ভূমিকা
“পরকাল যদি না থাকে, তাহলে জীবনের উদ্দেশ্য কী?”—এই প্রশ্নটি ধর্মবিশ্বাসীদের মুখে শুনতে শুনতে তা যেন এক ধরনের মুখস্ত বুলিতে পরিণত হয়েছে। যেটি আদৌ কোন যুক্তি নয়, এক ধরণের আবেদন বা প্রত্যাশা। কিন্তু এই প্রত্যাশার ভিত্তিই হলো একটি গভীর স্ববিরোধিতা এবং মানবিক চেতনার প্রতি অবিচার। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের মুক্তবুদ্ধিকে শৃঙ্খলিত করে, উদ্দেশ্যকে পরিণত করে ঈশ্বর নামক একটি অনির্দিষ্ট অপ্রমাণিত সত্তার গোলকধাঁধায়। প্রশ্ন হলো, যদি ঈশ্বরের আরাধনাই আর পরকালই মানুষের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তবে ঈশ্বরের নিজের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী? এই লেখায় ধর্মীয় এই অযৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করা হবে এবং দেখানো হবে যে, পরকালের ধারণা ছাড়াই জীবন অর্থহীন নয়—বরং ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসই জীবনের স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে কলুষিত করে।
উদ্দেশ্যের নামে ভয় ও লোভের বাণিজ্য
ধর্মীয় মতবাদ জীবনের “উদ্দেশ্য”কে জিম্মি করে রেখেছে স্বর্গ-নরকের ভয় ও লোভের জালে। এখানে নৈতিকতা হলো একটি লেনদেন বা বাণিজ্য, ভালো কাজ করো, পুরস্কার পাবে; পাপ করো, শাস্তি ভোগ করবে। কিন্তু এই লেনদেনি দৃষ্টিভঙ্গি আসলে নৈতিকতাকে ভিত্তিমূলকেই নষ্ট করে। কারণ, স্বার্থহীন মানবিকতা—যেমন মায়ের স্নেহ, বন্ধুর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, বা অপরিচিতের সাহায্য—এই সমস্তই যদি শুধুমাত্র “পরকালীন স্কোর” বাড়ানোর কৌশল হয়, তাহলে সেটি মানবিক কাজ হয় কীভাবে?
ধরুন, একটি ছেলে বাড়ির পথ হারিয়ে রাস্তায় খুব অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। একজন সচেতন নীতিবান মানুষ হিসেবে আপনার উচিত ছেলেটিকে বাড়ি খুঁজে পেতে সাহায্য করা। কিন্তু ছেলেটির পোশাক আশাক দেখে আপনার যদি ধারনা হয় যে, ছেলেটি খুব ধনী পরিবারের, একে সেই ধনী পরিবারে পৌঁছে দিলে ছেলেটির পরিবার আপনাকে অনেক টাকা পুরষ্কার দেবে, এই চিন্তা নিয়ে কাজটি করলে, সেটি কী আর নৈতিক বা মানবিক কাজ থাকে? নাকি একটি ব্যবসায়ে পরিণত হয়? পুরষ্কারের লোভ যখনই আপনার মনে চলে আসবে, বা শাস্তির ভয়ে যখনই কোন কাজ করবেন, সেটি তো আপনি নৈতিক কারণে করেন নি। স্বার্থের কারণে করেছেন।
ধর্মগুলো সাধারণত দাবী করে, “ঈশ্বর না থাকলে নৈতিকতার ভিত্তিই থাকে না।” কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, বহু নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, বা মানবতাবাদী সমাজে ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা ও প্রেমের চর্চা ধর্মাশ্রয়ী সমাজের চেয়ে কম নয়। উদাহরণস্বরূপ, বুদ্ধের দর্শন বা কার্ল মার্কসের সমাজতন্ত্র ঈশ্বর-কেন্দ্রিক নয়, কিন্তু তারা মানবিক মূল্যবোধকে উচ্চাসনে রাখে। অথচ ধর্মীয় মতবাদে নৈতিকতা হলো ঈশ্বরের আদেশের আনুগত্য মাত্র—যা যুক্তিহীন, অন্ধ, এবং কখনো কখনো অমানবিক (যেমন দাসপ্রথা, নারী অধিকারের দমন ইত্যাদির ধর্মীয় বৈধতা)।
প্রশ্ন: যদি ঈশ্বরের আদেশই একমাত্র নৈতিকতার মাপকাঠি হয়, তাহলে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত গণহত্যা, জাতিগত বিভেদ, বা নারীর প্রতি বৈষম্য কীভাবে নৈতিক হয়?
ঈশ্বরের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য: যুক্তির ধোঁকাবাজি
ধর্মবিশ্বাসীরা বলেন, “ঈশ্বর স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাঁর কোনো উদ্দেশ্যের প্রয়োজন নেই।” কিন্তু এই উত্তরটি যুক্তির চেয়ে বেশি আত্মসমর্পণের ভাষা। যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব “স্বয়ংপ্রমাণিত” হয়, তবে মানুষের জীবন বা অস্তিত্বও তেমনই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে। ধর্মীয় যুক্তি এখানে একটি দ্বৈত নীতির আশ্রয় নেয়: ঈশ্বরের জন্য উদ্দেশ্য অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু মানুষের জন্য তা অপরিহার্য। এটি পরিষ্কারভাবেই special pleading fallacy বা কুযুক্তি।
ধর্মতত্ত্বে ঈশ্বরকে “অনাদি-অনন্ত” বলা হয়। কিন্তু এই ধারণাটি যুক্তির দৃষ্টিতে অসম্ভব। কারণ, কোনো কিছুর “অনন্ত” অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না—তা ঈশ্বরই হোন বা পরকাল। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শন বলে, প্রতিটি সত্তার একটি শুরু আছে। তাই ঈশ্বর যদি “অনাদি” হন, তাহলে তাঁর অস্তিত্বের কারণ কী? ধর্মীয় উত্তর হলো, “তিনি নিজেই কারণ।” কিন্তু এটি একটি সার্কুলার যুক্তি (Circular Reasoning), যা যুক্তিবিদ্যায় অগ্রহণযোগ্য।
চ্যালেঞ্জ:
- যদি ঈশ্বরের কোনো উদ্দেশ্য না থেকেও তিনি অর্থপূর্ণ হন, তবে মানুষও কেন নয়?
- যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব “স্বয়ংসম্পূর্ণ” হয়, তবে মানুষের অস্তিত্বও স্বয়ংসম্পূর্ণ—পরকাল ছাড়াই।
পরকালের পরেও পরকাল? যুক্তির অনন্ত রিগ্রেস
ধর্মবিশ্বাসীরা পরকালকে “চূড়ান্ত উদ্দেশ্য” হিসেবে উপস্থাপন করেন। কিন্তু এখানে একটি যুক্তিগত ফাঁদ লুকিয়ে আছে: অনন্ত রিগ্রেস (Infinite Regress)। যদি পরকালই আমাদের ইহকালীন জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে পরকালের জীবনের উদ্দেশ্য কী হবে? পরকালের পরেও কি আরেকটি পরকাল আছে? পরকালের জীবনে কে কী করলো, তার ওপর ভিত্তি করে কী পরকালের পরকালে শাস্তি বা পুরষ্কার রয়েছে? যদি তা না থাকে, তাহলে তো পরকালের জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে। তাহলে, সেই অর্থহীন জীবনটিই আমাদের ইহকালীন জীবনের উদ্দেশ্য? অর্থাৎ, আমাদের জীবন বা অস্তিত্বের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, অর্থহীনতা? ধর্মীয় উত্তরদাতারা এখানে বলবেন, “এটি ঈশ্বরের রহস্য, মানুষের বোধের বাইরে।” কিন্তু এসব উত্তর আসলে যুক্তিকে স্তব্ধ করার কৌশল মাত্র।
যুক্তিবাদী দর্শন বলে, কোনো কিছুর উদ্দেশ্য যদি তার চেয়ে বড় কোনো উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে, তবে তা কখনোই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। যেমন—একটি বই লেখার উদ্দেশ্য হলো পাঠককে জ্ঞান দেয়া, পাঠকের উদ্দেশ্য হলো সমাজ পরিবর্তন করা, সমাজের উদ্দেশ্য হলো… এভাবে চক্র চলতেই থাকে। ঠিক তেমনই, যদি ঈশ্বরের উদ্দেশ্য থাকে, তবে সেই উদ্দেশ্যেরও একটি উদ্দেশ্য থাকতে হবে। এই কাঠামোয় ঈশ্বরের ধারণাই অর্থহীন হয়ে পড়ে।
উদ্দেশ্য সৃষ্টির মিথ: মানুষই তার নিজের ঈশ্বর
ধর্মীয় গল্পে মানুষকে বলা হয়, “তুমি ঈশ্বরের সেবার জন্য জন্মেছ।” কিন্তু এই বক্তব্য মানুষের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিচে (Nietzsche) বলেছিলেন, “ঈশ্বর মৃত। আমরা তাকে হত্যা করেছি।” তাঁর মতে, ঈশ্বরের মৃত্যু মানুষের মুক্তির সূচনা। কারণ, মানুষ এখন নিজেই তার নৈতিকতা, উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পারে।
জীবনের উদ্দেশ্য কী? এর উত্তর প্রতিটি মানুষের নিজস্ব। একজন বিজ্ঞানীর উদ্দেশ্য জগতের রহস্য উদঘাটন, একজন কবির উদ্দেশ্য শব্দের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ, একজন কৃষকের উদ্দেশ্য ফসল ফলানো। এই বৈচিত্র্যই জীবনকে সুন্দর করে। অথচ ধর্মবাদীরা চান সকলের উদ্দেশ্য একই হোক: “ঈশ্বরের সন্তুষ্টি।” এটি মানবিক সৃজনশীলতাকে ধ্বংস করার শামিল।
ঐতিহাসিক উদাহরণ:
- চার্লস ডারউইন ঈশ্বরের পরিবর্তে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে জীবনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছিলেন।
- স্টিভেন হকিং বলেছেন, “মহাবিশ্বের কোনো স্রষ্টার প্রয়োজন নেই।”
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “মানুষের বিশ্বাস যেখানে মুক্ত, যেখানে অন্ধ নয়… সেখানেই তার মহত্ত্ব।”
উপসংহার: ঈশ্বরের মৃত্যুতে মানুষের জয়গান
পরকাল বা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে জীবনের উদ্দেশ্য বললে, মানুষ নিজেকে ছোট করে। এটি একটি শিশুসুলভ মানসিকতা—যেখানে “বাবা” (ঈশ্বর) সবকিছু ঠিক করবেন, আমরা শুধু তাঁর হুকুম মানব। কিন্তু প্রকৃত প্রাপ্তবয়স্ক মানসিকতা হলো নিজের দায়িত্ব নেওয়া। জীবন যদি ক্ষণস্থায়ীও হয়, তবে তার মাহাত্ম্য কম নয়। একটি মোমবাতি অনন্তকাল জ্বলে না, কিন্তু তার আলোয় অন্ধকার ঘর উজ্জ্বল হয়।
মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কোনো ঐশী নাটক বা মহাজাগতিক চরিত্রের খেলনা হওয়া নয়। বরং তা প্রতিটি মানুষ আলাদা, তাদের বুদ্ধি চিন্তাভাবনা আলাদা। তারা সময়ের হাতে গড়া এক একটি শিল্পকর্ম। পরকালের ভয় দেখিয়ে যারা এই শিল্পকে নষ্ট করতে চান, তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ঠাই পাবেন। কারণ, মানুষের মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তির শক্তিই হলো তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার—এবং এই পুরস্কার কোনো পরকালের মুখাপেক্ষী নয়।