈতিকতা এবং বাস্তবতার সাথে স্পষ্ট সংঘর্ষে থাকে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সদস্য অপরাধ করলে, তা থেকে গোষ্ঠী নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। একজন ব্যক্তি যদি একটি দলের নীতি বা আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে কোনো অপরাধ করে, তবে সেই ব্যক্তি সেই দলেরই অংশ। যদি গোষ্ঠী তার আদর্শের বাইরে কাজ করা ব্যক্তিকে সদস্য হিসেবে গন্য না করে, তবে এটি মূলত একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয় অপরাধ থেকে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে।
- উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি দল বা ধর্মের কোনো নেতা অন্যায় করে, তাহলে সেই অন্যায় কাজের দায়ভার ওই দলের ওপর পড়া উচিত, এবং দলকে নিজেদের নৈতিক ও আদর্শগত ত্রুটি নিয়ে চিন্তা করা উচিত। কিন্তু “সহি নহেন” কৌশলের মাধ্যমে সেই দায়ভার এড়ানো হয়।
- ৪. ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর ব্যবহার
- “No True Scotsman” কুযুক্তি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
- ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে:
- ইসলামিক সম্প্রদায়ে কোনো ব্যক্তি যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তবে তাকে ‘সহি মুসলিম নয়’ বলে দাবি করা হয়, যেন ইসলামের আদর্শের সঙ্গে তার কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি মূল সমস্যাটিকে এড়িয়ে যায় এবং ইসলামের দায়িত্ব কমিয়ে দেয়। একইভাবে, খ্রিস্টান ধর্মেও দেখা যায় যে, কোনো অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তিকে ‘সহি খ্রিস্টান নয়’ বলে দাবি করা হয়।
- রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে:
- রাজনীতিতে, কোনো দলের নেতা বা সদস্য অপরাধ করলে, দল সেই ব্যক্তিকে ‘সহি সদস্য নয়’ বলে দাবি করে, যেন দলের ভাবমূর্তিতে কোনো ক্ষতি না হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন রাজনীতিবিদ দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত হলে, দল তাকে সরিয়ে ফেলে বা ‘সহি সদস্য নয়’ বলে দাবি করে, যেন সেই দলের নাম খারাপ না হয়।
- ৫. মানবিক ও যৌক্তিক সমস্যার সমাধান
- “No True Scotsman” কুযুক্তির মাধ্যমে গোষ্ঠীগুলি তাদের দায়ভার এড়িয়ে যায়, যা প্রকৃত সমস্যার সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখে না। বরং এটি নৈতিক ও যুক্তিগত ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে।
- যদি একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় তার সদস্যের অপরাধ বা অন্যায় কাজের দায়ভার গ্রহণ না করে এবং সমস্যার মুখোমুখি না হয়ে “সহি নহেন” কুযুক্তি ব্যবহার করে, তবে তাদের নৈতিক দায়িত্ব এবং আদর্শের ভুলগুলো প্রকাশ পায়। একটি নৈতিক এবং সঠিক সমাজে, প্রত্যেক গোষ্ঠী এবং দলকে তাদের সদস্যের অপরাধের দায়ভার গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের নিজেদের নীতিমালার সমালোচনা করে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
৬. উপসংহার
“No True Scotsman” কুযুক্তি একটি অত্যন্ত সাধারণ এবং কার্যকর কৌশল যা সমস্যাকে সরাসরি সমাধান না করে তা এড়িয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে। এটি বিশেষ করে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই ধরনের যুক্তি মানবাধিকার, নৈতিকতা, এবং বিচার-বিবেচনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে।
প্রকৃত সমাধান হলো, প্রতিটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে তাদের নিজেদের সদস্যের অপরাধ বা অন্যায় কাজের দায়ভার গ্রহণ করে এবং সেই দায়িত্বের আওতায় সমস্যার সমাধান করা। যুক্তি ও নৈতিকতার পথেই একটি সমাজ এগিয়ে যেতে পারে, কোনো কৌশলের মাধ্যমে সমস্যা এড়িয়ে নয়।