07.মুসার থাপ্পরে আজরাইলের চোখ কানা

ভূমিকা

কিছু ইসলামিক গল্প বা কেচ্ছা এতই অবাস্তব ও যুক্তিহীন যে, সেগুলোর নিয়ে অনেকসময় শিক্ষিত মুসলিমরাও হতাশ হয়ে যান। ইসলামের অন্যতম প্রধান নবী মুসা এবং ফেরেশতা আজরাইলের মধ্যে সংঘটিত একটি কাহিনী, যেখানে বলা হয় মুসা নবী নাকি আজরাইলকে থাপ্পর মেরে তার এক চোখ কানা করে দেন, তা এমনই একটি গল্প, যা বাস্তবতা এবং যুক্তির কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এই লেখাটি সেই কাহিনীর অসামঞ্জস্য এবং যুক্তির মানদণ্ডে পর্যালোচনা করে দেখাবে, কেন এটি একটি উদ্ভট এবং অবাস্তব গল্প।

কাহিনীর প্রেক্ষাপট

অনেকগুলো সহিহ হাদিসের ভিত্তিতে জানা যায়, ফেরেশতা আজরাইল (মৃত্যুদূত) আল্লাহর নির্দেশে মুসার কাছে তার জান নেওয়ার জন্য আসেন। তবে মুসা নবী আজরাইলকে দেখে এতটাই ক্ষুব্ধ হন যে, তাকে থাপ্পর মেরে এক চোখ কানা করে দেন। পরে আল্লাহ পাক মুসার হায়াত বাড়িয়ে দেওয়ার কৌশল বলে দেন। এই পুরো ঘটনায় আজরাইল ছিল আল্লাহর একজন কর্মী মাত্র। আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এসেছেন এবং নিয়ম অনুসরণ করেছেন। এখানে তাকে থাপ্পর মারা আসলে কাকে থাপ্পর মারার শামিল? ধরুন, কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী আপনাকে তার কাছে নিয়ে যেতে একজন লোক পাঠিয়েছেন। আপনি সেই লোককে থাপ্পর দিলে, থাপ্পড়টি পরোক্ষভাবে আসলে কার গালে লাগে? এই কাহিনীটি পড়লে কিছু প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই ওঠে—আজরাইল কি আল্লাহর নির্দেশে এসেছিলেন? যদি তাই হয়, তাহলে মুসার থাপ্পর আসলে কার প্রতি আঘাত ছিল? সেইসাথে, আল্লাহ যদি সকল কিছু পূর্বেই নির্ধারণ করে থাকেন, তাহলে এই ঘটনাটি কেন ঘটল? আজরাইল কী আল্লাহর নির্দেশ ছাড়াই নিজে পাকনামি করতে এসেছিল, নাকি আল্লাহর হুকুম পালন করতে এসেছিল? [1] [2]

সহীহ হাদিসে কুদসি
১/ বিবিধ হাদিসসমূহ
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর প্রশংসামূলক কতক বাক্যের ফযিলত
১২৯. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “মালাকুল মউত মুসা আলাইহিস সালামের নিকট এসে তাকে বলেন: আপনার রবের ডাকে সাড়া দিন। তিনি বলেন: অতঃপর মুসা আলাইহিস সালাম মালাকুল মউতকে থাপ্পড় মেরে তার চোখ উপড়ে ফেলেন। তিনি বলেন: অতঃপর মালাকুল মউত আল্লাহর নিকট ফিরে গেল এবং বলল: আপনি আমাকে আপনার এমন বান্দার নিকট প্রেরণ করেছেন যে মরতে চায় না, সে আমার চোখ উপড়ে ফেলেছে, তিনি বলেন: আল্লাহ তার চোখ তাকে ফিরিয়ে দেন, আর বলেন: আমার বান্দার নিকট ফিরে যাও এবং বল: আপনি হায়াত চান? যদি আপনি হায়াত চান তাহলে ষাঁড়ের পিঠে হাত রাখুন, আপনার হাত যে পরিমাণ চুল ঢেকে নিবে তার সমান বছর আপনি জীবিত থাকবেন। তিনি বলেন: অতঃপর? মালাকুল মউত বলল: অতঃপর মৃত্যু বরণ করবেন। তিনি বলেন: তাহলে এখনি দ্রুত কর। হে আমার রব, পবিত্র ভূমির সন্নিকটে পাথর নিক্ষেপের দূরত্বে আমাকে মৃত্যু দান কর”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “আল্লাহর শপথ আমি যদি তার নিকট হতাম, তাহলে রাস্তার পাশে লাল বালুর স্তূপের নিকট তার কবর দেখিয়ে দিতাম”। [বুখারি ও মুসলিম] হাদিসটি সহিহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪৫/ ফযীলত
পরিচ্ছেদঃ ৩৮. মুসা (আঃ) এর ফযীলত
৫৯৩৬। মুহাম্মাদ ইবনু রাফি (রহঃ) … হাম্মাম ইবন মুনাব্বিহ সুত্রে বর্ণিত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত কয়েকটি হাদিসের অন্যতম হাদীস। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মালাকুল মাঊত মূসা (আলাইহিস সালাম) এর কাছে এসে বললো, মূসা, আপনার পালনকর্তার ডাকে সাড়া দিন। রাবী বলেন, তখন মালাকুল মাউতের চোখের উপর মূসা (আলাইহিস সালাম) একটা থাপ্পড় মারলেন, এতে তাঁর চোখ নষ্ট করে ফেলেছিলেন। এরপর ফিরিশতা আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, আপনি আমাকে আপনার এমন এক বান্দার কাছে পাঠিয়েছেন যে মরতে চায় না এবং সে আমার চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। আল্লাহ তাঁর চোখ ভালো করে দিলেন এবং বললেন, আমার বান্দার কাছে আবার যাও এবং বল, তুমি কি আরও হায়াত চাও? যদি তা চাও তবে তোমার হাত একটি বলদের পিঠের উপর রাখ। এতে তোমার হাত যতগুলো পশম ঢেকে ফেলবে, তত বছর তুমি বেঁচে থাকবে।
মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, এরপর কি? আল্লাহ বললেন, এরপর মৃত্যু বরণ করবে। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, তবে এখনই ভালো। আল্লাহ! আমাকে পবিত্র ভূমির একটি পাথরের টিলার নিকটে নিয়ে মৃত্যু দান করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহর শপথ! আমি যদি ওখানে হতাম তবে পথের কিনারে লাল বালিয়াড়ির পাশে তাঁর কবর তোমাদের দেখিয়ে দিতাম।
আবূ ইসহাক (রহঃ) … মামার (রহঃ) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ হাম্মাম ইবনু মুনাব্বিহ (রহঃ)

আসুন এবারে একটি ওয়াজ শুনে নিই,

আজরাইলের ভূমিকা এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব

প্রথমত, ইসলামিক বিশ্বাস অনুযায়ী, ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশে কাজ করেন এবং তাদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছা বা স্বাধীনতা নেই। তাই, আজরাইল যখন মুসার কাছে তার জান নেওয়ার জন্য আসেন, তা আল্লাহর নির্দেশেই হয়েছিল। তাহলে মুসা নবী যখন আজরাইলকে থাপ্পর মারলেন, আসলে এই আঘাত কি আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা ছিল না? একজন নবীর কাছ থেকে এমন আচরণ কি আশা করা যায়, যিনি আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতার সাথে এমন অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন? এর মাধ্যমে নৈতিকভাবে একজন নবীর ভূমিকা এবং আল্লাহর আদেশের প্রতি সম্মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই অবস্থানটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই অস্বাভাবিক এবং দ্বন্দ্বময়।

আল্লাহর সার্বভৌম পরিকল্পনা এবং তাকদীর

ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ তাআলা প্রতিটি ব্যক্তির তাকদীর বা ভাগ্য পূর্বনির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহ মহাবিশ্বের সৃষ্টির পূর্বেই প্রতিটি জীবনের শুরু এবং শেষের সময় নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং, মুসার জান নেওয়ার সময়ও আল্লাহর পরিকল্পনায় স্পষ্টভাবে স্থির ছিল। তাহলে, কেন আজরাইলকে মুসার জান নিতে পাঠানো হলো, যদি আল্লাহ জানতেন যে মুসা তার জান দিতে রাজি হবেন না এবং তাকে থাপ্পর মারবেন? আল্লাহ যিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান, তার কাছে এই ঘটনা স্পষ্ট ছিল। তাহলে এই অপ্রয়োজনীয় ঘটনাটি কেন ঘটানো হলো? আল্লাহ কি নিজেকে অসম্মান করতে পছন্দ করেন? তার হুকুমকে মুসা চরমভাবে অপমান করলো, এই কাহিনী আমাদের কী শিক্ষা দিলো? এক্ষেত্রে কাহিনীটি আল্লাহর সার্বভৌম পরিকল্পনা এবং তার পূর্বনির্ধারিত তাকদীরের সাথে সাংঘর্ষিক।

যদি আল্লাহ সত্যিই চেয়েছিলেন যে, মুসার জান আজরাইলের মাধ্যমে নেওয়া হবে, তবে মুসা নবীর থেকে এমন প্রতিবাদমূলক আচরণ কেন দেখা গেল? এবং মুসার আপত্তির মুখে, আল্লাহ কি তার সিদ্ধান্ত পাল্টে দিলেন? মুসা নবীর এই প্রতিরোধ কি আল্লাহর পরিকল্পনার বাইরে ঘটেছিল? এই ধরনের প্রশ্ন ধর্মীয় কাহিনীটির যুক্তির অভাব এবং অসংগতি স্পষ্ট করে তোলে।

হায়াত বাড়ানোর কৌশল এবং তাকদীর

এই গল্পে আরও একটি প্রশ্ন দেখা দেয়, যখন আল্লাহ মুসাকে তার হায়াত বাড়ানোর কৌশল জানালেন। সেই কৌশলটি মুসা কার সাথে করবেন? আল্লাহ যদি আগে থেকেই সকল জীবনের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে থাকেন, তাহলে হায়াত কীভাবে বাড়ানো সম্ভব? এটি তো আল্লাহর সার্বভৌম সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যায়। আল্লাহ কি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে পরিবর্তন করতে সক্ষম? সক্ষম হলে সেইটি যৌক্তিকভাবে বিরাট এক সমস্যার সৃষ্টি করে। কারণ তাতে আল্লাহর সর্বজ্ঞানী হওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। যদি হায়াত বাড়ানো বা কমানো সম্ভব হয়, তাহলে আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত তাকদীরের কী অর্থ থাকে? এটি ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ধারণার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

আবার, যদি মুসার হায়াত সত্যিই এই ঘটনা থেকে প্রভাবিত হয়ে থাকে, তবে এই প্রশ্নও আসে যে, আল্লাহর পূর্বনির্ধারণ কতটা স্থিতিশীল। এই কাহিনী আল্লাহর সিদ্ধান্তকে পরিবর্তনযোগ্য করে তুলছে, যা ইসলামের মূল বিশ্বাসের সঙ্গে মেলে না। এভাবে কাহিনীর ভেতরে অসংখ্য অসংগতি স্পষ্ট হয়।

ধর্মীয় গল্পের যৌক্তিক অসঙ্গতি

এই কাহিনী বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একাধিক প্রশ্ন তৈরি করে। প্রথমত, আল্লাহ যদি সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হন এবং তাকদীর আগে থেকেই নির্ধারিত, তাহলে আজরাইল কেন মুসার কাছে আসার আগেই আল্লাহ জেনেও এ ঘটনা ঘটালেন? মুসার মতো একজন নবীর আচরণ কি আল্লাহর আদেশের প্রতি অসম্মানজনক হতে পারে? এই প্রশ্নগুলো এই গল্পকে অসম্ভব এবং বাস্তবতার সঙ্গে দূরসম্পর্কিত করে তোলে।

দ্বিতীয়ত, একটি ফেরেশতা, যিনি আল্লাহর আদেশ পালন করেন, কীভাবে একজন মানুষের দ্বারা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হতে পারেন? কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, মুসা আজরাইলকে আঘাত করে তার এক চোখ কানা করে দিয়েছেন। এটি একটি অত্যন্ত অযৌক্তিক ধারণা, কারণ ফেরেশতারা আল্লাহর পক্ষ থেকে অমর এবং অলৌকিক সত্তা, যাদের ক্ষতি করা সম্ভব নয়। এই গল্পটিতে ফেরেশতাকে মানুষের মত দুর্বল করে তুলেছে, যা ফেরেশতার প্রকৃতির ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

উপসংহার:

মুসা নবী এবং আজরাইলের মধ্যকার এই কাহিনীটি যৌক্তিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অসংগতিপূর্ণ এবং অবাস্তব কল্পকাহিনী। একদিকে, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং পূর্বনির্ধারিত তাকদীরের ধারণার সঙ্গে এই ঘটনাটি বেমানান। অন্যদিকে, একজন নবীর পক্ষ থেকে আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতাকে আঘাত করা এবং তার হায়াত বাড়ানোর কৌশল আল্লাহর পরিকল্পনার বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। গল্পটির মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এতই অসংগতি রয়েছে যে, এটি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

তথ্যসূত্র

  1. সহীহ হাদিসে কুদসি, হাদিসঃ ১২৯ []
  2. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৫৯৩৬ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"