সূচিপত্র
- 1 সারসংক্ষেপ
- 2 ভূমিকাঃ ঈশ্বরধারণা ও প্রেক্ষিত
- 3 কোরআন ও হাদিসে শারীরিক আল্লাহর চিত্র
- 4 দার্শনিক চ্যালেঞ্জ: গ্রিক যুক্তিবাদ ও ইসলামী চিন্তায় মিথস্ক্রিয়া
- 5 আল্লাহর বিমূর্তিকরণ ও কালামবিদদের পুনঃব্যাখ্যা
- 6 দার্শনিক আল্লাহর রূপায়ণ: ইবনে সিনা থেকে ইবনে রুশদ
- 7 বিবর্তনের পেছনে সমাজ-সংস্কৃতির ভূমিকা
- 8 উপসংহার
- 9 তথ্যসূত্র
সারসংক্ষেপ
ইসলামী ধর্মতত্ত্বে আল্লাহ একজন সর্বোচ্চ সত্তা, যিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু এই ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ইসলামের ইতিহাসে একরৈখিক নয়। প্রাচীন পৌত্তলিক মক্কা থেকে উদ্ভব হওয়া ইসলামের প্রারম্ভিক বা সালাফদের যুগের আল্লাহকে একটি শারীরিক সত্তা হিসেবে কল্পনা করা হতো, যার হাত, পা, মুখ ও শারীরিক অবস্থান ছিল—এমনকি তিনি হাত পা পরিচালনা করেন, নড়াচড়া করেন, বসেন, দেখেন, শোনেন এবং কথা বলেন। তিনি রাগ করেন, খুশি হন, ব্যাথিতও হন, মানবিক প্রায় সকল হরমোনাল অনুভূতি তার মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু পরবর্তী শতকে গ্রিক দর্শন ও যুক্তিবাদের প্রভাবে মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে এই ধারণা সংকটের মুখে পড়ে এবং একটি দার্শনিক, বিমূর্ত ও নিরাকার আল্লাহর ধারণা জন্ম নেয়। বর্তমান সময়ে প্রায় বেশিরভাগ মুসলিমই মনে করেন, আল্লাহ নিরাকার, অথচ ইসলামের কোথাও আল্লাহ নিরাকার এরকম কোন কথাই বলা হয়নি। তাহলে এই নিরাকার আল্লাহর ধারনা কোথা থেকে আসলো? এই প্রবন্ধে আল্লাহর বিবর্তনশীল রূপান্তরের ইতিহাস, আল্লাহর ওপর ইসলামী দার্শনিকদের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ভূমিকাঃ ঈশ্বরধারণা ও প্রেক্ষিত
ঈশ্বরের ধারণা আদতে মানবসভ্যতার একটি কল্পনাপ্রসূত প্রতিফলন, যা সময়, সমাজ ও রাজনৈতিক চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে গঠিত ও পরিবর্তিত হয়। ‘আল্লাহ চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়’—এই দাবির বিপরীতে ঐতিহাসিক পাঠ বলছে, ইসলামের সূচনালগ্নে এই আল্লাহ ছিলেন এক শারীরিক, পুরুষতান্ত্রিক, প্রতিশোধপরায়ণ অধিপতি—যাঁর চোখ, কান, হাত-পা, এমনকি রাগ ও হাঁসির ক্ষমতাও ছিল। পরবর্তী সময়ে, মুসলিম সভ্যতা যখন গ্রিক যুক্তিবাদের মুখোমুখি হলো, তখন সেই দৈহিক আল্লাহ এক গভীর দার্শনিক সংকটে পড়ে। চিন্তাবিদরা বাধ্য হন পূর্বের আল্লাহকে রূপক ভাষায় পুনর্ব্যাখ্যা করতে বা একেবারে বিমূর্ত সত্তায় রূপান্তর করতে। এই পরিবর্তন মুহাম্মদের আল্লাহর বৈশিষ্ট্য নয়, বরং পরবর্তী যুগের মুসলিমদের স্বার্থ, সংকট ও বুদ্ধিবৃত্তিক চাপে আল্লাহর ধারণার ধারাবাহিক অভিযোজন। সুতরাং, আল্লাহর রূপ কখনোই চিরন্তন বা অপরিবর্তনীয় নয়; বরং তা ইতিহাস, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও জ্ঞানতাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের রক্তমাখা আয়নায় নির্মিত এক বিবর্তনশীল চরিত্রমাত্র।
কোরআন ও হাদিসে শারীরিক আল্লাহর চিত্র
কোরআনে আল্লাহর শরীরের বর্ণনা
শরীরসংবলিত ঈশ্বরের ধারণার ভিত্তি রয়েছে কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে। নিচে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেওয়া হলো [1] [2] [3]
যেদিন (ক্বিয়ামতে) পায়ের গোছা (হাঁটুর নিম্নভাগ) উন্মোচিত হবে আর তাদেরকে ডাকা হবে সেজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সেজদা করতে সক্ষম হবে না।
— Taisirul Quran
স্মরণ কর, গোছা পর্যন্ত পা খোলার দিনের কথা, সেদিন তাদেরকে আহবান করা হবে সাজদাহ করার জন্য, কিন্তু তারা তা করতে সক্ষম হবেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
সে দিন পায়ের গোছা* উন্মোচন করা হবে। আর তাদেরকে সিজদা করার জন্য আহবান জানানো হবে, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না। *এ কথার ব্যাপারে ইমাম বুখারী একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তা হল, আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাদের রব তাঁর পায়ের গোছা উন্মুক্ত করবেন, তখন প্রত্যেক মুমিন নর-নারী তাঁকে সিজদা করবে…।
— Rawai Al-bayan
স্মরণ করুন, সে দিনের কথা যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচিত করা হবে [১], সেদিন তাদেরকে ডাকা হবে সাজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না;
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
তিনি আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন।
— Taisirul Quran
তিনিই ছয় দিনে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমাসীন হয়েছেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
তিনিই আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশে উঠেছেন।
— Rawai Al-bayan
তিনি ছয় দিনে আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন; তারপর তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
‘আরশে দয়াময় সমুন্নত আছেন।
— Taisirul Quran
দয়াময় আরশে সমাসীন।
— Sheikh Mujibur Rahman
পরম করুণাময় আরশের ওপর উঠেছেন* । * এ আয়াতে আল্লাহর একটি ক্রিয়াবাচক গুণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে استواء বা আরশের উপর উঠা। ইমাম মালেককে এ গুণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, استواء এর অর্থ জানা আছে। তবে তার ধরন (كيفيت) জানা নেই। এর প্রতি ঈমান রাখা ওয়াজিব এবং ধরন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা বিদআত। এ নীতিটি আল্লাহর সকল গুণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
— Rawai Al-bayan
দয়াময় (আল্লাহ্) আরশের উপর উঠেছেন [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
হাদিসে আল্লাহর মানবসদৃশ বৈশিষ্ট্য
আল্লাহর ওজন
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, আল্লাহ পাকের ওজন রয়েছে। যার প্রমাণ মেলে নিচের হাদিসটি থেকে। তাকে আরশ সহকারে বহন করার জন্য বিরাট বিরাট ফেরেশতার দরকার হয় [4] –
সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩৫/ সুন্নাহ
পরিচ্ছেদঃ ১৯. জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায় সম্পর্কে
৪৭২৭। জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে সকল ফিরিশতা আল্লাহর আরশ বহন করেন, তাদের একজনের সঙ্গে আলাপ করার জন্য আমাকে অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তার কানের লতি থেকে কাঁধ পর্যন্ত স্থানের দূরত্ব হলো সাতশ বছরের দূরত্বের সমান।[1]
সহীহ।
[1]. তাবারানী।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনসারী (রাঃ)
কেউ দাবী করতে পারেন, ঐটা আল্লাহর ওজন নয়, আরশের ওজন। কিন্তু সেটিও যুক্তিতে সঠিক বলা যায় না। কারণ, মাঝে মাঝে রাগে দুঃখে শোকে আল্লাহর আরশ কেঁপেও ওঠে। প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহর ওজন না থাকলে আরশ বা আল্লাহর সিংহাসন কেঁপে উঠবে কেন? আরো প্রশ্ন হচ্ছে, নবীর এক সাহাবীর মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেন কেঁপে উঠলো? আল্লাহর তো আগে থেকেই জানার কথা, সেই সাহাবী কবে কখন মারা যাবে। আসলে আল্লাহই তো সেই মৃত্যু ঘটান। তাহলে আরশ কেন কাঁপলো? সাধারণত আমরা রাগে দুঃখে শোকের কারণে কেঁপে উঠি। কিন্তু আল্লাহর আরশ কাঁপার প্রয়োজন কী? [5]
সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পরিচ্ছদঃ ২১২২. স্বাদ ইবন মু’আয (রাঃ) এর মর্যাদা
৩৫৩১। মুহাম্মদ ইবনু মূসান্না (রহঃ) … জাবির (রাঃ) বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি সা’দ ইবনু মু’আয (রাঃ) এর মৃত্যুতে আল্লাহ্ ত’আলার আরশ কেঁপে উঠে ছিল। আমাশ (রহঃ) … নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যাক্তি জাবির (রাঃ) কে বলল, বারা ইবনু আযিব (রাঃ) তো বলেন, জানাযার খাট নড়েছিল। তদুত্তরে জাবির (রাঃ) বললেন, সা’দ ও বারা (রাঃ) এর গোত্রদ্বয়ের মধ্যে কিছুটা বিরোধ ছিল, (কিন্তু এটা ঠিক নয়) কেননা, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে عَرْشُ الرَّحْمَنِ অর্থাৎ আল্লাহর আরশ সা’দ ইবনু মু’আযের (মৃত্যুতে) কেঁপে উঠল বলতে শুনেছি।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
আল্লাহর চোখ রয়েছে
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ পাকের চোখ রয়েছে। নবী মুহাম্মদ এই প্রসঙ্গে তার অনুসারীদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, আল্লাহর চোখ টেরা নয়।
সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী)
অধ্যায়ঃ ১। ঈমান (বিশ্বাস)
পরিচ্ছদঃ ৭৫. মারইয়াম পুত্র ঈসা (আঃ) ও মাসীহিদ দাজ্জাল-এর বর্ণনা।
৩১৫-(২৭৪/…) মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক আল মুসাইয়্যাবী (রহঃ) ….. আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবাদের সম্মুখে দাজ্জালের কথা উল্লেখ করে বললেন, অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা টেরা চোখ বিশিষ্ট নন। জেনে রাখ দাজ্জালের ডান চোখ টেরা যেন ফোলা একটি আঙ্গুর। ইবনু উমার (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, একবার আমি স্বপ্নে আমাকে কা’বার কাছে পেলাম। গোধূম বর্ণের এক ব্যক্তিকে দেখলাম। এ বর্ণের তোমরা যত লোক দেখেছ তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। চুল তার কাঁধ পর্যন্ত বুলছিল। তার চুলগুলো ছিল সোজা। তা থেকে তখন পানি ঝরছিল। তিনি দু’ ব্যক্তির কাঁধে হাত রেখে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? বলা হল, ইনি মাসীহ ইবনু মারইয়াম। তারই পেছনে দেখলাম, আরেক ব্যক্তি, অধিক কোঁকড়ানো চুল। তার ডান চোখ ছিল টেরা। সে দেখতে ছিল ইবনু কাতান এর ন্যায়। সেও দু’ ব্যক্তির কাঁধে হাত রেখে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করছে। জিজ্ঞেস করলাম, এ কে? বলা হল, মাসীহুদ দাজ্জাল। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২৩, ইসলামিক সেন্টারঃ ৩৩৪)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
আল্লাহর হাত রয়েছে
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ পাকের হাত রয়েছে। নবী মুহাম্মদ অনেক জায়গাতেই আল্লাহর হাতের বর্ণনা দিয়েছেন।
সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩৫/ সুন্নাহ
পরিচ্ছেদঃ ২১. জাহমিয়্যাহ মতবাদ প্রত্যাখ্যাত
৪৭৩২। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ কিয়ামতের দিন আসমানসমূহকে গুটিয়ে তাঁর ডান হাতে নিয়ে বললেবন, আমি সর্বময় কর্তা ও মালিক, স্বৈরাচারীরা ও অহংকারকারীরা কোথায়? অতঃপর পৃথিবীসমূহকে গুটিয়ে অপর হাতে নিয়ে বলবেন, আমি মালিক স্বৈরাচারীরা ও অহংকারীরা কোথায়?[1]
সহীহ।
[1]. মুসলিম।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ)
সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
অধ্যায়ঃ ৪৪/ তাফসীরুল কুরআন
পাবলিশারঃ হুসাইন আল-মাদানী
পরিচ্ছদঃ ৬. সূরা আল-মায়িদাহ
৩০৪৫। আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দয়াময় আল্লাহ তা’আলার ডান হাত পূর্ণ। সর্বদা তা অনুগ্রহ ঢালছে। রাত দিনের অবিরাম দান তাতে কখনো কমতি ঘটাতে পারে না। তিনি আরো বলেন, তোমরা লক্ষ্য করেছ কি যেদিন থেকে তিনি আসমান-যামীন সৃষ্টি করেছেন সেদিন হতে কত না দান করে আসছেন, অথচ তার ডান হাতে যা আছে তাতে কিছুই কমতি হয়নি। (সৃষ্টির পূর্বে) তার আরশ ছিল পানির উপর। তার অপর হাতে রয়েছে মীযান (দাঁড়ি-পাল্লা)। তিনি তা নীচু করেন ও উত্তোলন করেন (সৃষ্টির রিযিক নির্ধারণ করেন)।
সহীহঃ ইবনু মা-জাহ (১৯৭)।
আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ। এ হাদীসটি হল নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যাস্বরূপঃ “ইয়াহুদীরা বলে, আল্লাহ তা’আলার হাত রুদ্ধ। ওরাই আসলে রুদ্ধহস্ত এবং ওরা যা বলে তজ্জন্য ওরা অভিশপ্ত। বরং আল্লাহ তা’আলার উভয় হাতই প্রসারিত, যেভাবে ইচ্ছা তিনি দান করেন”— (সূরা আল-মায়িদাহ ৬৪)।
ইমামগণ বলেন, এ হাদীস যেরূপে (আমাদের নিকট) এসেছে, কোনরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সন্দেহ-সংশয় ব্যতীতই তার উপর সেভাবেই ঈমান আনতে হবে। একাধিক ইমাম এ কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সুফইয়ান সাওরী, মালিক ইবনু আনাস, ইবনু উয়াইনাহ, ইবনুল মুবারাক (রাহঃ) প্রমুখ। তাদের মতে এরূপ বিষয় বর্ণনা করা যাবে, এগুলোর উপর ঈমান রাখতে হবে, কিন্তু তা কেমন এ কথা বলা যাবে না।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
শুধু হাতই নয়, হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত রয়েছে, যার বিবরণ পাওয়া যায়,
সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
অধ্যায়ঃ ৩০/ তাকদীর
পাবলিশারঃ হুসাইন আল-মাদানী
পরিচ্ছদঃ ৭. আল্লাহ তা’আলার দুই আঙ্গুলের মধ্যে সমস্ত অন্তর অবস্থিত
২১৪০। আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দু’আ অধিক পাঠ করতেনঃ হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত (দৃঢ়) রাখো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। আমরা ঈমান এনেছি আপনার উপর এবং আপনি যা নিয়ে এসেছেন তার উপর। আপনি আমাদের ব্যাপারে কি কোনরকম আশংকা করেন? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, কেননা, আল্লাহ তা’আলার আঙ্গুলসমূহের মধ্যকার দুটি আঙ্গুলের মাঝে সমস্ত অন্তরই অবস্থিত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা তা পরিবর্তন করেন।
সহীহ, ইবনু মা-জাহ (৩৮৩৪)।
আবূ ঈসা বলেন, নাওয়াস ইবনু সাম্আন, উন্মু সালামা, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ও আইশা (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। এ হাদীসটি হাসান। আমাশ-আবৃ সুফিয়ান হতে, তিনি আনাস (রাঃ)-এর সূত্রে একাধিক বর্ণনাকারী একইরকম হাদীস বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ আমাশ-আবৃ সুফিয়ান হতে, তিনি জাবির (রাঃ) হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। আনাস (রাঃ)-এর সূত্রে আবূ সুফিয়ানের বর্ণিত হাদীসটি অনেক বেশি সহীহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
আল্লাহর পা রয়েছে
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ পাকের পা রয়েছে। কেয়ামতের বিচারের পরে আল্লাহ নাকি তার পা দিয়ে জাহান্নামে চেয়ে চেয়ে পাপী বান্দাদের ভর্তি করবেন
সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৮৬/ জাহ্মিয়াদের মতের খণ্ডন ও তাওহীদ প্রসঙ্গ
পরিচ্ছদঃ ৩১২৭. আল্লাহ্র বাণীঃ আল্লাহ্র অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়নদের নিকটবর্তী (৭ঃ ৫৬)
৬৯৪১। উবায়দুল্লাহ ইবনু সা’দ ইবনু ইবরাহিম (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়টি স্বীয় প্রতিপালকের কাছে অভিযোগ করল। জান্নাত বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমার ব্যাপারটি কি হলো যে তাতে শুধু নিঃস্ব ও নিম্ন শ্রেনীর লোকেরাই প্রবেশ করবে। এদিকে জাহান্নামও অভিযোগ করল অর্থাৎ আপনি শুধুমাত্র অহংকারীদেরকেই আমাতে প্রাধান্য দিলেন। আল্লাহ জান্নাতকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তুমি আমার রহমত। জাহান্নামকে বললেনঃ তুমি আমার আযাব। আমি যাকে চাইব, তোমাকে দিয়ে শাস্তি পৌছাব। তোমাদের উভয়কেই পূর্ণ করা হবে। তবে আল্লাহ তা’আলা তার সৃষ্টির কারো উপর যুলম করবেন না। তিনি জাহান্নামের জন্য নিজ ইচ্ছানুযায়ী নতুন সৃষ্টি পয়দা করবেন। তাদেরকে যখন জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তখন জাহান্নাম বলবে, আরো অভিরিক্ত আছে কি? জাহান্নামে আরো নিক্ষেপ করা হবে, তখনো বলবে, আরো অতিরিক্ত আছে কি? এভাবে তিনবার বলবে। পরিশেষে আল্লাহ তাআলা তাঁর কদম (পা) জাহান্নামে প্রবেশ করিয়ে দিলে তা পরিপূর্ন হয়ে যাবে। তখন জাহান্নামের একটি অংশ আরেকটি অংশকে এই উত্তর করবে যথেষ্ট হয়েছে যথেষ্ট হয়েছে ষথেষ্ট হয়েছে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
এগুলো সরাসরি মানবীয় আচরণ, অভিব্যক্তি ও শারীরিকতা বোঝায়। প্রাথমিক যুগের প্রায় সকল সাহাবি ও তাবিয়ীন প্রায় সকলেই এগুলো আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করেছেন। বর্তমানেও অনেক ইসলামিক স্কলারই এগুলো আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করেন, বিশেষ করে আহলুল হাদিস ধারার অনুসারীরা।
বর্তমান সময়ের আহলে হাদিস ও সালাফীদের বক্তব্য
আসুন বাংলাদেশের বিখ্যাত একজন আলেম ড. মনজুর ইলাহির বক্তব্য শুনে নিই,
এবারে আসুন মুফতি ইব্রাহিমের একটি বক্তব্য শুনে নিই,
আসুন আরও কিছু বক্তব্য শুনি,
দার্শনিক চ্যালেঞ্জ: গ্রিক যুক্তিবাদ ও ইসলামী চিন্তায় মিথস্ক্রিয়া
গ্রিক দর্শনের অনুবাদ ও প্রভাব
৮ম ও ৯ম শতকে আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন কর্তৃক “Bayt al-Hikmah” (জ্ঞানালয়) প্রতিষ্ঠার পর অ্যারিস্টটল, প্লেটো, ইউক্লিড, গ্যালেন প্রমুখ গ্রিক চিন্তাবিদের কাজ আরবি ভাষায় অনূদিত হয়। এর ফলে ইসলামি দুনিয়ায় একটি যুক্তিবাদী আন্দোলন শুরু হয়, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দর্শনের আলোকে ধর্মীয় পাঠ পুনর্বিচার। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে শুরু হয়ে যায় নানা ধরণের রাজনৈতিক সংঘাত এবং দমন পীড়ন। অনেক খলিফা সেই সময়ে দর্শনের অনুরাগী হয়ে বিরুদ্ধ মতের আলেমদের নির্যাতন শুরু করেন, আবার অনেক খলিফা সালাফদের অনুসরণ করতে গিয়ে দর্শনের প্রভাবে প্রভাবিত আলেমদের নির্যাতন শুরু করেন।
দার্শনিক সমস্যাবলী
শারীরিক ঈশ্বরের ধারণা দার্শনিকভাবে একাধিক মৌলিক আপত্তির মুখোমুখি হয়, যা শুধু ধর্মীয় ব্যাখ্যা নয়, যুক্তিবাদ ও পরিভাষাগত সংগতির দিক থেকেও তা গভীর সংকট তৈরি করে। এই আপত্তিগুলো মূলত তিনটি অন্তর্নিহিত তত্ত্বগত সমস্যায় কেন্দ্রীভূত:
স্থানিকতা ও সীমাবদ্ধতা (Spatiality and Limitation)
শরীর বলতে সাধারণত এমন এক সত্তাকে বোঝায় যার কোনো অবস্থান (location) এবং সীমানা (boundary) আছে। একটি সত্তা যখন কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে, তখন সে স্থানবিশেষে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং অন্যান্য স্থানে অনুপস্থিত থাকে। কিন্তু ঈশ্বর, বিশেষ করে ইসলামি ধর্মতত্ত্বে যাঁকে বলা হয় “সর্বব্যাপী (al-Wāsi‘)” এবং “সর্বজ্ঞ (al-‘Alīm)”, তিনি যদি একটি নির্দিষ্ট স্থানেই অবস্থান করেন (যেমন—আরশে বসা), তাহলে সেই সর্বব্যাপীতার ধারণার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ তার স্থান নির্ধারণ করাই তার গুণাবলীর বিরুদ্ধে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে যায়।
তদুপরি, স্থানিক সত্তা “বহির্জগতের নিয়ম” দ্বারা আবদ্ধ হয়, যেমন দূরত্ব, গমনাগমন, দিকনির্দেশনা ইত্যাদি। ঈশ্বর যদি সত্যিই সর্বশক্তিমান ও চিরন্তন হন, তবে তাঁকে স্থান-কালগত সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে হবে। আর সেই মুক্তি সম্ভব নয় যদি ঈশ্বরকে শারীরিক সত্তা হিসেবে কল্পনা করা হয়। যেমন ধরুন, এই হাদিসটি এই ক্ষেত্রে মস্তবড় সমস্যা সৃষ্টি করে [6] [7] [8] [9] [10] –
সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১৯/ তাহাজ্জুদ বা রাতের সালাত
পরিচ্ছেদঃ ৭২৮. রাতের শেষভাগে দু’আ করা ও সালাত আদায় করা। আল্লাহ্পাক ইরশাদ করেছেনঃ রাতের সামান্য পরিমাণ (সময়) তাঁরা নিদ্রারত থাকেন, শেষ রাতে তাঁরা েইসতিগ্ফর করেন। (সূরা আয্-যারিয়াতঃ ১৮)।
১০৭৯। আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামা (রহঃ) … আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহামহিম আল্লাহ্ তা’আলা প্রতি রাতে রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেনঃ কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছ এমন যে, আমার কাছে চাইবে? আমি তাকে তা দিব। কে আছ এমনে, আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
আল-লুলু ওয়াল মারজান
৬/ মুসাফির ব্যক্তির সালাত ও তা ক্বসর করার বর্ণনা
পরিচ্ছেদঃ ৬/২৪. শেষ রাতে দুআ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান এবং সে সময় কবূল হওয়া।
৪৩৪. আবূ হুরায়রাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহামহিম আল্লাহ্ তা‘আলা প্রতি রাতে রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেনঃ কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি ডাকে সাড়া দিব। কে আছে এমন যে, আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা দিব। কে আছে এমন আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।
সহীহুল বুখারী, পৰ্ব ১৯ ; তাহাজ্জুদ, অধ্যায় ১৪, হাঃ ১১৪৫; মুসলিম, পর্ব ৬; মুসাফির ব্যক্তির সালাত ও তা কসর করার বর্ণনা, অধ্যায় ২৩, হাঃ ৭৫৮
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২/ সালাত (নামায)
পরিচ্ছেদঃ প্রত্যেক রাতেই আল্লাহ্ তা’আলা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন।
৪৪৬. কুতায়বা (রহঃ) …. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ রাতের প্রথম এক-তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হলে প্রত্যেক রাতেই আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেনঃ আমিই রাজধিরাক, যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাককে কবূল করি, যে আমার কাছে যাঞ্ছা করে আমি তাকে দেই, যে আমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে আমি তাকে ক্ষমা করে দেই। ফজরের আলো উদ্ভাসিত না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে। – ইবনু মাজাহ ১৩৬৬, বুখারি ও মুসলিম, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ৪৪৬ (আল মাদানী প্রকাশনী)
এই বিষয়ে আলী ইবনু আবূ তালিব, আবূ সাঈদ, রিফাআ আল-জুহানী, জুবায়র ইবনু মুতঈম, ইবনু মাসঊদ, আবূদ্ দারদা এবং উসমান ইবনু আবিল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও হাদীস বর্ণিত আছে। ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী (রহঃ) বলেনঃ আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসটি হাসান-সহীহ। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বহু সূত্রে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ রাতের শেষ তৃতীয়াংশ যখন অবশিষ্ট থাকে, তখন আল্লাহ তা’আলা নেমে আসেন এই রিওয়ায়াতটই সবচেয়ে সহীহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-৪ঃ সালাত
পরিচ্ছেদঃ ৩৩. প্রথম অনুচ্ছেদ – ক্বিয়ামুল লায়ল-এর প্রতি উৎসাহ দান
১২২৩-(৫) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বারাকাতপূর্ণ রব দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব।’ (বুখারী, মুসলিম)(1)
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, তারপর তিনি হাত বাড়িয়ে দেন এবং বলেন, কে আছে যে এমন লোককে করয দেবে যিনি ফকীর নন, না অত্যাচারী এবং সকাল পর্যন্ত এ কথা বলতে থাকেন।
(1) সহীহ : বুখারী ১১৪৫, মুসলিম ৭৫৮।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
আল-আদাবুল মুফরাদ
মেহমানদারি
পরিচ্ছেদঃ ৩২০- রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দোয়া করা।
৭৫৮। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমাদের বরকতময় মহামহিম প্রভু রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকতে প্রতি রাতে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেনঃ কে আছে যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিবো? (কে আছে এমন, যে আমার কাছে দোয়া করবে এবং আমি তার দোয়া কবুল করবো)? কে আছে এমন, যে আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করবে এবং আমি তা দান করবো? কে আছে এমন, যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে এবং আমি তাকে ক্ষমা করবো। -(বুখারী, মুসলিম, দারিমী)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
এইসব হাদিস সম্পর্কে দার্শনিক ও যৌক্তিক প্রশ্ন ওঠে—আল্লাহর কি বান্দাদের প্রার্থনা শোনার জন্য এত নিকটবর্তী হতে হবে? ইসলাম ধর্মে আল্লাহ সর্বশ্রোতা (আস-সামি) এবং সর্বজ্ঞানী (আল-আলিম) হিসেবে বর্ণিত। তাহলে কেন তাকে বান্দাদের প্রার্থনা আরেকটু ভালভাবে শুনতে নিকটবর্তী হতে হবে? ইসলামি বিশ্বাসমতে, আল্লাহর কাছে সময় ও স্থান কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। এমনকি তিনি বান্দার হৃদয়ের সবচেয়ে গোপন কথাও জানতে সক্ষম। তাহলে কেন তাকে প্রতি রাতে নির্দিষ্ট সময়ে নিকটবর্তী আসমানে নামতে হবে? এমন ধারণা আল্লাহর ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতি একধরনের ঠাট্টা, যা তাকে মানবীয় সত্তার বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করার শামিল। এটি কেবল ঈশ্বরের মহত্ত্ব এবং সর্বশক্তিমান সত্তাকে সীমাবদ্ধ করে তোলে। একইসাথে, আল্লাহ যখন নেমে আসেন তখন আরশ কি ফাঁকা থাকে? একইসাথে, পৃথিবী তো গোলাকার এবং ঘুর্ণনশীল, তাই প্রতিটি মূহুর্তেই কোথাও না কোথাও রাত হচ্ছে। তাহলে আল্লাহর তো আর ফিরে যাওয়ার উপায় থাকে না। আসুন মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল-উসাইমিন এর বিখ্যাত ফতোয়া গ্রন্থে ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম গ্রন্থ থেকে পড়ি, [11]


এবারে আসুন এই হাদিসটি সম্পর্কে শুরুতেই বিশিষ্ট আলেম মতিউর রহমান মাদানি, আহমদুল্লাহ এবং মঞ্জুরে ইলাহীর বক্তব্য শুনে নিই,
বদলশীলতা ও পরিবর্তনশীলতা (Mutability and Change)
হাঁটা, বসা, দাঁড়ানো, হাসা, ক্রুদ্ধ হওয়া—এইসব কাজের মধ্য দিয়ে একটি সত্তা সময়ের সাথে নিজের অবস্থা (state) বা বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি পরিবর্তন করে। কিন্তু দর্শনের পরিভাষায় ঈশ্বরকে চিরন্তন (eternal), অপরিবর্তনীয় (immutable) ও স্বসিদ্ধ (self-sufficient) হিসেবে কল্পনা করা হয়। প্লেটো ও অ্যারিস্টটল উভয়েই যুক্তি দিয়েছিলেন, যদি ঈশ্বর বদলায়, তবে সে তার পূর্বাবস্থায় অসম্পূর্ণ ছিল বা পরবর্তীকালে পূর্ণতা পেল—যা ঈশ্বরের চিরন্তন ও পরিপূর্ণ সত্তার ধারণার পরিপন্থী [12] [13]।
কারণ কোনো কিছু যখন পরিবর্তিত হয়, তখন সেটি একটি অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যায়—যেমন দাঁড়ানো থেকে বসা, নিরবতা থেকে কথা বলা, বা রাগহীন অবস্থা থেকে রাগান্বিত হওয়া। কিন্তু যদি ঈশ্বর নিজেই পরিবর্তিত হন, তবে ধরে নিতে হয়, পরিবর্তনের আগে তিনি কোন না কোনভাবে অসম্পূর্ণ ছিলেন, এবং পরিবর্তনের পরে যেন নতুন বা ভালো কিছু অর্জন করলেন। এই ধারণা সরাসরি পরিপূর্ণ ও চিরন্তন ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, আল্লাহ পাক রাতের শেষ ভাগে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে নেমে এসে বান্দার প্রার্থনা শোনেন। অথচ তার নেমে আসার প্রয়োজন নেই, তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বেই ভবিষ্যতের সবকিছু জানেন। কবে কোন বনাদা রাতের কোন সময়ে কী প্রার্থনা করবে, সবি তার পুণখানুপুঙ্খ্যভাবে অবগত থাকার কথা। নেমে আসার অর্থই হচ্ছে, তিনি নেমে আসার মাধ্যমে কিছু নতুন তথ্য জানতে পারছেন, যা তিনি আগে জানতেন না। আগেই তার জানা থাকলে, নেমে আসাটি সম্পূর্ণ অর্থহীন একটি কাজে পরিণত হয়।
আবার উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক—কেউ যদি বলে, “ঈশ্বর রেগে যান,” তাহলে মানতে হয়, রাগান্বিত হওয়ার আগ মুহূর্তে ঈশ্বর রাগান্বিত ছিলেন না। নতুন একটি তথ্য তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যা তিনি আগে জানতেন না। সুতরাং, তাঁর মানসিক অবস্থা বা গুণাবলি বদলেছে। এই পরিবর্তন বুঝিয়ে দেয় যে ঈশ্বর সময়ের অধীন, কারণ পরিবর্তন ঘটার জন্য সময়ের ধারা প্রয়োজন। অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গিতে, চূড়ান্ত সত্তা বা ঈশ্বর কখনোই এমন হতে পারেন না যে তিনি নতুন করে কিছু অর্জন করেন বা কোনো আবেগে আবদ্ধ হন। প্রকৃত ঈশ্বর হতে হলে তাঁকে হতে হবে এমন এক সত্তা, যিনি চিরকাল একইরকম, কোন ধরণের পরিবর্তনহীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ, এবং যাঁর মধ্যে কোনো “হয়ে ওঠার” (becoming) প্রক্রিয়া নেই—শুধুই “যা আছেন” (being)। ইসলামি দার্শনিক ইবনে সিনা তার Al-Shifa গ্রন্থে লিখেছেন:
“পরিবর্তন এমন কিছুর লক্ষণ যা সম্ভাব্য (mumkin al-wujūd); কিন্তু ঈশ্বর হলো আবশ্যিক অস্তিত্ব (wājib al-wujūd), তাই তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনাও থাকতে পারে না।”
সুতরাং, আল্লাহ যদি হাঁটেন, কথা বলেন, বসেন, স্থান পরিবর্তন করেন—তবে তিনি স্থান ও সময়ের অধীন ও পরিবর্তনশীল, যা ঈশ্বরতত্ত্বে এক গুরুতর আপত্তি।
অঙ্গ ও বিভাজন (Parts and Divisibility)
একটি শরীর স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা গঠিত—হাত, পা, চোখ ইত্যাদি। এই অংশগুলোকে একত্রে মিলিয়ে একটি পূর্ণ সত্তা গঠন হয়। কিন্তু ঈশ্বর যদি শারীরিক অঙ্গবিশিষ্ট হন, তবে তিনি একটি বিভাজ্য সত্তা। আর বিভাজ্যতা মানেই ঈশ্বরের মধ্যে অবিভাজ্য ঐক্য (Divine Simplicity) নেই—যা প্রায় সব ধর্মতত্ত্বেই ঈশ্বরের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত হয়। আবার, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমাদের এইদিকেই নিয়ে যায়, তার শরীর কোন উপাদান দিয়ে গঠিত। সেই উপাদানগুলো যাই হোক না কেন, সেগুলো কথা থেকে আসলো, তার প্রশ্ন তৈরি করে দেয়। এবং আল্লাহকে সেই উপাদানের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। এখানে অ্যাকুইনাসের যুক্তিও প্রাসঙ্গিক:
“যা বিভাজ্য, তা অবিনশ্বর হতে পারে না; কারণ অংশ বিনষ্ট হলে সত্তাও বিনষ্ট হয়। ঈশ্বর যদি অংশবিশিষ্ট হন, তবে তিনি বিনশ্বর হওয়ার সম্ভাবনা রাখেন, যা ঈশ্বরসত্তার ধারণার বিপরীত।”
আল্লাহ যদি দুটি হাত, একটি মুখ বা একাধিক দিকসম্পন্ন হন, তবে ঈশ্বরের তাওহীদ (tawḥīd) এর ধারণা, তার যৌক্তিক ভিত্তিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
পরবর্তী সময়ে ব্যাখ্যার বিবর্তন
এইসব দার্শনিক সংকটের ফলেই পরবর্তীকালে মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে আল্লাহর শারীরিক রূপ নিয়ে সংকোচ দেখা দেয় এবং তাঁরা সেই চিত্রকে রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন। কেউ কেউ বলেন, “আল্লাহর হাত মানে তাঁর ক্ষমতা,” কিংবা “আল্লাহর পা মানে তাঁর কর্তৃত্ব।” আবার অনেকেই বলেন, “কীভাবে তা ঘটে আমরা জানি না, তবে আমরা বিশ্বাস করি।” কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে এই সংকটের গভীরতা থেকেই বোঝা যায় যে শারীরিক আল্লাহর ধারণা ইসলামি দার্শনিক ঐতিহ্যে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আল্লাহ হয়ে ওঠেন নিরাকার, বিমূর্ত, যুক্তিনির্ভর এক সত্তা, যাঁকে আরশে বসিয়ে কল্পনা করা যায় না, বরং যিনি সকল কালের, সকল স্থানের অতীত এক পরম বুদ্ধি।
আল্লাহর বিমূর্তিকরণ ও কালামবিদদের পুনঃব্যাখ্যা
মু’তাজিলা ও র্যাশনালিজম
মু‘তাজিলা ছিল ইসলামি ইতিহাসের প্রথম দার্শনিক ও যুক্তিনির্ভর ধর্মতাত্ত্বিক আন্দোলন, যারা ঈশ্বরতত্ত্বে যুক্তি ও ন্যায়বিচারকে সর্বোচ্চ মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। ৮ম শতকে গঠিত এই আন্দোলনের মূল বিশ্বাস ছিল, ঈশ্বর কখনো অবিচার করতে পারেন না, এবং তিনি এমন কিছু বলেন না যা মানবীয় যুক্তির পরিপন্থী। এই দর্শন থেকেই তারা কোরআনের Anthropomorphic (মানবসদৃশ) আয়াতসমূহ—যেমন আল্লাহর হাত, পা, মুখ, চোখ, বসা, হাঁটা, রাগ ইত্যাদি—আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে রূপক ব্যাখ্যার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। তারা বলেন, “আল্লাহর হাত মানে তাঁর শক্তি বা কর্তৃত্ব (qudra),” এবং “চোখ মানে তাঁর সর্বজ্ঞতা বা সর্বদর্শিতা (basar)।” এই ধারা ইসলামী ধর্মতত্ত্বে ‘তাওয়িল’ নামে পরিচিত, যার উদ্দেশ্য ছিল ঈশ্বরকে মানবীয় সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত রাখা [14] [15]।
মু‘তাজিলাদের প্রধান চিন্তাবিদরা—যেমন ওয়াসিল ইবন আতা (মৃত্যু 748), আমর ইবন উবাইদ, ও পরবর্তীতে আবু আল-হুযায়েল আল-আল্লাফ, আল-জাহিয ও আল-নজ্জাম—বিশ্বাস করতেন, যদি কোরআনের কোনও বক্তব্য ঈশ্বরকে মানবীয় গুণে সাজিয়ে তোলে, তবে সেটিকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া উচিত নয়, বরং রূপক অর্থে গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, তারা সূরা ফাতহ (৪৮:১০)-এর আয়াত—“আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপরে”—ব্যাখ্যা করেন এইভাবে যে, এটি আল্লাহর সমর্থন বা ইচ্ছাশক্তির প্রতীক। তারা যুক্তি দেন, যদি আল্লাহর বাস্তবিক অর্থে হাত-পা থাকে, তবে তিনি স্থান-কালগত, সীমাবদ্ধ ও মানবসদৃশ সত্তা হয়ে দাঁড়ান, যা একটি চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মু‘তাজিলা তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন (খিলাফতকাল: ৮১৩–৮৩৩) “মিহনা” নামক একটি ধর্মীয় ইনকুইজিশন শুরু করেন, যেখানে কোরআনকে ‘সৃষ্ট’ (created) হিসেবে মানতে মুসলিম আলেমদের বাধ্য করা হয় [16] [17]। কারণ, যদি কোরআন অনাদি ও চিরন্তন হয়, তবে তা আল্লাহর সঙ্গেই শাশ্বত ও চিরন্তন হয়ে পড়ে এবং এটি একধরনের বহুঈশ্বরবাদে রূপ নেয়। মু‘তাজিলারা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে যুক্তিবাদী ঈশ্বরতত্ত্বের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করেন, কারণ তাদের মতে, ঈশ্বরের বাণীও ঈশ্বরের মতো চিরন্তন হলে, তাতে যুক্তিগত বিপর্যয় ঘটে।
আরও একটি বড় ধরণের দার্শনিক বিপর্যয় দেখা দেয়। কোরআন আল্লাহর সৃষ্টি হয়ে থাকলে, সেটি অনাদি অনন্ত হতে পারে না। আর কোরআন আল্লাহর গুণ বা সিফাত হয়ে থাকলে, মানুষকে সৃষ্টি করাই আল্লাহর অস্তিত্বের উদ্দেশ্যে পরিণত হয়। মানুষকে সৃষ্টি করা ছাড়া আল্লাহর আর কোন উপায় ছিল না, সেটিই প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে এই যুক্তিবাদী ও রূপক ব্যাখ্যাধর্মী চিন্তাধারা সময়ের প্রবাহে প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে। হানাবিলা ও পরবর্তীকালে ইবনে তাইমিয়া-প্রভাবিত আহলুল হাদিস গোষ্ঠী মু‘তাজিলাদের ‘তাওয়িল’ প্রক্রিয়াকে ধর্মদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করে। তারা কোরআন ও হাদিসে আল্লাহর হাত-পা, বসা বা হাঁটার মতো বিবরণকে “যেভাবে আছে সেভাবে” (bilā kayf, অর্থাৎ ‘কীভাবে তা ঘটে আমরা জানি না’) বলে গ্রহণ করে—আক্ষরিকতা বজায় রেখে, কিন্তু anthropomorphism-এর দায় স্বীকার না করে।
মু‘তাজিলা আন্দোলনের এই যুক্তিবাদী চেতনা পরবর্তীকালে ইসলামি কালামতত্ত্বের একটি ধারা গড়ে তোলে এবং দর্শনের আলোকে ধর্মীয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করে। যদিও রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়ার কারণে এই আন্দোলন ইসলামী মূলধারায় স্থায়ী স্থান পায়নি, তবুও তাদের চিন্তাধারা ইসলামি ধর্মতত্ত্বে ঈশ্বরের বিমূর্তীকরণের পথে এক মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করে গেছে। তাদের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো মুসলিম জগতে ঈশ্বর ও ধর্মীয় পাঠের র্যাশনাল ক্রিটিক প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তী দার্শনিকদের জন্য পথ খুলে দেয়। মু‘তাজিলা আন্দোলন ব্যর্থ হলেও সেটি যে একেবারেই ব্যর্থ তা বলা যায় না। বর্তমান সময়েও মু‘তাজিলাদের এই দার্শনিক মতবাদ মুসলিমদের মনে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে যে, পৃথিবীর যেকোন সাধারণ মুসলিমকে জিজ্ঞেস করলে তারা মু‘তাজিলা দার্শনিকদের আল্লাহর ধারনাকেই বলবে, সালাফদের আল্লাহর কথা বেশিরভাগ মুসলিমদের জানাই নেই।
আশআরী ও মাতুরিদি মতবাদ
আশআরি মতবাদ, যেটি আবু আল-হাসান আল-আশআরি (মৃত্যু: ৯৩৬ খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, ইসলামি ধর্মতত্ত্বে একটি মধ্যপন্থী অবস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। মু‘তাজিলাদের যুক্তিনির্ভর, দার্শনিক ও রূপক ব্যাখ্যাকে যেমন তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেন, তেমনি হানাবিলা ও আহলুল হাদিসদের আক্ষরিকতা নির্ভর anthropomorphism-কেও তাঁরা অগ্রহণযোগ্য মনে করেন। আল-আশআরির বিখ্যাত উক্তি, “نُؤْمِنُ بِهِ بِلَا كَيْف” — অর্থাৎ, “আমরা ঈশ্বরের এসব গুণাবলীতে বিশ্বাস করি, কিন্তু কীভাবে তা ঘটে তা জানি না”—এই বক্তব্যটি আশআরিদের ঈশ্বরতত্ত্বের কেন্দ্রীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে [18] [19]।
এই পদ্ধতিতে, তারা ঈশ্বর সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে উল্লেখিত সমস্ত শারীরিক শব্দকে দার্শনিক জটিলতা এড়াতে (যেমন—হাত, মুখ, আরশে বসা, ইত্যাদি) ব্যাখ্যাহীন হিসেবে উপস্থাপন করেন। তারা এসবের ব্যাখ্যাতে বলেন, এসব সম্পর্কে মানুষের কোন জ্ঞান নেই, তাই এগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান বা চিন্তা করা নিষিদ্ধ। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, এসব শব্দ আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে ঈশ্বর মানবসদৃশ হয়ে পড়েন, যা তাওহিদের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আবার সম্পূর্ণ রূপক ব্যাখ্যা দিলে কোরআনের ভাষা নিজের অর্থ হারিয়ে ফেলে। এই দ্বৈত সংকট মোকাবিলায় তাঁরা একটি সমঝোতামূলক ব্যাখ্যার পথ খুঁজে নেন—আল্লাহর হাতের মতো কিছু আছে, তবে তা কেমন বা কোন প্রকৃতির, তা মানুষ জানে না, এবং জানার প্রয়োজনও নেই।
আশআরিরা ঈশ্বরতত্ত্বে একধরনের তানজিহ (transcendence)-এর ধারণা বজায় রাখেন, যেখানে আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকার না করেই তাঁকে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে স্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে তারা একদিকে ঐতিহ্যগত গ্রন্থবিশ্বাসকে সম্মান দেখান, অন্যদিকে দার্শনিক ও যুক্তিবাদী সমালোচনার মুখেও ঈশ্বরকে anthropomorphic রূপ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেন। ফলে, আশআরিবাদ একটি ধারণাগত ভারসাম্য তৈরি করে—যেখানে ঈশ্বর শরীরবর্জিত, কিন্তু শরীরগত শব্দ ব্যবহার করেও তাঁকে প্রস্তাব করা যায়, যদিও তা কীভাবে সম্ভব, যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে তা বিচার বিবেচনা করাকে গর্হিত কাজ বলে গণ্য করা হয়। এই ধারার অনুসারীরা তাই পরবর্তী সময়ে দর্শনকেই মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, এবং যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে ধর্মকে বিশ্লেষণকে বিদআত হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাদের শাস্তি প্রদান করতে বলেন।
আসুন বাঙলাদেশের বর্তমান সময়ের অন্যতম আলেম ড. আবু বকর মুহাম্মদ যাকারিয়া সাহেবের একটি আলোচনা শুনি, যেখানে উনি মুসলমানদের যুক্তিবিদ্যা বা দর্শন পড়া উচিত নাকি অনুচিত সেই বিষয়ে আলোচনা করছেন,
এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব পরবর্তীতে ইসলামি মূলধারার কালামতত্ত্ব, বিশেষত সুন্নি ঐতিহ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এটি মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী ঈশ্বরতাত্ত্বিক অবস্থান হিসেবে গৃহীত হয়। তবে আধুনিক দর্শনের বিচারে এটি অনেকাংশেই একধরনের “থিওলজিক্যাল সাসপেনশন”—যেখানে যুক্তির মুখে ব্যাখ্যাকে স্থগিত রেখে বিশ্বাসকে যুক্তি ছাড়াই ধরে রাখাকে ধর্মতত্ত্বের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
শারহুল আক্বীদা আত-ত্বহাবীয়া অত্যন্ত বিখ্যাত একটি আকীদা গ্রন্থ, যার লেখক ইমাম ইবনে আবীল ইয আল-হানাফী। তিনি তার বইতে এই বিষয়ে ইসলামের আকীদা কী, সালাফগণ এই বিষয়ে কী বলেছেন, সেটিও দেখে নিই [20] –
ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহ তার অন্যতম মূল্যবান কিতাব … -এ বলেন, প্রশ্ন হলো মানতেক ও তর্কশাস্ত্র কি জ্যোতিষ শাস্ত্রের মত নিন্দনীয়? না কি এটি মুবাহ?
এর জবাবে আমি বলবো, মানুষেরা এ বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে চরম বাড়াবাড়ি ও সীমা লংঘন করেছে। কেউ কেউ বলেছেন, ইলমুল কালাম ও তর্কশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা বিদআত ও হারাম। শির্ক ছাড়া অন্যান্য সকল প্রকার পাপাচার নিয়ে আল্লাহর কাছে হাযির হওয়া ইলমে কালাম নিয়ে তার নিকট হাযির হওয়ার চেয়ে উত্তম। আবার কেউ কেউ বলেছেন, মানতেক, ইলমে কালাম ও তর্ক শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা ফরয। কেউ বলেছেন, ফরযে কেফায়া আবার কেউ বলেছেন, ফরযে আইন। শুধু তাই নয়; তারা আরো বলেছেন, এটি সর্বোত্তম আমল এবং সর্বোচ্চ আনুগত্য। এর মাধ্যত্রে তাওহীদের জ্ঞান পুর্ণরূপে অর্জিত হয় এবং এটিই আল্লাহর দীনের পথে সংগ্রামের অন্তর্ভূক্ত। ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, কেউ কেউ বলেছেন, ইলমে মানতেক ও তর্কশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্পূর্ণ নিষেধ। এটিই ইমাম শাফেঈ, আহমাদ বিন হাম্বাল, সুফিয়ান সাওরী এবং সালাফদের মুহাদ্দিছদের মত। তাদের মতামতকে ইমাম গাজ্জালী স্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, সালাফদের সকল মুহাদ্দিছের ঐকমত্যে এটি হারাম। তাদের থেকে এ বিষয়ে যত উক্তি এসেছে তা উপরোক্ত কথার মধ্যেই সীমিত নয়।
আলেমগণ বলেছেন, ছাহাবীগণ ইলমে কালাম, মানতেক ও তর্কশাস্ত্র সম্পর্কে চুপ থাকার কারণ হলো, তারা তাওহীদের হাকীকত সম্পর্কে ভালো করেই জানতেন এবং অন্যদের তুলনায় ইলমে কালামের পরিভাষা ও শব্দ চয়ন সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞানী ছিলেন। এ জন্যই তাদের থেকে দীনের ক্ষেত্রে কোনো বিদআত ও ক্ষতিকর জিনিস বের হয়নি। নাবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, هَلَكَ الْمُتَنَطِعُونَ قَالَهَا ثَلَاثًا
যারা দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে, তারা ধ্বংস হোক। কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন।১৯২ অর্থাৎ দীনের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানার সময় বেশী বেশী ঘাটাঘাটি করা ও গভীরে প্রবেশ করা ঠিক নয়। ইলমে কালাম ও তর্কশাস্ত্র যদি দীনের অন্তর্ভুক্ত হতো, তাহলে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে সর্বাগ্রে আদেশ দিতেন এবং কালাম শাস্ত্রবিদদের প্রশংসা করতেন। অতঃপর ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহ আরো অনেক দলীল-
—————-
হাজারের নেছাবসমূহ হতে একটি নেছাব তাহার মার জন্য বখশাইয়া দিলাম। আমি আমার অন্তরে তা গোপন রাখছিলাম। কিন্তু ঐ যুবক তৎক্ষনাৎ বলতে লাগল চাচা! আমার মা দোযখের আগুন হতে রক্ষা পেয়েছে। কুরতুবী (রহি) বলেন: এ ঘটনা হতে আমার দু’টি ফায়দা হল। এক. সত্তর হাজার বার কালেমা তাইয়্যেবা পড়ার বরকত সম্পর্কে যাহা আমি শুনেছি তার অভিজ্ঞতা। দুই যুবকটির সত্যতার (তার কাশফ হওয়ার) একীন হইয়া গেল । দেখুন: ফাযায়েলে আমাল, ১ম খণ্ড, ১৩৫ পৃষ্ঠা, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর-২০০১ ইং। দারুল কিতাব, ৫০ বাংলা বাজার ঢাকা-১১০০ থেকে প্রকাশিত)
১৯২. ছহীহ মুসলিম ২৬৭০, মুসনাদে ইবনে আবী শাইবা।

আল ফিকহুল আকবর একটি আদি ইসলামি আকিদা বিষয়ক গ্রন্থ। ইমাম আবু হানিফার লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে অক্ষত রয়ে যাওয়া এটি অন্যতম একটি গ্রন্থ। আসুন, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেবের অনুদিত এই বইটি থেকে দর্শন বিষয়ক অধ্যায়টি পড়ি [21] –





দার্শনিক আল্লাহর রূপায়ণ: ইবনে সিনা থেকে ইবনে রুশদ
ইসলামী চিন্তাধারায় আল্লাহর বিমূর্ত ও দার্শনিক রূপায়ণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ইবনে সিনা (Avicenna) ও ইবনে রুশদ (Averroes)। তারা ধর্মীয় বিশ্বাসকে গ্রিক যুক্তিবাদের কাঠামোতে স্থাপন করে ঈশ্বরকে এমন এক সত্তায় রূপ দেন যিনি আর কোনোভাবে শারীরিক বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে যুক্ত নন। এই রূপে ঈশ্বর একটি দার্শনিক ন্যায়বোধ, একটি অনিবার্য সত্য, এক ধরনের অস্তিত্বগত প্রয়োজনীয়তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ইবনে সিনা ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করেন “আবশ্যিক অস্তিত্ব” (wājib al-wujūd) হিসেবে—অর্থাৎ এমন একটি সত্তা যাঁর অস্তিত্ব অন্য কিছু দ্বারা নির্ধারিত নয়, বরং যাঁর অস্তিত্ব নিজেই তাঁর প্রকৃতি। তাঁর দৃষ্টিতে ঈশ্বর স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে, যাঁর চিন্তা ও অস্তিত্ব একইসঙ্গে ঘটে। এই ঈশ্বর নিজে চিন্তা করেন, আর সেই চিন্তার মাধ্যমেই সমস্ত সৃষ্টির সূত্রপাত ঘটে—তবে এটি কোনো ইচ্ছাপ্রসূত সৃষ্টিকর্ম নয়, বরং যৌক্তিক অনিবার্যতায় সৃষ্ট। ইবনে সিনার ঈশ্বর মানবীয় নয়, ইচ্ছাশীল নয়, বরং পরম যুক্তির এক বিমূর্ত রূপ।
অন্যদিকে, ইবনে রুশদ ছিলেন যুক্তির আরো একচেটিয়া পৃষ্ঠপোষক। তিনি বলেন, ঈশ্বর হচ্ছেন এমন এক চূড়ান্ত rational necessity, যাঁর অস্তিত্ব আমরা যুক্তির সাহায্যে আবিষ্কার করি, কোনো ধর্মগ্রন্থের দাবির উপর ভিত্তি করে নয়। তিনি গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের “প্রাইম মুভার” বা “আদি চালক” ধারণাকে ইসলামী ঈশ্বরতত্ত্বের সঙ্গে একীভূত করেন। এই প্রাইম মুভার নিজে কখনো পরিবর্তিত হন না, কিন্তু তাঁর অস্তিত্বের অনিবার্যতায় সৃষ্টিজগত গতিশীল হয়। ইবনে রুশদের কাছে ঈশ্বর মানে কোনো anthropomorphic সর্বশক্তিমান শাসক নন, বরং যুক্তির প্রাকৃতিক ও অনিবার্য পরিণতি।
এই দার্শনিক রূপান্তর আসলে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের ঈশ্বরচিন্তার প্রত্যক্ষ প্রভাব। প্লেটোর নিওপ্লাটনিক ‘এক’ (The One) এবং অ্যারিস্টটলের unmoved mover-এর ধারা ইসলামী চিন্তায় যে ঈশ্বর তৈরি করেছে, তা পূর্বের শারীরিক, ব্যক্তিক ও আবেগপ্রবণ ঈশ্বরের ধারণা থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদের কাজের মাধ্যমে ইসলামে আল্লাহ হয়ে ওঠেন এমন এক বিমূর্ত, সেই সময়ের চিন্তাশীলদের উপযোগী যুক্তিনির্ভর, স্থান-কাল-রহিত সত্তা, যাঁকে অনুভব করা যায় কেবল বুদ্ধি ও যুক্তির আলোয় [22] [23] [24]।
বিবর্তনের পেছনে সমাজ-সংস্কৃতির ভূমিকা
আল্লাহর বিবর্তনকে কেবল ধর্মীয় বা দার্শনিক প্রয়োজনে দেখা যথেষ্ট নয়; এর পেছনে ছিল সুস্পষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। ইসলাম যেসব ভূখণ্ডে জন্ম নেয়, সেই হেজাজ অঞ্চলের সমাজ ছিল মূলত একটি যুদ্ধপ্রবণ, বংশগত গোষ্ঠীবাদে বিভক্ত, এবং দৃঢ়ভাবে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। এমন এক বাস্তবতায় প্রয়োজন ছিল এমন এক ঈশ্বরের, যিনি ছিলেন চরম কর্তৃত্বশালী, ভয় জাগানিয়া, শত্রুনাশী এবং সরাসরি যুদ্ধ ও প্রতিশোধের সাথে সম্পৃক্ত। এই আল্লাহ একজন যোদ্ধা ঈশ্বর, যিনি “কাফেরদের হৃদয়ে ভয় ঢেলে দেন” [25], “নিজেই ধ্বংস করেন” [26], “কাফেরদের রক্ত যথেষ্ট পরিমাণে জমিনে প্রবাহিত না হওয়া অবধি সন্তুষ্ট হন না” [27] এবং “তাঁর রাসূল ও বিশ্বাসীদের বিজয় দান করেন” [28]। প্রাথমিক মুসলিমরা তাঁকে কল্পনা করেছেন এমন এক সত্তা হিসেবে, যিনি দিকনির্দেশনা দেন, অস্ত্র ধারণ না করলেও ফেরেশতাদের দিয়ে একদলকে সাহায্য করেন, এবং আরশ থেকে নজরদারি করে মানব সমাজ শাসন করেন।
কিন্তু ইসলাম যখন বেদুইন মরুভূমি থেকে নগরসভ্যতার দিকে অগ্রসর হয়—বিশেষত আব্বাসীয় শাসনামলে যখন মুসলিম চিন্তাশীলরা বাগদাদ, বসরা, কুফা, ও কায়রোর মতো শহরে গ্রিক, পারস্য ও ভারতীয় দর্শনের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় প্রবেশ করে—তখন পুরোনো ঈশ্বরধারণা বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যায় পড়ে যায়। নগরজীবনের জটিলতা, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, বৈচিত্র্যপূর্ণ মতবাদ, মানবিক বোধবুদ্ধির উন্মেষ ঘটা, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির বাস্তবতায় সেই “সেনাপতি ঈশ্বর” ক্রমে হয়ে ওঠেন এক বিমূর্ত, যুক্তিনির্ভর, মানবিক, নৈতিক আদর্শের প্রতীক। এই আল্লাহ আর শত্রু মারেন না, বরং “হিকমাহ” (প্রজ্ঞা), “আদল” (ন্যায়) এবং “সবর” (ধৈর্য)-এর উৎস হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ যোদ্ধা আল্লাহ হয়ে ওঠেন জ্ঞানী আল্লাহ, অর্থাৎ আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট হয়ে ওঠেন এরিস্টটল।
এই রূপান্তর কেবল চিন্তার জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং ঈশ্বরের ভাষা, রূপ, ও ভাবধারার মধ্যেও ধরা পড়ে। প্রাথমিক যুগে আল্লাহ ছিলেন ‘যিনি ভয় দেখান’, কিন্তু দার্শনিক যুগে তিনি হয়ে ওঠেন ‘যিনি মানুষের অন্তরকে বোঝান’। এই পরিবর্তনই বলে দেয়, ঈশ্বর কোনো চিরস্থায়ী সত্তা নন—বরং সময়, সমাজ ও জ্ঞানের ধারাবাহিক চাপে গঠিত এক সাংস্কৃতিক নির্মাণ, যিনি মানুষের চিন্তার বিবর্তনের সাথে নিজেও বিবর্তিত হয়ে যান।
উপসংহার
ইসলামের ঈশ্বরধারণা কোনো স্থির, অপরিবর্তনীয় ও চিরন্তন তত্ত্ব নয়—বরং এটি এক স্পষ্ট মানবিক নির্মাণ, যা সময়, জ্ঞান, সমাজ ও ইতিহাসের আলো-ছায়ায় ক্রমাগত বিবর্তিত হয়ে এসেছে। প্রাথমিক কোরআনিক ও হাদিসের পাঠে যে ঈশ্বর স্পষ্টভাবে হাত-পা, মুখমণ্ডল, ক্রোধ, হাঁটা বা বসার মতো মানবীয় বৈশিষ্ট্যে সজ্জিত ছিলেন, তিনি পরবর্তীকালে দার্শনিক ও যুক্তিবাদী চর্চার মুখে পড়ে হয়ে ওঠেন স্থান-কালহীন, রূপহীন, বিমূর্ত এবং যুক্তির আলোয় চিন্তনযোগ্য এক সর্বজ্ঞ পরমসত্তা। এই রূপান্তর কেবল ধর্মতাত্ত্বিক নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযোজন—যেখানে ঈশ্বরকে মানবীয় গণ্ডি থেকে মুক্ত করে ভাবা হয় বৃহত্তর যৌক্তিক কাঠামোর অন্তর্গত এক অস্তিত্ব হিসেবে।
এই বিবর্তনের ভেতরেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য: ধর্মীয় ধারণাগুলোও মানুষ তৈরি করে, এবং সেগুলোর গঠনে সমাজ, রাজনীতি, জ্ঞানতত্ত্ব ও দর্শনের ভূমিকা অপরিহার্য। সময়ের সাথে, চাহিদার সাথে, ও যুক্তির চাপে সেসব ধারণা রূপান্তরিত হয়, পুরনো ভাষ্য হারায়, নতুন ব্যাখ্যা গড়ে ওঠে। ইসলামেও এই রূপান্তর স্বতঃসিদ্ধ, এবং তা আমাদের দেখায়—ঈশ্বর কেবল বিশ্বাসের বস্তু নন, বরং মানব ইতিহাসের অভ্যন্তরে নির্মিত এক ধারণা, যিনি প্রতিটি যুগে তার অনুসারীদের মানস অনুযায়ী নিজেকে রূপান্তরিত করেন।
সুতরাং, ধর্ম ও ঈশ্বরকে যদি সত্যিই উপলব্ধি করতে হয়, তবে কেবল বিশ্বাসের নয়, বরং ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পাঠের মধ্য দিয়েই আমাদের এগোতে হবে—যেখানে ঈশ্বরকে প্রশ্ন করা যাবে, বিশ্লেষণ করা যাবে, এমনকি বুঝতে চেষ্টা করাও একধরনের নৈতিক দায়।
তথ্যসূত্র
- কোরআন ৬৮:৪২ [↑]
- কোরআন ৫৭:৪ [↑]
- কোরআন ২০:৫ [↑]
- সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিসঃ ৪৭২৭ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৩৫৩১ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ১০৭৯ [↑]
- আল-লুলু ওয়াল মারজান, হাদিসঃ ৪৩৪ [↑]
- সূনান তিরমিজী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৪৪৬ [↑]
- মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), হাদিসঃ ১২২৩ [↑]
- আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিসঃ ৭৫৮ [↑]
- ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম, মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল-উসাইমীন, পৃষ্ঠা ৮০, ৮১ [↑]
- Richard Walzer. Greek into Arabic. Harvard University Press, pp. 89–105[↑]
- Oliver Leaman. Introduction to Classical Islamic Philosophy. Cambridge University Press, pp. 34–39 [↑]
- Majid Fakhry. A History of Islamic Philosophy. Columbia University Press, pp. 45–50 [↑]
- W. Montgomery Watt. Islamic Philosophy and Theology. Edinburgh University Press, pp. 27–34 [↑]
- Frank Griffel. Al-Ghazali’s Philosophical Theology. Oxford University Press, 2009, pp. 28–30 [↑]
- Majid Fakhry. A History of Islamic Philosophy. Columbia University Press, pp. 62–64[↑]
- W. Montgomery Watt, pp. 40–47 [↑]
- Oliver Leaman. Introduction to Classical Islamic Philosophy. Cambridge University Press, pp. 52–55[↑]
- শারহুল আক্বীদা আত-ত্বহাবীয়া, লেখক : ইমাম ইবনে আবীল ইয আল-হানাফী, প্রকাশনী : মাকতাবাতুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা ৩২৮ [↑]
- আল-ফিকহুল আকবর (বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা), ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, জাহাঙ্গীর, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ১৪৮-১৫২ [↑]
- Majid Fakhry. A History of Islamic Philosophy. Columbia University Press, pp. 90–104 [↑]
- Frank Griffel, pp. 71–85 [↑]
- Oliver Leaman. Introduction to Classical Islamic Philosophy. Cambridge University Press, pp. 78–90 [↑]
- সূরা আল-আনফাল ৮:১২ [↑]
- সূরা আহযাব ৩৩:২৫ [↑]
- সূরা আনফাল, আয়াত ৬৭ [↑]
- সূরা আল-ফাতহ ৪৮:১ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"