ইসলামের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআনে মহাবিশ্বের সৃষ্টির এক অতি সরলীকৃত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে: “তিনিই সৃষ্টিকর্তা, যখন তিনি কিছু ইচ্ছা করেন, তখন শুধু বলেন ‘হও’, এবং তা হয়ে যায়” (সূরা ইয়াসিন ৩৬:৮২)। এই আয়াতটি ইসলামের অন্যতম মৌলিক বিশ্বাস, যেখানে ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতা এবং সর্বশক্তিমানতাকে তুলে ধরা হয়। কিন্তু যখন আমরা এই বক্তব্যটিকে জটিল দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করি, তখন এর ভেতরের অন্তর্নিহিত অসংগতি, মধ্যযুগের মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতা এবং বেশকিছু মৌলিক প্রশ্ন আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয়। এটি যদি কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস বা আবেগ হতো, তাহলে এই নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু এটি মানুষের অস্তিত্ব, মহাবিশ্বের উদ্ভব, সময়, কার্যকারণ এবং মানব জ্ঞান সম্পর্কে কিছু নলেজ ক্লেইম করে। তাই এটি বিবেচনার প্রয়োজন হয় যে, এই ‘হও’ বললেই হয়ে যাওয়ার ধারণাটি আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের সঙ্গে মৌলিকভাবে সাংঘর্ষিক কিনা। এবং অনুসন্ধান করতে গেলেই দেখা যায়, এই দাবীর তাত্ত্বিক দুর্বলতা এবং সবকিছুর উদ্ভব সম্পর্কে রহস্য আরোপ করাই যে এইসব বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য, তা প্রকট করে তোলে।
আল্লাহ বলতে পারতেন, মহাবিশ্বের উদ্ভব প্রক্রিয়াটি জটিল, যা মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে তোমরা বুঝবে না। সেটি না করে তিনি কিছু দাবী করেছেন, যেই দাবীগুলো বিশ্লেষণ করলে তা অসংখ্য জটিল প্রশ্নের জন্ম দেয়, যা কোরআনের দাবীকে ভালভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাহলে আল্লাহ কোরআনে যেই কথাটি বলেছেন, সেটিই বা বললেন কেন? আল্লাহ কি চান, আমরা মানুষেরা না বুঝে, আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে এই অজুহাতে তার দাবীটি অন্ধভাবে মেনে নিই? তাহলে ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব বা ওডিন জিউস বা অন্য ধর্মের ঈশ্বরেরা কী দোষ করলো? মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার দাবী করে তারা তো বলতে পারে, মানুষ সেসব রহস্য বুঝবে না। তাহলে তাদের কথা কেন মানবো না?
আর আল্লাহ যেহেতু দাবীটি করেই ফেলেছেন, তাই সেই দাবীটিকে বিশ্লেষণ করা তো অবশ্যই জরুরি। আমরা যদি কিছুই না বুঝি, তাহলে আল্লাহর বলা এই আয়াতটি একটি অর্থহীন আয়াত হিসেবে পাঠ করার তো কোন উপযোগ থাকতে পারে না।
প্রথমত, ‘হও’ একটি শব্দ, একটি মৌখিক বা মানবীয় নির্দেশ। এর ভাষাগত দিক যদি আমরা বাদ দিই, শুধুমাত্র একে একটি নির্দেশনামূলক বক্তব্য ধরি, তাহলে এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, যেকোনো নির্দেশের কার্যকারিতা নির্ভর করে একটি প্রাপক সত্তার ওপর, যিনি সেই নির্দেশ গ্রহণ করবেন, বুঝবেন এবং কার্যকর করবেন। আসুন নিচের ডায়াগ্রামটি দেখি,

আমরা যদি কোরআনের এই দাবীটিকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করি যে, তাহলে দুইটি ব্যাপার ঘটা সম্ভবঃ
- আল্লাহ নিজেই ‘হও’ বলছেন এবং নিজেই তা কার্যকর করছেন। এখানেই আল্লাহই নির্দেশদাতা এবং নির্দেশ বাস্তবায়নকারী।
- আল্লাহ শুধু ‘হও’ বলছেন এবং একটি তৃতীয় পক্ষ নির্দেশটি শুনেছে, বুঝেছে এবং বাস্তবায়ন করেছে। এখানে আল্লাহ নির্দেশদাতা এবং অন্যকেউ নির্দেশ বাস্তবায়নকারী।
সমস্যাটি হচ্ছে, একটি নির্দেশ এবং তা বাস্তবায়নের জন্য স্বাভাবিকভাবেই দুটি ভিন্ন সচেতন সত্তা থাকা বাঞ্ছনীয়। যদি বলা হয় যে নির্দেশ পাওয়ার জন্য কোনো বাহ্যিক সত্তার প্রয়োজন নেই, তাহলে ‘হও’ বলার কোন কার্যকারিতা থাকে না, বরং হও বলাটই স্ববিরোধীও। এটি ঈশ্বরকে এমন এক সত্তায় পরিণত করে, যিনি নিজেই নিজের কথা শোনেন এবং নিজেই নিজের নির্দেশে সাড়া দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন – যা কনশাসনেস বা আত্ম-সচেতনতার ধারণার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কার্যকারণ যুক্তির পরিপন্থী। এই ব্যাখ্যা ঈশ্বরকে উদ্ভট একটি যুক্তিহীন চরিত্রে পরিণত করে, যে নিজেই নিজেকে নির্দেশ দেয় এবং নিজেই তা বাস্তবায়ন করে।
দ্বিতীয়ত, কোনো কিছুর অস্তিত্ব লাভের জন্য উপাদান, শক্তি এবং সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্র অনুসারে, শূন্য থেকে পদার্থের সৃষ্টি হওয়া যুক্তিবা বিজ্ঞানের জগতের সংরক্ষণশীলতার নীতিগুলির পরিপন্থী। আধুনিক বিগ ব্যাং তত্ত্বও ‘শূন্য’ বলতে আক্ষরিক অর্থে ‘কিছু না’ বোঝায় না; বরং একটি অতি-ঘন, অতি-উষ্ণ অবস্থা থেকে স্থান, সময় এবং পদার্থ-শক্তির উদ্ভব ঘটেছে বলে ব্যাখ্যা করে। এই বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে, কেবল ‘হও’ বললেই শূন্য থেকে জগৎ তৈরি হয়ে যাওয়া বাস্তবসম্মতভাবে তাৎপর্যহীন। এই ধারণাটি প্রাকৃতিক নিয়ম এবং কার্যকারণ সম্পর্ককে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে।
এছাড়াও, দর্শনের এক কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হলো: “কিভাবে কোনো কিছু নেই থেকে কিছু হতে পারে?” যদি বলা হয় ঈশ্বর চিরকাল বিদ্যমান, তাহলে ঈশ্বরের ইচ্ছারও একটি সময়িক (সময়-নির্ভরশীল) রূপ আছে বলে ধরে নিতে হয় — অর্থাৎ, কোনো এক নির্দিষ্ট মুহূর্তে তিনি ‘ইচ্ছা’ করলেন যে জগৎ হোক। যেই মুহূর্তে তিনি ইচ্ছাটি করলেন, তার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ইচ্ছাটি তাহলে ছিল না।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এর আগে কেন তিনি এই ইচ্ছা করলেন না? ইচ্ছা করার জন্য মানসিক পরিবর্তন প্রয়োজন, আর মানসিক পরিবর্তন মানেই সময়ের অস্তিত্ব, কারণ সময় হলো পরিবর্তনের পরিমাপ। কিন্তু ঈশ্বর যদি সময়-নিরপেক্ষ হন, তাহলে তার ইচ্ছারও পরিবর্তন হতে পারে না। ইচ্ছাটিও আদি ও অনন্ত হতে হবে। আর মহাবিশ্ব সৃষ্টির ইচ্ছাটি যদি আদি ও অনন্ত হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহর তো মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তিনি তো মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা ভিন্ন অন্য কোন ইচ্ছা করতেই পারতেন না, যেহেতু তার ঐ ইচ্ছাটি আদি ও অনন্ত।
আবার, আল্লাহর ইচ্ছা যদি একটি সময়িক (সময়-নির্ভরশীল) ঘটনা হয়, তবে আল্লাহ সময়ের অন্তর্গত হয়ে পড়েন; আর যদি তা চিরন্তন হয়, তাহলে জগতের শুরু কেন একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে হলো? তার পূর্বে আল্লাহ কিসের অপেক্ষায় ছিলেন? এই ধারণায় একটি গভীর দার্শনিক সংকট নিহিত। যদি ঈশ্বর শূন্য থেকে সৃষ্টি করে থাকেন, তবে সৃষ্টি এবং শূন্যতার মাঝখানে এমন এক সত্তা বা প্রক্রিয়া থাকতে হয়, যা মধ্যবর্তী বা আন্তঃসম্পর্কের ধরন বোঝাতে পারে — যা আবার ঈশ্বর ছাড়াও যুক্তিবাদী কাঠামোয় অনুসন্ধানযোগ্য হওয়া দরকার। কারণ যুক্তির নিয়ম অনুসারে, প্রত্যেক কার্যের একটি কারণ থাকা চাই। ‘হও’ যদি একটি কার্য-কারণ সম্পর্কের বাহক হয়, তাহলে এটি একটি কার্যকর ‘কারণ’ হতে পারে কেবল তখনই যখন তার পরিণতি ঘটানোর প্রক্রিয়া বা মাধ্যম বিদ্যমান থাকে। অন্যথায় এটি একটি অযৌক্তিক দাবী যা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আরও একটি গুরুতর সমস্যা হলো, ‘হও’ বললেই কিছু হয়ে যায় – এমন চিন্তা মহাবিশ্বের জটিলতা এবং পরিপার্শ্বিক কার্যকারণ নীতিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে। আজকের মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা, শক্তি, আইন এবং গঠনের পিছনে যে সুনির্দিষ্ট কাঠামো ও সম্পর্ক বিদ্যমান, তা কোনো বোধগম্য ভাষাগত নির্দেশে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। যেমন, হিগস বোসনের আবিষ্কার কিংবা ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির গঠন ব্যাখ্যার জন্য শত শত বছর গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়। অথচ যদি একটি ‘হও’ বলায় সব তৈরি হয়ে যায় – তাহলে “আল্লাহর জ্ঞান অসীম” এই দাবীকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তার সৃষ্টি পদ্ধতিকে একটি শিশুসুলভ জাদুকরী কাজে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। এটি এক ধরনের জ্ঞানগত অলসতা, যা মহাবিশ্বের বিস্ময়কর জটিলতাকে অস্বীকার করে এবং মানবীয় জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টাকে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য করে।
দর্শনের আলোকে এই কথাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ‘হও’ মূলত মরু আরবের অশিক্ষিত মানুষকে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা বোঝাবার জন্য একটি ভাষাগত দাবী মাত্র। কিন্তু যখন একে বাস্তব জগতের অস্তিত্ব বা উদ্ভবের ব্যাখ্যা হিসেবে নেওয়া হয়, তখন তা যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ অনির্ভরযোগ্য হয়ে পড়ে। এই ‘হও’ শব্দটির কোন দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব নেই, কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা এটি দেয় না, শুধুমাত্র এই দাবীকে অন্ধবিশ্বাস করতে বলে, যা জ্ঞানের পরিপন্থী। এটি কোনো বাস্তব ব্যাখ্যা আমাদের দিচ্ছে না, বরং মানব জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং মহাবিশ্বের অসীমতার ধারনা দিয়ে আমাদের অন্ধভাবে অযৌক্তিক দাবীকে মেনে নিতে উৎসাহিত করে। এটি ঈশ্বরের ক্ষমতাকে এমন এক সরলীকৃত রূপে উপস্থাপন করে, যা মানুষকে আসলে কোন জ্ঞান না দিয়েও জ্ঞান দেয়ার ভান করে, কিন্তু এর গভীরতর অর্থ অন্বেষণ করতে গেলে আমাদের যুক্তির সীমানা প্রসারিত করা তো দূরের কথা, বরং তাকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে হয়।
অতএব, ‘হও’ বলে সৃষ্টি – এই বক্তব্যটি জগৎ সম্পর্কে কোনো যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয় না। বরং এটি ঈশ্বরবাদী কল্পনার একটি সরলীকৃত কাহিনি মাত্র, যা মানুষের ভাবপ্রবণতা ও অন্ধবিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে গঠিত। একটি গভীর ও বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বললে, এটি যুক্তি, প্রমাণ, প্রক্রিয়া এবং মধ্যবিন্দু সত্তার ধারণাগুলোর সঙ্গে মৌলিকভাবে সাংঘর্ষিক। আমাদের যদি সত্যিকার অর্থে মহাবিশ্বের সূচনা ও প্রকৃতির নিয়ম বুঝতে হয়, তাহলে ‘হও’ জাতীয় চটকদার ব্যাখ্যার পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, দার্শনিক নিরীক্ষা এবং কুসংস্কারমুক্ত চিন্তার পথেই এগোতে হবে। কারণ জ্ঞানার্জনের প্রকৃত পথ কোনো জাদুকরী মন্ত্রে নয়, বরং কঠোর যুক্তি, পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের মধ্যে নিহিত।