06.যৌক্তিক দ্বন্দ্বঃ ভবিষ্যৎ জ্ঞান এবং সর্বশক্তিমত্তার সংঘাত!

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে অসংখ্য বিতর্ক এবং বিশ্লেষণ হয়েছে। ঈশ্বরকে সাধারণত সর্বশক্তিমান (Omnipotent) এবং সর্বজ্ঞ (Omniscient) হিসেবে কল্পনা করা হয়। কিন্তু এই দুই গুণ একইসঙ্গে থাকা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ জানা এবং সর্বশক্তিমান হওয়া—এই দুই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি মৌলিক সাংঘর্ষিকতা রয়েছে।

সর্বজ্ঞতা (Omniscience)- নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞানের তাৎপর্য

নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ জানা মানে হল, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি সিদ্ধান্ত এবং প্রতিটি ফলাফল পূর্বনির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয়। যদি কোনো সত্ত্বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিখুঁত জ্ঞান রাখেন, তবে তার জানা ভবিষ্যৎ প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তনযোগ্য নয়। কারণ, যদি সেই ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করা সম্ভব হয়, তবে তা আর “নিখুঁত” ভবিষ্যৎ জ্ঞান থাকবে না। সুতরাং, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিখুঁত জ্ঞান একটি অনড় এবং অপরিবর্তনীয় বাস্তবতার ধারণা দেয়। অর্থাৎ নিখুঁত জ্ঞানের অর্থ হলো, একজন সত্তা সময়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানেন – প্রতিটি কণা, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি সম্ভাব্য পথের ফলাফল। এই জ্ঞান কোন সম্ভাব্যতা বা ধারণা নয়, বরং নিশ্চিত এবং অপরিবর্তনীয়। এটি পরিবর্তনীয় হলেই, সেটি আর নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞান থাকে না।

স্বাধীন ইচ্ছার অভাব (Lack of Free Will): নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞানের ধারণা সত্য হলে ঈশ্বরের স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু থাকা অসম্ভব, কারণ তিনি নিজেই তার নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞান দ্বারা শৃঙ্খলিত। যদি ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত হয়, তবে মানুষের পছন্দ এবং সিদ্ধান্তের কোন প্রকৃত অর্থ থাকে না। কারণ তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত পূর্ব থেকেই জানা।

পূর্বনির্ধারিততা (Determinism): যদি কেউ নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ জানেন, তবে এর অর্থ দাঁড়ায় ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত। কোন কিছুই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কারণ যদি পরিবর্তন সম্ভব হতো, তবে সেই সত্তার জ্ঞান “নিখুঁত” থাকত না। এটি কার্যকারণ সম্পর্কের একটি শৃঙ্খল তৈরি করে, যেখানে প্রতিটি ঘটনার একটি সুনির্দিষ্ট কারণ আছে এবং সেই কারণগুলি একটি পূর্বনির্ধারিত ফলাফলের দিকে পরিচালিত করে।

সর্বশক্তিমানতা (Omnipotence): অসীম ক্ষমতার ধারণা

সর্বশক্তিমান হওয়া মানে হল, কোনো সত্ত্বা তার ইচ্ছামত যে কোনো কিছু ঘটাতে বা পরিবর্তন করতে সক্ষম। এই ক্ষমতা কেবল তার নিজের কর্মকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ভবিষ্যৎ, অতীত এবং বর্তমানের যে কোনো বাস্তবতাকে প্রভাবিত করতে পারে। সর্বশক্তিমান সত্তার জন্য কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। কোন সীমাবদ্ধতা, বাধা বা ব্যতিক্রম ছাড়াই। এই ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে:

  • নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও কাজ করার ক্ষমতা (কিছু দার্শনিকদের মতে): যদিও এটি একটি বিতর্কিত বিষয়, কিছু দার্শনিক মনে করেন একজন সর্বশক্তিমান সত্তার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও কাজ করার ক্ষমতা থাকা উচিত।
  • যেকোনো কিছু সৃষ্টি বা ধ্বংস করার ক্ষমতা: বস্তুগত, অবস্তুগত, স্থান, কাল – সবকিছুই এই ক্ষমতার আওতায় পরে।
  • প্রাকৃতিক নিয়ম পরিবর্তন করার ক্ষমতা: পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান বা অন্য কোনো পরিচিত নিয়ম পরিবর্তন বা লঙ্ঘন করার ক্ষমতা।

সাংঘর্ষিকতা: ভবিষ্যৎ জ্ঞান বনাম সর্বশক্তিমত্তা

এই দুই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সাংঘর্ষিকতা স্পষ্ট। যদি একজন সত্ত্বা নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ জানেন, তবে তিনি সেই ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারবেন না। কারণ, পরিবর্তন করার সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভবিষ্যৎ তার জ্ঞানের বাইরে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে তিনি আর সর্বজ্ঞ থাকবেন না। একইভাবে, যদি তিনি ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে চান, তবে তিনি সেই ভবিষ্যতের আগে যা জানতেন, তা মিথ্যা হয়ে যাবে। এই অবস্থায় তিনি আর নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞান রাখবেন না।

সুতরাং, নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞান থাকা মানেই ভবিষ্যৎ এমন একটি বাস্তবতা যা স্থির এবং অপরিবর্তনীয়। কিন্তু সর্বশক্তিমান সত্তা এমন কোনো বাধা বা সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হতে পারেন না। তাই এই দুই বৈশিষ্ট্য একইসঙ্গে কোনো সত্তার মধ্যে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয়।

উদাহরণ

ধরা যাক, কলিমুদ্দীন নামক এক ব্যক্তি নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ জানেন যে, ১৭ মার্চ সকাল ১০:১৫-তে একটি রোড এক্সিডেন্টে তার মৃত্যু হবে। এই তথ্যটি তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন এবং এটি তার নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞানের একটি অংশ। যদি কলিমুদ্দীন সেই দিন রাস্তায় বের না হন এবং রোড এক্সিডেন্ট হওয়ার সব সম্ভাবনা বন্ধ করে দেন, তাহলে সেই নির্ধারিত ঘটনা ঘটবে না। এর অর্থ হলো, তিনি তার জানা ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করে ফেললেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ পরিবর্তিত হওয়া মানে তার পূর্বে জানা জ্ঞানটি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া।

অন্যদিকে, যদি তিনি সর্বশক্তিমান হন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সেই ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে সক্ষম হন, তবে তার জানা ভবিষ্যৎ আর নিখুঁত থাকবে না। এই উদাহরণ স্পষ্ট করে যে নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞান এবং সর্বশক্তিমত্তা একইসঙ্গে বজায় রাখা সম্ভব নয়।

দার্শনিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

এই সমস্যাটি দর্শনের একটি দীর্ঘ আলোচিত প্রশ্নের প্রতিফলন। ঈশ্বর কি সবকিছু করতে পারেন? যদি পারেন, তবে কি তিনি এমন একটি পাথর তৈরি করতে পারেন যা তিনি নিজেও তুলতে পারবেন না? এই ধরনের প্রশ্ন ঈশ্বরের ক্ষমতার প্রকৃত অর্থ এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমাদের ভাবতে বাধ্য করে।

একইভাবে, যদি কোনো সত্ত্বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সর্বজ্ঞ হন, তবে তার ইচ্ছা অনুযায়ী সেই ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করার ক্ষমতা থাকা অসম্ভব। এটি তার ইচ্ছার স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে। কারণ, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার জ্ঞান তাকে সেই ভবিষ্যৎ দ্বারা “শৃঙ্খলিত” করে রাখে।

যুক্তি ও সিদ্ধান্ত

নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞান এবং সর্বশক্তিমত্তার মধ্যে যে বিরোধ রয়েছে, তা আমাদের এই ধারণাকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে বাধ্য করে যে কোনো সত্ত্বা উভয় বৈশিষ্ট্য একইসঙ্গে রাখতে পারে। দর্শনের পরিসরে, এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞান মানেই স্বাধীন ইচ্ছার সীমাবদ্ধতা। আর স্বাধীন ইচ্ছা ছাড়া সর্বশক্তিমান হওয়ার ধারণা ত্রুটিপূর্ণ।

সুতরাং, যদি কোনো সত্ত্বা নিখুঁত ভবিষ্যৎ জ্ঞান রাখেন, তবে তিনি সর্বশক্তিমান হতে পারবেন না। আর যদি তিনি সর্বশক্তিমান হন, তবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিখুঁত জ্ঞান থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই সাংঘর্ষিকতা ঈশ্বরের প্রচলিত ধারণাকে নতুন আলোয় বিবেচনা করার আহ্বান জানায়।