14.আল্লাহর বক্তব্য যাচাই করার উপায় কী?

ভূমিকা

তর্কের খাতিরে ধরে নিই, “কোরআন সত্যিই এক অতিপ্রাকৃতিক সত্তার পক্ষ থেকে এসেছে!” মুহাম্মদের সকল কথাই যদি আমরা মেনে নিই যে, মুহাম্মদের কাছে হেরা গুহায় এক অলৌকিক সত্তা এসেছিল এবং কিছু বানী দিয়ে গেছে।—আমাদের পরিচিত জগত, মানুষ, ইত্যাদির বাইরে থেকে এসব এসেছে, এমনটি যদি বিবেচনা করি। প্রশ্ন হলো, এই গ্রন্থে যে সত্তা নিজেকে “আল্লাহ” নামে পরিচিত করিয়েছে, তার দাবিগুলো যে সত্য, এটি আমরা কীভাবে যাচাই করবো? তিনিই যে আসলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, অন্যের সৃষ্টি করা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের কাছে ক্রেডিট নেয়ার জন্য মিথ্যা বলেনি, সেটি যাচাই করার উপায় কী? এমন কী হতে পারে না, এটি একদল এলিয়েনের পক্ষ থেকে এসেছে, যারা আমাদের মিথ্যা বলেছে? অথবা, এমন কি সম্ভাবনা নেই যে মুহাম্মদের নিকট যে সত্তাটি এসেছে, সে আদতে এক “অশুভ সত্তা”, যিনি মানবতাবিরোধী আদর্শ প্রচার করেছেন এবং সত্যিকারের স্রষ্টার পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করেছেন?

এই প্রসঙ্গে একটি সিনেমার একটি অংশ প্রাসঙ্গিক বিধায় সেই অংশটি দেখার অনুরোধ করছি। এই ভিডিওটির শেষ অংশে একটি চরিত্র জন কার্টারকে কিছু কথা বলে, সেগুলো আমাদের এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক,


মুহাম্মদ কী নিজে যাচাই করে দেখেছিল?

যদি আমরা ধরে নিই মুহাম্মদ সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তার (ওয়ারাকা বিন নওফেলের মতে তিনি ছিলেন জিবরাইল) মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাহলে প্রশ্ন আসে—তিনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে এই সত্তার দাবিগুলো সত্য? একজন অশিক্ষিত মরুভূমির মানুষ, যিনি যুক্তির কাঠামো, যৌক্তিক সংশয় বা পর্যালোচনার পদ্ধতি জানতেন না, তিনি কীভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই অভিজ্ঞতাটি ঈশ্বরীয়, এবং ঐ সত্তার বক্তব্যগুলোই চূড়ান্ত সত্য? এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ফাঁক থেকে যায়।

ধরা যাক, একজন মানুষ স্বপ্নে একটি সত্তাকে দেখলো, যিনি তাকে বললেন—“আমি মহাবিশ্বের স্রষ্টা, সুতরাং আমি যা বলছি সব কথাই ধ্রুব সত্য। তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি এই কাজগুলো করো।” এখন সে মানুষ যদি কোনো যাচাই-বাছাই না করে শুধু সেই বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলে, তাহলে তার বিশ্বাস কি যৌক্তিক বলে গণ্য করা যেতে পারে, বা সেই বিশ্বাস কী অন্যদের ওপর বাধ্যতামূলক হতে পারে? কিংবা আরও গভীরভাবে ভাবলে, সেই অভিজ্ঞতা কোনো মানসিক বিভ্রম বা স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া হলেও হতে পারে। আধুনিক মনোবিজ্ঞান যেমন সিজোফ্রেনিয়া, অডিটরি হ্যালুসিনেশন বা আইসোলেশন সাইকোসিসের মতো পরিস্থিতিতে মানুষের মস্তিষ্কেও “আওয়াজ শোনা” বা “আলোকদ্যুতি দেখা” অসম্ভব নয়। তখন প্রশ্ন উঠে—যিনি এসব দাবি করেছেন, তিনি নিজেই কি জানতেন না যে তিনি যাচাই না করেই বিশ্বাস করছেন?

আরও বড় প্রশ্ন হলো, যে বানী মুহাম্মদের কাছে এসেছিল, সেটি যদি কোনো অশুভ সত্তার হয়, যেটি তাকে মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত করার জন্য, ঘৃণা, যুদ্ধ ও বিভেদের বার্তা দিয়েছে, তবে সেটিকে মহাবিশ্বের স্রষ্টার বক্তব্য বলে ধরে নেওয়া কতটা যৌক্তিক? আমরা দেখতে পাই, কোরআনের অনেক বক্তব্য যেমন কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, নারীদের অধিকারহরণ, অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, এগুলো মহাজাগতিক চেতনালোক থেকে উদ্ভূত কোনো সর্বজ্ঞানী সত্তার কথাবার্তার সঙ্গে সহজে খাপ খায় না। ভেবে দেখুন, আল্লাহ কাফেরদের বিরুদ্ধে হওয়া যুদ্ধের পরে কাফেরদের থেকে লুণ্ঠিত গনিমতের মালের এক পঞ্চমাংশ চাচ্ছেন, আল্লাহ কখনো ধার চাচ্ছেন, আল্লাহ কখনো নবীর হয়ে কাফেরদের গালাগালি দিচ্ছেন (সূরা লাহাব), নবীর দাসী সম্ভোগ নিয়ে নবীর স্ত্রীদের ধমক দিচ্ছেন, এগুলো কীভাবে সর্বশক্তিমান সত্তার বৈশিষ্ট্য হতে পারে?

আবার, ইসলামের দাবি অনুযায়ী, মুহাম্মদ নিজেই আল্লাহকে কখনো দেখেননি। মেরাজের সময়ও আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি, বরং মধ্যস্থ সত্তার মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। তার মানে, মুহাম্মদ নিজেও জানতেন না ইসব বানীর উৎস আসলেই কে বা কী। এমন অবস্থায়, মরুভূমিতে বসবাসকারী একজন অশিক্ষিত একজন মানুষের দাবি যে তিনি ‘আল্লাহর’ বার্তা পেয়েছেন, সেটিকে নিঃসংশয়ে সত্য ধরে নেওয়া কী কোন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হতে পারে? যেমন একটি আদালতে যদি একজন ব্যক্তি বলেন, “আমি স্বপ্নে খুনিকে খুন করতে দেখেছি,” সেটি কি প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়?

এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, মুহাম্মদের অভিজ্ঞতা কোনো নিরপেক্ষ যাচাই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া ছাড়াই ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থে রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ দর্শনের মৌলিক নীতি অনুসারে, সব দাবি যাচাইযোগ্য হতে হয়—বিশেষ করে যখন সেই দাবির উপর কোটি কোটি মানুষের নৈতিকতা, আইন এবং জীবনধারা নির্ভর করছে। কাজেই এই দাবি কতটা যৌক্তিক এবং কতটা বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, তা নিয়ে গভীর প্রশ্ন থেকেই যায়।


ঈশ্বরের দাবির যাচাই: গাণিতিক যুক্তির বাইরের প্রশ্ন

একজন ব্যক্তি যদি দাবী করে যে সে ঈশ্বর, এবং তার বাণীই চূড়ান্ত সত্য, এবং তার বক্তব্য যাচাই করা যাবে না, শুধু অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতে হবে, এরকম দাবীকে আমরা কী মেনে নিতে পারি? গায়েবী এইসব বিষয় সম্পর্কে অন্ধবিশ্বাসের পক্ষে যুক্তিটি কী হতে পারে? সেইসব বক্তব্য যাচাই করার প্রক্রিয়াটি কেমন হবে? কারণ এ দাবির উৎস মানুষের অভিজ্ঞতাতীত—এটি মহাজাগতিক বা অতিপ্রাকৃতিক অস্তিত্বের বিষয়ে। আর যদি যাচাই করা আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে সম্ভব না হয়ে থাকে, তাহলে সেটি তো সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই সত্য। সেই যুক্তিতে সকল ধর্মের দাবীই তো সত্য হিসেবে ধরে নিতে হবে।একইসাথে, যেকোন মানুষী যেকোন দাবী করবে, সেটিও সত্য হিসেবে মানতে হবে। কারণ আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতা রয়েছে।

কোরআন বারবার আল্লাহ নামক সত্তাটিকে “পরম দয়ালু, পরম ক্ষমাশীল”, আবার একইসাথে “প্রতিশোধপরায়ণ”, “যুদ্ধপ্রিয়”, ও “নরকে পোড়ানোয় আগ্রহী” হিসেবে চিত্রিত করে। এই দুই বিপরীত বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ এক ঐশী সত্তার মধ্যে কীভাবে সম্ভব, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ।


অশুভ সত্তার সম্ভাবনা: একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক সংকট

যদি ধরা হয়, মুহাম্মদ সত্য বলছেন এবং তার নিকট কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা এসেছিল, তাহলে সেই সত্তা যে “আল্লাহ” নামের শ্রেষ্ঠ স্রষ্টাই, তা কি আমরা নিশ্চিতভাবে জানি? যদি এই সত্তা আদতে এক “অশুভ বা বিভ্রান্তিকর সত্তা” হয়ে থাকে, যে মানুষের মধ্যে যুদ্ধ, বিভেদ, নারী-বিদ্বেষ, কাফির-বিরোধিতা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে—তাহলে আমরা কোরআনকে ‘দৈব্যবাণী’ হিসেবে কীভাবে গ্রহণ করবো?


আল্লাহর দাবির সত্যতা যাচাইযোগ্য কিনা

যখন কোরআনে বলা হয়, “আমি পরম করুণাময়”, কিন্তু পাশাপাশি বলা হয়, “কাফিরদের জন্য আছে অনন্তকালীন জাহান্নামের আগুন”, তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে—এই করুণার সংজ্ঞা কার কাছে? যদি ঈশ্বর নিজেই নিজেকে সংজ্ঞায়িত করেন, তবে সেটি বৃত্তাকার যুক্তি নয় কি?

একজন স্বৈরাচারী শাসক যদি নিজেই তার আইন তৈরি করেন, নিজেই সেই আইন ভাঙার জন্য শাস্তি নির্ধারণ করেন, এবং তারপর নিজেই ঘোষণা দেন, “আমি ন্যায়পরায়ণ,” তাহলে সেই দাবির ন্যায়বোধ কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। কারণ বিচার ও ন্যায়ের বৈধতা নির্ভর করে বহুপাক্ষিক যাচাইয়ের ওপর—একটি সিস্টেম যেখানে দাবিকারী নিজেই বিচারক, আইনপ্রণেতা ও কার্যনির্বাহী, সেখানে সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ স্বয়ং নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, একটি কাল্পনিক রাষ্ট্রে এক শাসক আছেন—তিনি ঘোষণা দেন, “আমার আইনই সর্বোচ্চ নৈতিক আইন, এবং যারা এর বিরোধিতা করবে তারা কাফের এবং হত্যাযোগ্য, মানবতার শত্রু।” এখন যদি সেই শাসকই বলেন, “আমি মানবতার রক্ষক,” তাহলে সেটা নিছক আত্মপ্রশংসা মাত্র, যদি না সেই আইনের ন্যায্যতা, মানবিকতা বা যুক্তিনির্ভরতা নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা যায়।

এই ধরনের যুক্তিকে আমরা ধর্মীয় বর্ণনাতেও দেখতে পাই। যদি বলা হয়, আল্লাহ নিজেই আইন দিয়েছেন, নিজেই শাস্তি নির্ধারণ করেছেন, এবং নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি “আদাল”, অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ—তাহলে প্রশ্ন উঠে, এই দাবির সত্যতা আমরা কিসের ভিত্তিতে যাচাই করবো? আমরা কি কোনো স্বাধীন নৈতিক মানদণ্ড ব্যবহার করে বলতে পারবো, এই ন্যায়ের ধারণা সত্যিই ন্যায়সঙ্গত কিনা? নাকি আমাদের শুধু ঈশ্বরের দাবিকে মানতে হবে এই কারণে যে তিনি নিজেই নিজেকে ‘ন্যায়পরায়ণ’ বলছেন?

আরেকটি উদাহরণ ধরা যাক—ধরুন কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তা এসে বলে, “আমি ঈশ্বর, আমি যা বলি তাই সত্য, কারণ আমি নিজেই সত্যের উৎস।” এই ধরনের দাবির সঙ্গে সমস্যা হলো: এটি বৃত্তীয় যুক্তিতে (circular reasoning) পড়ে। এটি এমন একটি যুক্তি যা নিজের সত্যতা প্রমাণ করতে নিজেকেই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন: “আমি সত্য বলি, কারণ আমি বলেছি আমি সত্য বলি।”

এই ধরণের যুক্তির বিপরীতে দার্শনিক ডেভিড হিউম কিংবা ইমানুয়েল কান্টের মতো চিন্তাবিদরা বলেছেন—ন্যায়, সত্য বা নৈতিকতার মাপকাঠি হতে হবে এমন কিছু যা অভিজ্ঞতা, যুক্তি এবং সর্বজনীন বোধগম্যতার উপর দাঁড়িয়ে থাকে, কেবল ক্ষমতা বা অলৌকিকতার ভিত্তিতে নয়। ফলে, যদি কোনো ঈশ্বর নিজেকে ন্যায়পরায়ণ বলেন, তাহলে সেই দাবির সত্যতা যাচাই করতে হবে তার আইন, নির্দেশ ও আচরণের বিশ্লেষণ করে—তিনি নিজে সেটি বলেছেন, সেটির ওপর নয়।

এইভাবে দেখা যায়, স্বঘোষিত ন্যায় বা সত্য দাবি, যদি নিজেরই তৈরি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার সত্যতা যাচাইয়ের কোনো স্বাধীন পদ্ধতি না থাকে, তাহলে সেটিকে যুক্তিগতভাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। ন্যায়পরায়ণতা বা সত্যতা হলো এমন কিছু যা কেবলমাত্র দাবি নয়, প্রমাণসাপেক্ষ এবং পর্যালোচনাযোগ্য।


উপসংহার

সুতরাং, যদি আমরা ধরে নিই কোরআন সত্যিই একটি অতিপ্রাকৃতিক সত্তার কাছ থেকে এসেছে, তবুও আমাদের সামনে থেকে যাচ্ছে জ্ঞানতাত্ত্বিক এক জটিল প্রশ্ন—এই সত্তা আসলেই মহাবিশ্বের স্রষ্টা কিনা, নাকি এক শক্তিমান, বিভ্রান্তিকর, এবং স্বার্থান্বেষী সত্তা, যিনি মানবজাতিকে তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার বলি বানিয়েছেন? যুদ্ধ বাধিয়ে মানুষ হত্যা করে এক ধরণের নির্মম রসিকতা করছেন? এ প্রশ্নগুলো আমাদের এক গভীর দার্শনিক অন্বেষণের দিকে আহ্বান জানায়—যেখানে ঈশ্বরধারণাও মানুষের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে পারে।