কার্ল মার্ক্স তার “On the Jewish Question” বা “ইহুদি প্রশ্নে” প্রবন্ধে ধর্মের প্রবল সমালোচনা করেন, যার ফলশ্ত্রুতিতে তাকে জার্মানিতে থেকে পালাতে হয় এবং ইংল্যান্ডে এসাইলাম নিতে হয়। সেই প্রবন্ধটি কোনো সাধারণ ধর্মতাত্ত্বিক প্রবন্ধ নয়; এটি এক গভীর সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক বিশ্লেষণ, যেখানে ধর্মকে একটি বিভ্রম হিসেবে উন্মোচন করা হয়েছে। এটি শুধু ধর্মবিরোধী লেখাই ছিল না, বরং ধর্মের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শিকড়কে চিহ্নিত করার এক প্রচেষ্টা। মার্ক্স দেখিয়েছেন, ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, বরং এটি পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ ও নিপীড়নের একটি হাতিয়ার।
ধর্মকে তিনি সমাজের বাস্তব জগতে পরাধীনতার একটি প্রতিফলন হিসেবে দেখেছেন এবং বলেছেন:
Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people.
এখানে ‘অপিয়াম’ বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ধর্ম এমন এক ধরনের মাদক, যা মানুষের কষ্ট ও দুঃখ ভুলিয়ে রাখে এবং তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই ও বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। সুতরাং, মার্ক্সের মতে, ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার নয়, বরং এটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরাধীনতার ফল এবং সেই পরাধীনতাকে টিকিয়ে রাখার একটি অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্র।
বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতার ফল হিসেবে ধর্ম
মার্ক্স মনে করতেন, ধর্মের উৎপত্তি কোনো আধ্যাত্মিক সত্যের কারণে হয়নি; বরং এটি মানুষের বস্তুগত জীবনের গভীর এক সংকটের প্রতিফলন। তিনি বলেছেন,
The religious world is but the reflex of the real world.
অর্থাৎ, ধর্ম আসলে বাস্তব সমাজের প্রতিফলন মাত্র, যেখানে মানুষ নিঃস্ব, নিপীড়িত ও শ্রমের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন। এই পরিস্থিতি মানুষকে স্বর্গীয় সুখের কল্পনায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করে, যেখানে বাস্তব দুনিয়ায় তার অপ্রাপ্তি, শোষণ, বঞ্চনার থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। ধর্ম হলো সেই মোহ যা মানুষের আসল শত্রুকে চিহ্নিত করতে দেয় না; বরং সে শত্রুকে মান্য করতে, বাধ্যগতভাবে চলতে, অবনত মস্তকে অনুগত হতে শেখায়। মার্ক্স বলেন, ধর্ম কোনো চূড়ান্ত সত্যের প্রকাশ নয়, বরং এটি শোষণমূলক সমাজের ছায়া। এই ছায়া যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন ধর্মও টিকে থাকবে।
ধর্ম ও পুঁজিবাদঃ অর্থনৈতিক নিপীড়নের ধারক
মার্ক্সের মতে, পুঁজিবাদ ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজব্যবস্থায় শোষণকে ন্যায্যতা দেয়। ধর্ম শ্রমিকদের শেখায় যে এই দুঃখ-কষ্ট তাদের নিয়তি এবং পরকালীন পুরস্কারের জন্য ধৈর্য্য ধরতে হবে। জীবনটি কোনভাবে কষ্ট করে শেষ করতে পারলেই অনন্ত সুখের পরকাল তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি দেখিয়েছেন, আধুনিক সমাজে ধর্ম আর কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়; এটি একধরনের পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান। এই প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন,
What is the worldly religion of the Jew? Huckstering. What is his worldly God? Money.
এটি অনেক সময় ভুলভাবে ইহুদিবিদ্বেষী মন্তব্য হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু মার্ক্স এখানে কোনো বিশেষ ধর্ম বা জাতির বিরুদ্ধে নন, বরং ধর্মের মূল ভিত্তি এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত হানছেন। এখানে ‘ইহুদি’ বলতে বোঝানো হয়েছে ধর্মবাদী সমাজব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক মানসিকতা, যেখানে ধর্ম এবং বাণিজ্য একাকার হয়ে গেছে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ধর্মীয় মূল্যবোধ কেবল প্রতীকী নয়, বরং বাস্তবিক অর্থেই পুঁজিবাদী শোষণের অংশ। তাই, মার্ক্স বলছেন, শুধুমাত্র ধর্ম থেকে মুক্তি পেলেই চলবে না, বরং সেই অর্থনৈতিক শোষণমূলক ব্যবস্থারও অবসান ঘটাতে হবে, যা ধর্মকে জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেন,
The abolition of religion as the illusory happiness of the people is the demand for their real happiness.
অর্থাৎ, ধর্মের অবলুপ্তি মানে কেবল বিশ্বাসের অবলুপ্তি নয়; এটি মানুষের প্রকৃত মুক্তির জন্য একটি অন্যতম পূর্বশর্ত।
রাষ্ট্র ও ধর্মঃ কৌশলগত প্রতারণা
ধর্ম ও পুঁজিবাদ কেবল একে অপরের পরিপূরকই নয়, বরং রাষ্ট্রও এর সঙ্গে যুক্ত। মার্ক্স দেখিয়েছেন, আধুনিক রাষ্ট্র যদিও নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করে, কিন্তু এটি আসলে ধর্মীয় বিভ্রমকে টিকিয়ে রাখে। তিনি লিখেছেন,
Political emancipation from religion leaves religion intact even though it is no longer a privileged religion.
অর্থাৎ, রাষ্ট্র ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে ঘোষণা করলেও, এটি আসলে পুঁজিবাদী শোষণের একটি অংশ হয়ে থাকে। মার্ক্সের মতে, রাজনীতি ও ধর্মের এই কৌশলগত সম্পর্ক মানুষকে বিভ্রান্ত করে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেও অর্থনৈতিক শোষণ ও ধর্মীয় বিভ্রমের মধ্যে পার্থক্য থাকে না। কারণ, রাষ্ট্র নিজেই পুঁজিবাদী শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। তাই রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে ধর্মের সমাপ্তি নয়, বরং তার একটি নতুন রূপ। তাই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চাইতে ধর্মকে সমূলে উচ্ছেদ করাই জরুরি।
ধর্মের অবলুপ্তিঃ বিপ্লবের একমাত্র পথ
মার্ক্সের মতে, প্রকৃত মুক্তির জন্য কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়। কারণ, ধর্ম একটি লক্ষণ মাত্র, আসল রোগ হলো পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তিনি লিখেছেন,
The critique of religion is the prerequisite of all criticism.
অর্থাৎ, ধর্মের সমালোচনা করা মানে কেবলমাত্র কোন একটি বিশ্বাসের সমালোচনা নয়; বরং যৌক্তিক ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার পূর্বশর্ত। তাই, যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য ধর্মীয় বিভ্রমের অবসান ঘটানো জরুরি, যা ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয়। মার্ক্স মনে করতেন, ধর্মের অবলুপ্তি তখনই সম্ভব, যখন মানুষ তার নিজস্ব শ্রমের ওপর মালিকানা ফিরে পাবে। তাই তিনি কেবল নাস্তিক্যবাদী সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং এক গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, ধর্মই শোষণের প্রধান হাতিয়ার। তার ভাষায়,
To call on people to give up their illusions about their condition is to call on them to give up a condition that requires illusions.
অর্থাৎ, মানুষকে যদি ধর্মীয় বিভ্রম থেকে মুক্ত করতে হয়, তবে সেই বাস্তব অবস্থা বদলাতে হবে, যা তাদের এই বিভ্রমের মধ্যে ঠেলে দেয়।
উপসংহারঃ ধর্ম বনাম বিপ্লব
কার্ল মার্ক্সের “On the Jewish Question” শুধু ধর্মের বিরুদ্ধে লেখা কোনো প্রচারপত্র নয়, বরং এটি শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তার সামগ্রিক বিপ্লবী দর্শনের অংশ। তিনি দেখিয়েছেন, ধর্ম শুধুমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, এটি পুঁজিবাদী সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এটি মানুষকে বিদ্রোহের বদলে পরকালের প্রতিশ্রুতিতে আশ্রয় নিতে শেখায়। তাই, প্রকৃত মুক্তির জন্য ধর্মের সমালোচনা নয়, বরং ধর্মের শিকড়—অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের অবসান ঘটাতে হবে। ধর্মের বিরুদ্ধে মার্ক্সের অবস্থান ছিল একেবারে স্পষ্ট,
The demand to give up the illusion about its condition is the demand to give up a condition which needs illusions.
এটাই তার প্রকৃত বার্তা, ধর্ম থেকে মুক্তি মানে কেবল বিশ্বাসের অবসান নয়, বরং শোষণ ও নিপীড়নের সমাপ্তি। বিপ্লব তখনই সফল হবে, যখন মানুষ কেবল ধর্মের শৃঙ্খল ভাঙবে না, বরং সেই সমাজকেও পাল্টাবে, যা ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছে।