শুরুতেই মেটাফিজিক্যাল শব্দটির অর্থ আমাদের জেনে নেয়া জরুরি। মেটাফিজিক্যাল শব্দটি মেটাফিজিক্স (Metaphysics) থেকে এসেছে, যা প্রাচীনকালের দার্শনিক চিন্তার একটি শাখা হিসেবে গণ্য হতো। মেটাফিজিক্যাল (Metaphysical) অর্থ হচ্ছে, যা কিছু ভৌত জগতের বাইরে বা বাস্তব বস্তুগত জগতের উর্ধ্বে। আমাদের দৃশ্যমান বাস্তব জগতের মৌলিক প্রকৃতি, অস্তিত্ব, সত্তা, সময়, স্থান, কারণ ও কার্যকারণ ইত্যাদি নিয়ে মেটাফিজিক্সে আলোচনা করা হয়।
মেটাফিজিক্যাল শব্দের ব্যবহার
- দার্শনিক অর্থে: মেটাফিজিক্যাল বলতে বোঝায় এমন বিষয়, যা ভৌত বাস্তবতার (Physical Reality) বাইরের জগৎ নিয়ে আলোচনা করে। এটি বস্তুগত নয় বরং বিমূর্ত ধারণার সাথে সম্পর্কিত। যেমন:
- আত্মা আছে কি না?
- সৃষ্টির মূল কারণ কী?
- জীবনের প্রকৃত অর্থ কী?
- জান্নাত জাহান্নাম আছে কিনা?
- জ্বীন পরী আছে কিনা?
- সাধারণ অর্থে: কোনো কিছুকে যদি বিমূর্ত বা বাস্তবতার বাইরে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবে সেটিকে মেটাফিজিক্যাল বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ:
- “করিমের চিন্তাগুলো সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা কঠিন।” – এখানে তার চিন্তাগুলো মেটাফিজিক্যাল বা সত্যিকার অর্থে বস্তুগতভাবে অস্তিত্বশীল নয় তবে সেগুলো তার মগজে রয়েছে।
- ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক অর্থে: মেটাফিজিক্যাল ধারণাগুলো সাধারণত ঈশ্বর, আত্মা, অনন্ত জীবন, পুনর্জন্ম ইত্যাদির মতো অদৃশ্য বা অতীন্দ্রিয় বিষয়গুলোর সাথে যুক্ত।
Physical Reality-তে প্রভাব রাখলে সেটিকে কি মেটাফিজিক্যাল বলা যায়?
যদি কোনো কিছু ভৌত বাস্তবতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে, তবে সেটিকে মেটাফিজিক্যাল বলা যাবে না। মেটাফিজিক্যাল বলতে বোঝানো হয় এমন কোনো ধারণা বা অলৌকিক অস্তিত্ব, যা ভৌত জগতের বাইরে অবস্থান করে। এটি আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করা যায় না, কোনো যান্ত্রিক উপায়ে মাপা যায় না, এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করাও সম্ভব নয়। এক কথায়, এটি বাস্তব জগতের কোনো উপাদান নয়, বরং কেবল চিন্তা বা অলৌকিক অতীন্দ্রিয় বিষয়। কিন্তু, যদি কোনো কিছুর প্রভাব বাস্তব জগতে পরিলক্ষিত হয়, তাহলে সেটি আর কেবল মেটাফিজিক্যাল থাকছে না, বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণা, পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের আওতায় চলে আসছে।
একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক।
ধরুন, একজন ব্যক্তি দাবি করলেন যে, তার কাছে একটি উড়ন্ত ড্রাগন আছে, যা মেটাফিজিক্যাল। এই ড্রাগনকে দেখা যায় না, শোনা যায় না, বা কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে তার অস্তিত্ব যাচাই করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, এটি সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়াতীত এবং বাস্তব জগতে তার কোনো প্রভাব নেই। এটি হাঁটলে কোন শব্দ হয় না, এটি আমার সাথে ধাক্কা খাবে না। এই পর্যায়ে, ড্রাগনের অস্তিত্ব যাচাই করা সম্ভব নয়, কারণ এটি কেবল এক ব্যক্তির বিশ্বাস বা ইন্দ্রিয়াতীত মেটাফিজিক্যাল সত্তা হিসেবে ধরে নেয়া হবে।
কিন্তু এখন যদি সেই ব্যক্তি বলেন, “আমার উড়ন্ত ড্রাগন নিঃশ্বাস ছাড়লে গরম বাতাস বের হয়,” তাহলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যাবে। কেননা, গরম বাতাস একটি ভৌত বাস্তবতা—এটি অনুভব করা যায়, মাপা যায়, এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে পরীক্ষা করা সম্ভব। অর্থাৎ, যদি এই দাবি সত্য হয়, তবে আমরা সহজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারবো, ড্রাগনটি নিঃশ্বাস ফেললে সত্যিই তাপমাত্রা পরিবর্তন হয় কি না। আমরা একটি থার্মোমিটার বা তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র সেখানে রেখে পর্যবেক্ষণ করতে পারি, এবং যদি বাস্তবিকই কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, তবে এটি প্রমাণ করবে যে ড্রাগনের অস্তিত্ব বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত।
এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, কোনো কিছুর প্রভাব যদি ভৌত জগতে দেখা যায়, তবে সেটি আর মেটাফিজিক্যাল থাকতে পারে না। কারণ, তখন সেটি পরীক্ষাযোগ্য হয়ে যায়, পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়, এবং বিজ্ঞান দ্বারা যাচাই করা যায়। সুতরাং, মৌলিকভাবে মেটাফিজিক্যাল ধারণা কখনোই ভৌত বাস্তবতার ওপর কোনো সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে না, কারণ একবার প্রভাব পরিলক্ষিত হলেই সেটি বিজ্ঞানের আওতায় পড়ে যাবে এবং পরীক্ষার মাধ্যমে তার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হবে।
কেন মেটাফিজিক্যাল জিনিস ভৌত জগতে প্রভাব ফেলতে পারে না?
মেটাফিজিক্যাল ধারণাগুলো সাধারণত তাত্ত্বিক, বিমূর্ত এবং পরীক্ষার বাইরে থাকে। যেমন:
- ঈশ্বরের অস্তিত্ব
- আত্মার ধারণা
- সময়ের প্রকৃতি (বিলকুল বিমূর্তভাবে)
- কারণ ও কার্যকারণের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা
যদি কিছু ভৌত জগতে পর্যবেক্ষণযোগ্যভাবে কাজ করে, তবে সেটি আর খাঁটি মেটাফিজিক্যাল থাকে না। সেটি হয় অলৌকিক (Supernatural) অথবা বাস্তব (Physical) হয়ে যায়।
ইসলামের আকীদাগত বিষয় নিয়ে দার্শনিক সমস্যাবলী
ইসলামের আকীদা বা বিশ্বাসের মৌলিক কাঠামোর উপর আরেকটি গভীর প্রশ্ন দেখা দেয়: ইসলামের মৌলিক আকীদাগুলো কি আদৌ মেটাফিজিক্যাল, নাকি ইসলাম নিজেই দাবী করে যে এসব বাস্তব বস্তুগত জগতে অস্তিত্বশীল? ইসলামের প্রধান বিশ্বাসসমূহকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে দেখা যায় যে এগুলোকে ইসলাম নিজেই মেটাফিজিক্যাল বলে দাবী করেনি; বরং বাস্তব জগতে এগুলোর অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের দাবিগুলো স্ববিরোধী এবং যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক।
প্রথমত, ইসলামের আল্লাহ কি মেটাফিজিক্যাল? যদি আল্লাহ মেটাফিজিক্যাল হন, তবে তার হাত পা কীভাবে আছে? তিনি আরশে কীভাবে সমাসীন হলেন? সেইসাথে, তাঁর সঙ্গে মানুষ কিভাবে কথা বলেছে? হাদিস ও কোরআনের বিভিন্ন বর্ণনা অনুসারে, মুসা নবী সরাসরি আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন, এমনকি একবার আল্লাহ তার সত্তার আংশিক প্রকাশ ঘটালে পাহাড় গলে যায় [1]। তাহলে আল্লাহর অস্তিত্ব কি কেবল মেটাফিজিক্যাল, নাকি বাস্তব বস্তুগত রূপেও প্রকাশিত? আল্লাহ যদি একটি মেটাফিজিক্যাল সত্তা হয়ে থাকেন, তাহলে বস্তুজগতের ওপর এর প্রভাব থাকবে কীভাবে? যদি আল্লাহ মেটাফিজিক্যাল হন, তাহলে তাঁর প্রকাশিত রূপ কেন বস্তুগতভাবে পাহাড়কে গলিয়ে দেবে?
ধরুন, কোথাও আগুন জ্বলছে, তাই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে একটি মোম গলে যাচ্ছে। মোমটি যদি গলে যায়, তাহলে অতি অবশ্যই কোন তাপ এর ওপর প্রভাব ফেলেছে, এবং এই তাপটি বস্তুজগতের সাথে ক্রিয়া করছে। অবস্তু বা মেটাফিজিক্যাল কিছু বস্তুজগতের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলবে? বস্তুজগতের ওপর শুধুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারে আরেকটি বস্তু। কোন অলৌকিক সত্তা নয়।
দ্বিতীয়ত, জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্ব কি কেবল মেটাফিজিক্যাল? ইসলাম অনুসারে, জান্নাতের একটি পাথর হাজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে এবং এটি পরবর্তীতে মানুষের পাপের কারণে কালো হয়ে গেছে। এই বিশ্বাস অনুযায়ী, জান্নাত কেবল মেটাফিজিক্যাল নয়; বরং জান্নাতের বস্তুগত অস্তিত্ব রয়েছে। সেটি হতে পারে একটি গ্রহ। যেই গ্রহের একটি অংশ পৃথিবীতে এসেছে। একইভাবে, হাদিস অনুযায়ী, জাহান্নামের নিঃশ্বাসের প্রভাবে পৃথিবীতে শীত ও গ্রীষ্মের পরিবর্তন ঘটে [2]। তাহলে, জান্নাত ও জাহান্নাম কি কেবল মেটাফিজিক্যাল বা বিমূর্ত ধারণা বা অলৌকিকভাবে অস্তিত্বশীল, নাকি বস্তুগতভাবে বাস্তব জগতে অস্তিত্বশীল?
তৃতীয়ত, ফেরেশতারা কি শুধুমাত্র মেটাফিজিক্যাল সত্তা, নাকি বস্তুগত জগতে তাদের অস্তিত্ব প্রকাশিত হয়েছে? ইসলামের মতে, ফেরেশতারা শুধুমাত্র অদৃশ্য শক্তি নয়, বরং তারা শারীরিক বৈশিষ্ট্যও বহন করে। যেমন, হাদিস অনুসারে, জিবরাইলের ৬০০টি ডানা রয়েছে [3]। এত সংখ্যক ডানা থাকার অর্থ, ফেরেশতারা কেবল এক বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং তারা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সেইসাথে তাদের ডানার প্রয়োজন হয়, বাতাসে ভাসার জন্য কিংবা উড়ার জন্য। মেটাফিজিক্যাল সত্তার কেন ডানার প্রয়োজন হবে?
এই সমস্ত বিশ্লেষণ থেকে একটি সুস্পষ্ট বিরোধিতা দেখা যায়: ইসলাম তার মৌলিক বিশ্বাসগুলোকে ইসলামই মেটাফিজিক্যাল বলে না, বরং এগুলো বাস্তব জগতে অস্তিত্বশীল বলে দাবি করে। ফলে, ইসলাম তার নিজস্ব যুক্তির ভিতরেই একটি চরম স্ববিরোধিতার জন্ম দিয়েছে। একদিকে ইসলাম দাবি করে যে এগুলো মেটাফিজিক্যাল বা গায়েবী, অন্যদিকে বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, এগুলো বাস্তবতার সাথে যুক্ত বা সম্পর্কিত বা প্রভাব বিস্তারকারী। এই সমস্ত আত্মঘাতী কুযুক্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে একটি স্পষ্ট সত্য বেরিয়ে আসে: ইসলাম তার নিজের ভিত্তিতেই যুক্তির সাথে টিকে থাকতে পারে না। কোরআনের অস্তিত্ব ও তার স্বরূপ নিয়ে যে যৌক্তিক অধিবচন সৃষ্টি হয়, তা ইসলামকে একটি স্ববিরোধী ও অসংগতিপূর্ণ মতবাদ হিসেবে প্রমাণ করে। এ থেকে বোঝা যায়, ইসলাম নিজেই তার ভিত্তিগত দর্শনে এমন জটিলতা ও স্ববিরোধিতার জন্ম দিয়েছে, যা এ ধর্মের সত্যতা ও ঐশ্বরিক দাবি প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তথ্যসূত্র
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"