পালিত পুত্রের স্ত্রীকে স্বল্পবসনা অবস্থায় দেখে নবী মুহাম্মদের কামভাব জাগ্রত হয় এবং সেই নারীকে বিবাহ করার প্রবল ইচ্ছা তৈরি হয় বলে জানা যায়। যেই কাড়নে যায়েদ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য হয়। পুরো বিষয়টি খুঁটিয়ে জানা এবং বোঝার প্রয়োজন, তাই পুরো বিষয়টি আলোচনা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিকদের একজন ওয়াকিদিকে প্রখ্যাত অনেক আলেমই মিথ্যুক বলে অভিহিত করেছেন। তবে এই ক্ষেত্রে সমস্যাটি হচ্ছে, ওয়াকিদিকে মিথ্যুক হিসেবে ধরে নেয়া হলে “বয়স্ক লোকের দুধপান বিষয়ক কোরআন হাদিসের নির্দেশনা” এখনো মুসলিমদের মানতে হবে, এবং সরাসরি স্তন থেকে চুষে চুষে সেই বিধান কার্যকর করতে হবে। কারণ পাত্রে ঢেলে দুধ পানের যেই বর্ণনা রয়েছে, তা শুধুমাত্র ওয়াকিদির সূত্র থেকেই বর্ণিত। ওয়াকিদিকে বাদ দিলে এই মস্তবড় সমস্যাটি দেখা দিবে। এই কারণেই মুসলিম আলেমগণ প্রয়োজন অন্যসারে ওয়াকিদির শরণাপন্ন হন, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে যখন ওয়াকিদির বর্ণনায় নবীর লাম্পট্যের বিষয়গুলো সামনে আসে, তখন ওয়াকিদিকে অস্বীকার করেন।
আসুন শুরুতেই একটি ওয়াজ শুনে নিই,
পালিত সন্তান গ্রহণের প্রথা
পালক সন্তান গ্রহণ, পিতামাতাহীন একটি শিশুকে পিতামাতার নাম প্রদান করা একটি গভীর মানবিক কাজ যা সমাজে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে। জন্মগতভাবে মা-বাবাহীন কিংবা বিপন্ন অবস্থায় থাকা শিশুরা নিরাপত্তা, স্নেহ এবং একটি পরিবারের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। পালক সন্তান গ্রহণের মাধ্যমে এসব শিশুদের একটি নতুন জীবনের সুযোগ দেওয়া সম্ভব। এটি শুধু একটি শিশুর জীবন পরিবর্তন করে না, তার মৌলিক চাহিদা যা হচ্ছে পিতামাতার ভালবাসা এবং পরিচয়, এই অভাব পূরণে ভূমিকা রাখে। সে পুরোপুরি না হলেও আংশিকভাবে পিতামাতার ভালবাসা লাভ করে।
এছাড়াও, পালক সন্তান গ্রহণ সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি কেবল একটি পরিবারের বন্ধনকে মজবুত করে না, বরং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা সঠিক পরিবেশ এবং শিক্ষার সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি, এটি অভিভাবকদেরও সমৃদ্ধ করে, কারণ তারা একটি নিরপরাধ শিশুকে আশ্রয় দিয়ে তাদের মানবিক দায়িত্ব পালন করেন। তাই, পালক সন্তান গ্রহণ শুধু একটি আইন বা সামাজিক প্রথা নয়; এটি স্নেহ, ভালোবাসা এবং মানবিকতার গভীর এক প্রতিফলন।
যায়েদের কথা
ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজার দাস ছিল যায়েদ। খাদিজাকে বিয়ে করার সুবাদে নবী মুহাম্মদ সেই দাসের মালিকানা লাভ করে। পরবর্তীতে সে সেই দাসকে নিজের পালিত পুত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং নিজের নাম প্রদান করেন। কাবার সামনে দাঁড়িয়ে মুহাম্মদ একটি ভাষণে যায়েদকে নিজের পুত্র এবং উত্তরাধিকার হিসেবে গ্রহণ করে [1]
এই প্রসঙ্গে একটি হাদিস পড়ে নেয়া যাক, যা থেকে জানা যায়, প্রখ্যাত সাহাবীগণ যায়েদকে “যায়েদ ইবনে মুহাম্মদ” বলেই ডাকতো।
সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৬৫/ কুরআন মাজীদের তাফসীর
পরিচ্ছেদঃ ৬৫/৩৩/২. আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ তোমরা তাদেরকে ডাক তাদের প্রকৃত পিতৃ পরিচয়ে। (সূরাহ আহযাব ৩৩/৫)
৪৭৮২. ’আবদুল্লাহ্ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আযাদকৃত গোলাম যায়দ ইবনু হারিসাহ্কে আমরা ’’যায়দ ইবনু মুহাম্মদ-ই’’ ডাকতাম, যে পর্যন্ত না এ আয়াত নাযিল হয়। তোমরা তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাক, আল্লাহর দৃষ্টিতে এটিই অধিক ন্যায়সঙ্গত। [মুসলিম ৪৪/১০, হাঃ ২৪২৫, আহমাদ ৫৪৮০] (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৪১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৪২০)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
আসুন তাবারীর ইতিহাস থেকে দেখে নেয়া যাক [2] –
পালিত পুত্রের স্ত্রীকে দেখে অন্তর পরিবর্তন
একটি বিশেষ ঘটনার পরে আল্লাহ একটি সূরার কয়েকটি আয়াত নাজিলের মাধ্যমে পালিত পুত্র গ্রহণের ঐতিহ্য সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করেন এবং পালিত পুত্রের স্ত্রীদের বিবাহ করার ক্ষেত্রে মুমিনদের যেনো কোন বাধা বিঘ্ন না থাকে, লজ্জাশরম না থাকে, সেই উদ্দেশ্যে বিশেষ ব্যবস্থা নেন। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করাটি আল্লাহর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ একটি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, যার কারণে তিনি আরশে বসে মহা চিন্তিত ছিলেন এবং মুমিনেরা যেনো পালিত পুত্রের স্ত্রীকে ঠিকঠাকভাবে বিবাহ করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। দুনিয়ার এত জরুরি বিষয়াদি রেখে পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করা নিয়ে মহান আল্লাহপাক কেন এত চিন্তিত ছিলেন তা অবশ্য জানা যায় না। দাস প্রথা নিষিদ্ধ করা দরকার, সাম্প্রদায়িকতা বা যুদ্ধ হানাহানি মারামারি বন্ধ করা দরকার, শিশু বিবাহের মত নোংরা প্রথা বন্ধ করা দরকার, এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ফেলে রেখে সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করার বিষয়ে বেশ কয়েকটি আয়াত নাজিল করলেন। সেই ঘটনাটির প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা জরুরি। আসুন আগে কোরআনের একটি আয়াত পড়ি, [3]
আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী উক্ত নির্দেশের ভিন্নতা করার কোন অধিকার রাখে না। যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে সে স্পষ্টতই সত্য পথ হতে দুরে সরে পড়ল।
— Taisirul Quran
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিনা নারীর সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবেনা। কেহ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সেতো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।
— Rawai Al-bayan
আর আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য সে বিষয়ে তাদের কোনো (ভিন্ন সিদ্ধান্তের) ইখতিয়ার সংগত নয়। আর যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হলো [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
স্মরণ কর, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন আর তুমিও যাকে অনুগ্রহ করেছ তাকে তুমি যখন বলছিলে- তুমি তোমার স্ত্রীকে (বিবাহবন্ধনে) রেখে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর। তুমি তোমার অন্তরে লুকিয়ে রাখছিলে যা আল্লাহ প্রকাশ করতে চান, তুমি লোকদেরকে ভয় করছিলে, অথচ আল্লাহই সবচেয়ে বেশি এ অধিকার রাখেন যে, তুমি তাঁকে ভয় করবে। অতঃপর যায়্দ যখন তার (যায়নাবের) সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে দিলাম যাতে মু’মিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব নারীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মু’মিনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকরী হবেই।
— Taisirul Quran
স্মরণ কর, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করছ, তুমি তাকে বলেছিলেঃ তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর। তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন রেখেছ আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন; তুমি লোকদেরকে ভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকে ভয় করাই তোমার পক্ষে অধিকতর সঙ্গত। অতঃপর যায়িদ যখন তার (যাইনাবের) সাথে বিয়ের সর্ম্পক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম, যাতে মু’মিনদের পোষ্য পুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহ সূত্র ছিন্ন করলে সেই সব রমনীকে বিয়ে করায় মু’মিনদের জন্য কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকরী হয়েই থাকে।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর স্মরণ কর, আল্লাহ যার উপর নিআমত দিয়েছিলেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলে, তুমি যখন তাকে বলেছিলে ‘তোমার স্ত্রীকে নিজের কাছে রেখে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর’। আর তুমি অন্তরে যা গোপন রাখছ আল্লাহ তা প্রকাশকারী এবং তুমি মানুষকে ভয় করছ অথচ আল্লাহই অধিকতর হকদার যে, তুমি তাকে ভয় করবে; অতঃপর যায়েদ যখন তার স্ত্রীর সাথে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম, যাতে পালক পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে; যখন তারা তাদের স্ত্রীদের সাথে বিবাহসম্পর্ক ছিন্ন করে।* আর আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর হয়ে থাকে। * فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌ مِّنْهَا وَطَرًا এর আভিধানিক অর্থ হল: তার (স্ত্রীর) ব্যাপারে যায়েদের প্রয়োজন যখন শেষ হল। ভাবার্থ হল: বিয়ের প্রয়োজনীয়তা শেষে যায়েদ যখন তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিল। যায়েদ ইবন হারিসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাস ছিলেন; আল্লাহ ইসলামের পথে হিদায়াত দানে তার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মুক্ত করে পালক পুত্র ঘোষণা দিয়ে তার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলেন। যায়েদ বিয়ে করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফুফাতো বোন যয়নব বিন্ত জাহশকে। তাদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় যায়েদ যয়নবকে তালাক দেন। পরে আল্লাহর নির্দেশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যয়নবকে বিয়ে করেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে সামাজিক নিষেধাজ্ঞা দূরীভূত করেন।
— Rawai Al-bayan
আর স্মরন করুন, আল্লাহ্ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং আপনিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আপনি তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর [১]।’ আর আপনি আপনার অন্তরে গোপন করছিলেন এমন কিছু যা আল্লাহ্ প্রকাশ করে দিচ্ছেন [২] এবং আপনি লোকদেরকে ভয় করছিলেন, অথচ আল্লাহ্কেই ভয় করা আপনার পক্ষে অধিকতর সংগত। তারপর যখন যায়েদ তার (স্ত্রীর) সাথে প্রয়োজন শেষ করল [৩], তখন আমরা তাকে আপনার নিকট বিয়ে দিলাম [৪], যাতে মুমিনদের পোষ্য পুত্রদের স্ত্রীদেরকে (স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে) কোনো সমস্যা না হয় যখন তারা (পোষ্য পুত্ররা) নিজ স্ত্রীর সাথে প্রয়োজন শেষ করবে (এবং তালাক দিবে)। আর আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
আসুন আবু বকর মুহাম্মদ যাকারিয়ার অনুবাদে এই আয়াতটি পড়ে নিই, [4]
এবারে আসুন এই আয়াতটির তাফসীর পড়ি, [5]
বাগবী লিখেছেন, আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর হজরত যয়নাব ও তাঁর ভ্রাতা বিবাহ প্রস্তাবে সম্মত হলেন। বিষয়টি তাঁরা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলেন রসুল স. এর অধিকারে। রসুল স. হজরত জায়েদ ও হজরত যয়নাবের পরিণয় সম্পন্ন করলেন। নিজের পক্ষ থেকে তাঁদেরকে উপহার হিসেবে দিলেন দশ দীনার, ষাট দিরহাম, একটি চাদর, একটি কুর্তা, একটি ওড়না ও একটি লুঙ্গি । আর খাদ্যশস্য হিসেবে দিলেন পঞ্চাশ সের আটা ও চার মন খেজুর। কিছুদিন পর কোনো এক কার্যোপলক্ষে রসুল স. উপস্থিত হলেন হজরত জায়েদের গৃহে। দেখলেন, হজরত যয়নাব দাঁড়িয়ে আছেন একটি কামিজ ও দোপাট্টা পরিহিত অবস্থায় । তিনি ছিলেন অনিন্দ্যরূপসী কুরায়েশ বালা। রসুল স. এর ভাবান্তর জন্মালো। মুখে কেবল বললেন সুবহানাল্লাহ্। আল্লাহ্ই অন্তরসমূহের বিবর্তক। তারপর ফিরে এলেন স্বগৃহে। পরে হজরত জায়েদের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি স. তাঁর অন্তরের ভাবান্তরের কথা তাঁকে জানালেন। হজরত জায়েদের অন্তরে তখন থেকে হজরত জয়নাবের প্রতি সৃষ্টি হলো বীতরাগ । কিছুদিন পর তিনি রসুল স. সকাশে নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ্র রসুল! আমি জয়নবের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে চাই । তিনি স. বললেন, কেনো? যয়নব কি তোমার সঙ্গে অশোভন আচরণ করে? তিনি বললেন, শপথ আল্লাহ্ । আমি তাঁর নিকট ইষ্ট ব্যতীত অনিষ্ট কিছু পাইনি। তবে জাত্যাভিমান তার প্রকট। মাঝে মাঝে সে একথা প্রকাশও করে। রসুল স. বললেন, তোমার সহধর্মিণীকে তোমার কাছেই রাখো। তার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। আবু জায়েদের সূত্রে ইবনে জারীর এরকমই বর্ণনা করেছেন। আরো বলেছেন, এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই অবতীর্ণ হয় নিম্নের আয়াত ।
এবারে আসুন তাফসীরে জালালাইন থেকে পড়ি, [6]
উপরে লক্ষ্য করুন, তাফসীরে জালালাইনের অনুবাদের সময় অনুবাদক একটি কৌশল অবলম্বন করেছেন, যার ফলে কোন ঘটনার পরে কোন ঘটনাটি ঘটেছিল তা বদলে গেছে। তাই আসুন ইংরেজি অনুবাদ থেকে ঘটনার ধারাবাহিকতাটি বুঝে নিই, [7]
জায়েদ ও জয়নাবের বিয়ের দুই বছরের মাথায় এই বিশেষ ঘটনাটি ঘটে। ইবনে জারীর তাবারীর তারীখ (৩/১৬১) এবং ইবনে সাদ তাঁর তাবাকাত (৮/১০১) গ্রন্থে ঘটনাটি এভাবে উল্লেখ করেন [8] [9]
মুহাম্মাদ ইবনে উমার (আল ওয়াকেদী) বলেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর আল আসলামী বলেছেন, মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে হিশাম বলেছেন “রাসূল ﷺ জাইদ বিন হারেছার বাসায় তাঁকে খুঁজতে গেলেন, তখন যাইদকে বলা হতো ‘মুহাম্মাদের পুত্র’। কিন্তু তিনি তাঁকে বাসায় খুঁজে পেলেন না। এমতাবস্থায়, জয়নাব তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে তাঁর রাতের পোশাক পরে বের হলেন। নবীﷺতাঁর মুখ ফেরালেন এবং তিনি (জয়নাব) বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! সে এখানে নেই, দয়া করে ভেতরে আসুন।’ কিন্তু নবী ﷺ (ভেতরে প্রবেশ করতে) রাজি হলেন না। তিনি (জয়নাব) রাতের পোশাক পরে বের হয়েছিলেন, কারণ তাঁকে বলা হয়েছিলো নবী ﷺ দরজায় দাঁড়িয়ে, তাই তিনি তাড়াহুড়ো করেছিলেন। তিনি নবী ﷺ এর হৃদয়ে জায়গা করে নিলেন। নবী ﷺ অস্পষ্ট গুঞ্জন করতে করতে বের হয়ে গেলেন, (যার মধ্যে শুধু এতোটুকু বোঝা গেলো) ‘সকল প্রশংসা তাঁর যিনি হৃদয়ের পরিবর্তন করেন।
এবারে আসুন সরাসরি সর্বাধিক প্রখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ তাবারীর গ্রন্থ থেকে পুরো বিবরণটি জেনে নেয়া যাক, [10] –
Zaynab bt. Jahsh b. Ri’ab, sister of `Abd al-Rahman b. Jalhsh.
Her mother was Umaymah bt. `Abd al-Muttalib b. Hashim.
According to Ibn `Umar [al-Wagidi]-`Umar b. `Uthman alJahshi-his father: Zaynab bt. Jahsh, who was a beautiful woman, was among those who emigrated [to Medina] with the Prophet. When the Prophet arrived at Medina he asked that she be given to [his adopted son] Zayd b. Harithah in marriage, but she said “0 Messenger of God, I cannot give my consent, for I am the widow of the Quraysh. The Prophet replied “But I give my consent that you should [marry him].” So Zayd b. IHarithah married her.
According to Ibn Umar [al-Wagidi]-`Abdallah b. `Amir al-Aslami-Muhammad b. Yahya b. abban: The Prophet came to Zayd b. Harithah’s house looking for him. Zayd was [at that time] called only Zayd b. Muhammad, and the Prophet sometimes would miss him [after] a time and would say “Where is Zayd?” [Once] he went to Zayd’s house but did not find him [there].
Zaynab rose toward him and said “Come here, O Messenger of God,” but he turned away, muttering something unintelligible, except the words “Praised be God the Great, praised be God, who turns the hearts.”( Subhanallah!) When Zayd came home his wife told him that the Prophet had come to his house. Zayd asked “Didn’t you ask him to come in?” She said “I proposed it to him but he declined.”
Zayd asked “Did you hear him say anything?” She said: “When he turned away I heard him say something I did not understand, and I heard him say ‘Praised be God the Great, praised be God who turns the hearts.” Zayd left [his house] and went to the Prophet. He said: “O Messenger of God, I heard that you came to my house.
Why didn’t you come in? O Messenger of God, may my father and mother be your ransom! Perhaps [the problem is] that you like Zaynab? In that case, I shall divorce her.” The Prophet said “Keep your wife.” [But] Zayd could not touch her [after that]. He would
come to the Prophet and tell him [about it], and the latter would say “Keep your wife,” and Zayd would say “O Messenger of God, I shall divorce her,” and the Prophet would say “Keep your wife.”
Zayd divorced her [all the same] and abstained from her, and she became lawful [for remarriage]. [One day], while talking to `A’ishah, the Prophet fainted. On regaining consciousness he smiled and said “Who will go to Zaynab to bring her the glad tidings that God from above gave her to me in marriage?” The Prophet [then] recited “(Recall) when thou wert saying to him upon whom Allah bestowed favor and upon whom thou didst bestow favor.” A’ishah narrated: I was upset by both near and remote troubles, having heard of Zaynab’s beauty. What was more, the greatest and noblest of all things happened to her, as God from heaven gave her in marriage. I said [to myself ] “She is going to boast of it to us.” Salma, the Prophet’s servant, then went quickly and told [Zaynab] about it. [Zaynab] gave her silver ornaments for this [service].
অনুবাদঃ জয়নাব বিনতে জাহশ। তার মা ছিলেন উমাইমাহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব বিন হাশিম।
ইবনে উমরের সূত্রে জানা যায় যে, জয়নাব বিনতে জাহশ ছিলেন এক অপরূপ সুন্দরী নারী। তিনি নবীর সঙ্গে মদিনায় হিজরতকারী সাহাবিদের অন্যতম। নবী যখন মদিনায় পৌঁছালেন, তখন তিনি জয়নাবকে তাঁর দত্তকপুত্র জায়েদ বিন হারিসার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বললেন। কিন্তু জয়নাব বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আমি রাজি নই, কারণ আমি কুরাইশদের একজন বিধবা।” নবী উত্তর দিলেন, “কিন্তু আমি তোমার জন্য এই বিয়ের নির্দেশ দিচ্ছি।” এরপর জায়েদ বিন হারিসা তাকে বিয়ে করলেন।
ইবনে উমরের সূত্রে আরো জানা যায়, (একদিন) নবী জায়েদ বিন হারিসার বাড়িতে তাকে খুঁজতে গেলেন। তখন জায়েদকে “জায়েদ বিন মুহাম্মদ” বলেই ডাকা হতো। নবী তাকে খুঁজতেন এবং বলতেন, “জায়েদ কোথায়?” (একদিন) জায়েদের বাড়িতে গিয়ে তাকে না পেয়ে ফিরে আসেন।
জয়নাব নবীকে দেখে বললেন, “ও আল্লাহর রাসুল, ভেতরে আসুন।” কিন্তু নবী চলে গেলেন এবং যাওয়ার সময় কিছু অস্পষ্ট বাক্য উচ্চারণ করলেন। তিনি বললেন, “সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহর প্রশংসা যিনি অন্তরকে পরিবর্তন করে দেন।” জায়েদ বাড়িতে ফিরে আসার পর তার স্ত্রী ঘটনাটি তাকে জানালেন। জায়েদ জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি তাকে ঘরে আসতে বলোনি?” জয়নাব বললেন, “আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।”
জায়েদ জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি কিছু শুনতে পেয়েছ?” জয়নাব বললেন, “তিনি যখন সরে গেলেন, তখন তিনি অস্পষ্ট কিছু বলেছিলেন। তবে আমি শুনেছি তিনি বলেছেন, “সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহর প্রশংসা যিনি অন্তরকে পরিবর্তন করে দেন।”
জায়েদ এরপর নবীর কাছে গেলেন এবং বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আমি শুনেছি আপনি আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন। কেন আপনি ভিতরে আসেননি? যদি আপনার মনে হয় যে আপনি জয়নাবকে পছন্দ করেন, তাহলে আমি তাকে তালাক দিয়ে দেব।” নবী বললেন, “তোমার স্ত্রীকে নিজের কাছেই রাখো।” কিন্তু জায়েদ আর জয়নাবের প্রতি আগের মতো অনুভব করতে পারলেন না।
বারবার নবী বলতেন, “তোমার স্ত্রীকে নিজের কাছেই রাখো।” কিন্তু জায়েদ উত্তর দিতেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আমি তাকে তালাক দিতে চাই।” শেষ পর্যন্ত জায়েদ তাকে তালাক দেন এবং তিনি পুনরায় বিয়ের জন্য বৈধ হয়ে ওঠেন।
একদিন নবী আয়েশার সঙ্গে কথা বলার সময় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি হাসলেন এবং বললেন, “কে যাবে জয়নাবের কাছে তাকে এই সুসংবাদ দিতে যে আল্লাহ ওপর থেকে তাকে আমার জন্য বিয়ে দিয়েছেন?” নবী তখন কুরআনের একটি আয়াত পাঠ করলেন: “তুমি তাকে বলছিলে যার প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং যাকে তুমি অনুগ্রহ করেছ।” আয়েশা বলেন, “আমি জয়নাবের সৌন্দর্যের কথা শুনে দুঃখিত ছিলাম এবং জানতাম যে এই ঘটনা তার জন্য গর্বের বিষয় হবে। আল্লাহ সরাসরি তার সঙ্গে এই বিশেষ সম্মান করলেন।”
এরপর নবীর খাদেম সালমা দ্রুত জয়নাবের কাছে গিয়ে এই সুসংবাদ জানালেন। জয়নাব তাকে এই খুশির জন্য রূপার অলংকার উপহার দেন।
এই পুরো বিষয়টি সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বলের একটি বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার বক্তব্য অনেকটা এরকম যে, এই বিষয়টি উল্লেখ করলে দুষ্টু লোকেরা দুষ্টু কথা বলবে, তাই এই কথাটি গোপন করে গেলাম! [11] –
ইবন জারীর তাবারীসহ একাধিক ঐতিহাসিক এ মত সমর্থন করেন। একাধিক মুফাস্সির ফকীহ এবং ঐতিহাসিক নবী করীম (সা) কর্তৃক তাঁকে বিবাহ করার সম্পর্কে একটা ঘটনার উল্লেখ করেছেন!
ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বল (রা) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে তা বর্ণনা করেছেন, অজ্ঞ মূর্খরা যাতে এর কদর্য (অর্থ!) না করতে পারে সে কারণে আমরা এখানে ইচ্ছা করেই তা উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকলাম।
জয়নবকে বিবাহের প্রস্তাব
খুবই ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এই জয়নবকে বিয়ের প্রস্তাব মুহাম্মদ যাইয়েদের মাধ্যমেই জয়নবের কাছে পাঠিয়েছিলেন,
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১৭/ বিবাহ
পরিচ্ছেদঃ ১৫. যায়নাব বিনত জাহশকে বিবাহ করা, পর্দার হুকুম নাযিল হওয়া এবং বিবাহের ওলীমা সাবিত প্রসঙ্গ
৩৩৭১। মুহাম্মদ ইবনু হাতিম ইবনু মায়মূন ও মুহাম্মাদ ইবনু রাফি (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন যয়নাব (রাঃ) এর ইদ্দত পূর্ণ হল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ (রাঃ) কে বললেন, তুমি যয়নাবের নিকট আমার কথা উল্লেখ কর। আনাস (রাঃ) বলেন, যায়িদ (রাঃ) রওনা হলেন এবং তাঁর নিকট গেলেন। তখন তিনি আটার খামির করছিলেন। যায়িদ (রাঃ) বলেন, আমি যখন তাঁকে দেখলাম তাঁর মর্যাদা আমার অন্তরে এমনভাবে জাগ্রত হল যে, আমি তার প্রতি তাকাতে পারলাম না। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে স্মরণ করেছেন। তাই আমি তাঁর দিকে পিঠ ফিরে দাঁড়ালাম এবং পিছনের দিকে সরে পড়লাম। এরপর বললাম, হে যয়নাব! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে স্মরণ করে আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি বললেন, আমি এ সম্পর্কে কিছুই করব না যে পর্যন্ত না আমি আমার রবের কাছ থেকে নির্দেশ লাভ না করি। এরপর তিনি তার সালাতের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
এদিকে কুরআন নাযিল হল এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে যয়নাবের বিনা অনুমতিতেই তাঁর ঘরে প্রবেশ করলেন। আনাস (রাঃ) বলেন, আমরা দেখেছি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (যয়নাবের সেই বিবাহ উপলক্ষে) দুপুর বেলায় আমাদের মাংস খাইয়েছেন। খাওয়া দাওয়ার পর লোকেরা বের হয়ে গেল কিন্তু কয়েকজন লোক খাওয়ার পর আলাপে মশগুল থাকল। এ সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে পড়লেন, আমিও তাঁর অনুসরণ করলাম। তিনি তাঁর বিবিগণের ঘরে ঘরে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সালাম করতে লাগলেন। আর বিবিগণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার এ স্ত্রীকে কেমন পেয়েছেন। আনাস (রাঃ) বলেন, আমার মনে নেই, (আলাপরত) সে লোকদের বের হয়ে যাওয়ার কথা আমিই তাঁকে জানিয়ে ছিলাম না তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তারপর তিনি চললেন এবং সে ঘরে প্রবেশ করলেন আমিও তাঁর সঙ্গে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলাম। তিনি আমার ও তাঁর মধ্যে পর্দা টেনে দিলেন। আর পর্দার বিধান নাযিল হল। আনাস (রাঃ) বলেন, লোকদের উপদেশ দেওয়া হল, যে উপদেশ দেওয়ার ছিল।
ইবনু রাফি তার হাদীসে অতিরিক্ত বর্ণনা করতে গিয়ে এ আয়াত উল্লেখ করেনঃ (অর্থ) ’তোমাদের অনুমতি দেওয়া না হলে তোমরা খাওয়ার জন্য প্রস্তুতির অপেক্ষা না করে নবীগৃহে প্রবেশ করবে না …… কিন্তু আল্লাহ সত্য বলতে সংকোচবোধ করেন না।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
বাসরে দেরী হওয়ায় আল্লাহর রাগ
মহাবিশ্বে এত এত সমস্যা থাকার পরেও এই জয়নবের সাথে নবীর সঙ্গম দেখার জন্য মহান এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ কেন এত বেশি উতলা ছিলেন, একের পর এক আয়াত নাজিল করে গেলেন, তা বোঝা মুশকিল। এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় জানা জরুরি। মুহাম্মদ সব সাহাবীকে এই বিবাহ উপলক্ষ্যে দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু দাওয়াত খেতে আসা লোকজন খানাপিনার পরে ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন না। ঐদিকে নবীর মনে তখন কামনার জোয়ার। তিনি জয়নবের সাথে বাসর করতে প্রস্তুত। লজ্জায় মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছিলেন না যে, “এইবার সবাই উঠ, আমি বাসর করবো!” মেহমানগণ চলে না যাওয়ায় নবী তার কাজই শুরু করতে পারছেন না। কী এক মহা মুসিবত। এই সময়ে আল্লাহ আরেকটি আয়াত নাজিল করে ঘর থেকে সাহাবীদের বের করে দিলেন, যেন নবী আরাম করে এবারে তার নতুন স্ত্রীর সাথে বাসর করতে পারে। ভেবে দেখুন, নবীর যৌন চাহিদা নিয়ে আল্লাহর কতই না চিন্তা! আসুন এই বিষয়ে হাদিসগুলো পড়ি,
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১৭/ বিবাহ
পরিচ্ছেদঃ ১৫. যায়নাব বিনত জাহশকে বিবাহ করা, পর্দার হুকুম নাযিল হওয়া এবং বিবাহের ওলীমা সাবিত প্রসঙ্গ
৩৩৭৭। মুহাম্মাদ ইবনু রাফি (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাবকে বিবাহ করলেন তখন উস্মু সুলায়ম (রাঃ) পাথরের একটি পাত্রে তাঁর জন্য হায়স পাঠালেন। আনাস (রাঃ) বলেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি যাও, মুসলিমদের মধ্যে যার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হয় তাকে আমার পক্ষ থেকে দাওয়াত দাও। তারপর যার সাথে সাক্ষাৎ হল আমি তাকে দাওয়াত দিলাম। তারা তাঁর কাছে আসতে শুরু করল এবং খেয়ে চলে যেতে লাগল। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত খাদ্যের উপর রাখলেন এবং তাতে দুআ পড়লেন। এতে আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি যা পাঠ করার তা পড়লেন।
যারই সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে তাকেই দাওয়াত দিতে বাদ দেইনি। সকলেই খেল এবং তৃপ্ত হল। তারা বেরিয়ে গেল কিন্তু তাদের একদল রয়ে গেল। তারা তাঁর সেখানে দীর্ঘালাপে লিপ্ত রইল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কিছু বলতে লজ্জাবোধ করছিলেন। তাই তিনি নিজেই বেরিয়ে গেলেন এবং তাদের ঘরে রেখে গেলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেনঃ (অর্থ) হে মুমিনগণ! তোমাদের অনুমতি দেওয়া না হলে আহার্য প্রস্তুতের জন্য অপেক্ষা না করে আহার গ্রহণের জন্য তোমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গৃহে প্রবেশ করবে না।
কাতাদা (রহঃ) বলেন,غير ناظرين إناه এর অর্থ তোমরা আহার্য প্রস্তুতির সময়ের যদি অপেক্ষা না কর তবে তোমাদের আহবান করলে তোমরা প্রবেশ করবে। এ বিধান তোমাদের ও তাদের হীদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র।’ (৩৩ঃ ৫৩)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১৭/ বিবাহ
পরিচ্ছেদঃ ১৫. যায়নাব বিনত জাহশকে বিবাহ করা, পর্দার হুকুম নাযিল হওয়া এবং বিবাহের ওলীমা সাবিত প্রসঙ্গ
৩৩৭৪। ইয়াহইয়া ইবনু হাবীব হারিসী, আসিম ইবনু নযর তায়মী এবং মুহাম্মদ ইবনু আবদুর আ’লা (রহঃ) … আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন যায়নাব বিনত জাহশ (রাঃ) কে বিবাহ করেন তখন তিনি লোকদের দাওয়াত করেন। তারা খাওয়া-দাওয়া করে বসে কথাবার্তা বলতে লাগল। আনাস (রাঃ) বলেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন দাঁড়াতে উদ্যত হলেন তবুও তারা উঠল না। এরূপ দেখে তিনি উঠে গেলেন। তারা উঠে যাওয়ার পর তাদের মধ্যে যারা উঠবার তারা উঠে গেল।
আসিম ও ইবনু আবদুল আ’লার বর্ননায় অতিরিক্ত রয়েছে, আনাস (রাঃ) বলেন, কিন্তু তিনজন লোক ঘরে বসে রইল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রবেশ করার জন্য এসে দেখতে পান যে, কয়েকজন লোক বসে আছে। এরপর তারাও উঠে চলে গেল। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি এসে তাদের চলে যাবার সংবাদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিলাম। আনাস (রাঃ) বলেন, তিনি এসে প্রবেশ করলেন। আমিও তার সঙ্গে প্রবেশ করতে অগ্রসর হলাম। এ সময় তিনি আমার ও তাঁর মাঝখানে পর্দা ঝুলিয়ে দিলেন। আনাস (রাঃ) বলেন, আর আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেনঃ ’তোমাদের অনুমতি দেওয়া না হলে তোমরা খাওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে নবীগৃহে প্রবেশ করবে না … আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা গুরুতর অপরাধ’
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
যায়েদের মৃত্যু
এবারে আসুন দেখি, সেই যায়েদ ইবনে হারিসার মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল। এই বিষয়টি গভীরভাবে বোঝা খুবী জরুরি এই কারণে যে, জয়নবকে বিয়ে করার কিছু সময় পরেই যায়েদকে এমন একটি ভয়াবহ যুদ্ধে ইসলামের পতাকা সহকারে পাঠিয়ে দেয়া হয়, যেই যুদ্ধে পরাজয় এবং মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। এই যুদ্ধে অন্য যাদেরকে মুহাম্মদ পাঠিয়েছিলেন, তারা কাঁদতে কাঁদতেই যুদ্ধে যাচ্ছিলেন, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই। বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই বুঝবেন, প্রায় এক লাখ রোমান সৈন্যের বিরুদ্ধে মাত্র তিন হাজার মুসলিম সৈন্য দিয়ে এই আত্মঘাতী যাত্রায় যায়েদকে কেন ইসলামের পতাকা সহকারে পাঠানো হয়েছিল। উল্লেখ্য, বিপক্ষের শত্রু সর্বদাই প্রথমে অন্য পক্ষের পতাকাবাহীকে আক্রমণ করে, তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য [12] –
আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে, বিপক্ষে ছিল দুই লক্ষ সৈন্য [13]
আয়িশার বক্তব্য
নিজ পালিত পুত্রের স্ত্রীকে আল্লাহর আয়াত নামিয়ে বিয়ে করার এই বিষয়টি নিয়ে যে খোদ নবী, নবীর স্ত্রীগণ, আর মুহাম্মদের সাহাবীদের মধ্যে একটি চাপা কানাঘুষা ছিল, তা বোঝা যায় আয়িশার এই হাদিসটি থেকে। এই হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, নবী কোন আয়াত গোপন করতে চাইলে এই আয়াতটিই গোপন করতেন, অর্থাৎ এই আয়াতের মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা গোপন করা দরকার যা আয়িশাও জানতেন। কিন্তু কোন আয়াত যখন নবী বলতেন, আয়াত লেখক সাহাবীগণ সেগুলো লিখে ফেলতেন। সেগুলো মুছে ফেলা কষ্টকর ছিল, যদি না অপেক্ষাকৃত আরও ভাল আয়াত নামিয়ে তা মানসুখ করা হতো। তাই এই আয়াতটি হয়তো গোপন করা সম্ভব হয়নি।
সুনান আত তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫০/ কুরআন তাফসীর
পরিচ্ছেদঃ সূরা আহযাব
৩২০৮. আবদুল্লাহ্ ইবন ওয়াযাহ কূফী (রহঃ) …… আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি ওহীর কিছু গোপন করতেন তবে এই আয়াতটি গোপন করতেনঃ (إِذْ تَقُولُ لِلَّذِي أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ)।
সহীহ, বুখারি ও মুসলিম, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ৩২০৮ [আল মাদানী প্রকাশনী]
(আবু ঈসা বলেন)এই হাদীসটি হাসান-সহীহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা বিনত আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)
তথ্যসূত্র
- আসহাবে রাসুলের জীবনকথা, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৭ [↑]
- তাবারী, ৩৯তম খন্ড, বায়োগ্রাফি অব প্রফেটস কম্পেনিয়নস এন্ড দেয়ার সাক্সেসরস, পৃষ্ঠা ৯ [↑]
- সূরা আহজাব, আয়াত ৩৬- ৩৭ [↑]
- কুরআনুল করীম, বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর, আবু বকর মুহাম্মদ যাকারিয়া যাকারিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২১৫৬ [↑]
- তাফসীরে মাযহারী, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০১, ৫০২, ৫০৩ [↑]
- তাফসীরে জালালাইন, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৯ [↑]
- TafsÏr al-Jal¥layn, Great Commentaries on the Holy Qur’an, translated by Feras Hamza, Royal Aal al‐Bayt Institute for Islamic Thought 2008, ISSN 1943‐1821, Page: 399, 400 [↑]
- ইবনে জারীর তাবারী (রহঃ), তারীখ ৩/১৬১[↑]
- ইবনে সাদ, তাবাকাত ৮/১০১ [↑]
- THE HISTORY OF AL-TABARI: AN ANNOTATED TRANSLATION, VOLUME XXXIX, Biographies of the Prophet’s Companions and Their Successors, AL-TABARI’S SUPPLEMENT TO HIS HISTORY, translated and annotated by Ella Landau-Tasseron, The Hebrew University of Jerusalem, State University of New York Press, Page: 180, 181 [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭২, ২৭৩ [↑]
- আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৪৪২ [↑]
- আসহাবে রাসুলের জীবনকথা, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৮ – ১২৯[↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"