নাসেখ মানসুখ কাকে বলে তা জানার পূর্বে আসুন শুরুতেই কোরআনের কয়েকটি আয়াত পড়ে নেয়া যাক, [1] [2] [3] –
তোমার পূর্বে আমি আমার যে সব রসূল পাঠিয়েছিলাম তাদের ক্ষেত্রে এটাই ছিল নিয়ম আর তুমি আমার নিয়মের কোন পরিবর্তন দেখতে পাবে না।
— Taisirul Quran
আমার রাসূলদের মধ্যে তোমার পূর্বে যাদেরকে আমি পাঠিয়েছিলাম তাদের ক্ষেত্রেও ছিল এরূপ নিয়ম এবং তুমি আমার নিয়মের কোন পরিবর্তন দেখতে পাবেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
তাদের নিয়ম অনুসারে যাদেরকে আমি আমার রাসূলদের মধ্যে তোমার পূর্বে পাঠিয়েছিলাম এবং তুমি আমার নিয়মে কোন পরিবর্তন পাবে না।
— Rawai Al-bayan
আমাদের রাসুলদের মধ্যে আপনার আগে যাদেরকে পাঠিয়েছিলাম তাদের ক্ষেত্রেও ছিল এরূপ নিয়ম এবং আপনি আমাদের নিওমের কোনো পরিবর্তন পাবেন না [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
(এটাই) আল্লাহর বিধান, অতীতেও তাই হয়েছে, তুমি আল্লাহর বিধানে কক্ষনো কোন পরিবর্তন পাবে না।
— Taisirul Quran
ইহাই আল্লাহর বিধান, প্রাচীনকাল হতে চলে আসছে; তুমি আল্লাহর এই বিধানে কোন পরিবর্তন পাবেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের ব্যাপারে এটি আল্লাহর নিয়ম; আর তুমি আল্লাহর নিয়মে কোন পরিবর্তন পাবে না।
— Rawai Al-bayan
এটাই আল্লাহ্র বিধান—পূর্ব থেকেই যা চলে আসছে, আপনি আল্লাহর বিধানে কোনো পরিবর্তন পাবেন না।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
যমীনে উদ্ধত আচরণ আর কু-চক্রান্ত। কু-চক্রান্ত তাকেই ঘিরে ধরবে যে তা করবে। তাহলে তারা কি তাদের পূর্ববর্তীদের উপর (আল্লাহর পক্ষ হতে) যে বিধান প্রয়োগ করা হয়েছে তারই অপেক্ষা করছে? তুমি আল্লাহর বিধানে কক্ষনো কোন পরিবর্তন পাবে না। তুমি আল্লাহর বিধানে কক্ষনো কোন ব্যতিক্রম পাবে না।
— Taisirul Quran
পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ এবং কূট ষড়যন্ত্রের কারণে। কূট ষড়যন্ত্র ওর উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করে। তাহলে কি তারা প্রতীক্ষা করছে পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রযুক্ত বিধানের? কিন্তু তুমি আল্লাহর বিধানের কখনও কোন পরিবর্তন পাবেনা এবং আল্লাহর বিধানের কোন ব্যতিক্রমও দেখবেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
যমীনে উদ্ধত আচরণ ও কূটচক্রান্তের কারণে। কিন্তু কূটচক্রান্ত কেবল তার ধারককেই পরিবেষ্টন করবে। তবে কি তারা পূর্ববর্তীদের (উপর আল্লাহর) বিধানের অপেক্ষা করছে? কিন্তু তুমি আল্লাহর বিধানের কখনই কোন পরিবর্তন পাবে না এবং তুমি আল্লাহর বিধানের কখনই কোন ব্যতিক্রমও দেখতে পাবে না।
— Rawai Al-bayan
যমীনে ঔদ্ধ্যত প্রকাশ এবং কুট ষড়যন্ত্রের কারণে [১]। আর কুট ষড়যন্ত্র তার উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করবে। তবে কি এরা প্রতিক্ষা করছে পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রযুক্ত পদ্ধতির [২]? কিন্তু আপনি আল্লাহর পদ্ধতিতে কখনো কোনো পরিবর্তন পাবেন না এবং আল্লাহর পদ্ধতির কোনো ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করবেন না।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
এবারে প্রখ্যাত আলেম ড. আবু বকর যাকারিয়ার মুখ থেকেই সরাসরি শুনি, নাসেখ মানসুখ বিষয়টি সম্পর্কে,
ناسخ (নাসিখুন) ইস্মে ফায়িল এর একবচন। نسخ (নাস্খুন) মূলধাতু থেকে নির্গত। যার লুগাতী বা আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, বদল করা, দূরীভূত করা, স্থলাভিষিক্ত করা, বাতিল করা, পরিবর্তণ করা, চুড়ান্ত ব্যাখ্যা করা ইত্যাদি। তবে ناسخ (নাসিখুন) শব্দের অর্থ হচ্ছে ব্যাখাকারী।
منسوخ (মানসূখুন) শব্দটি অনুরূপ نسخ (নাস্খুন) মূলধাতু থেকে উদগত। যার লুগাতী বা আভিধানিক অর্থ হলো, বদল করা, দূরীভূত করা, স্থলাভিষিক্ত করা, বাতিল করা, পরিবর্তণ করা, চুড়ান্ত ব্যাখ্যা করা ইত্যাদি।
এই বিষয় দুইটি নিয়ে সাধারণত আম মৌলানারা কখনো মুখ খোলেন না। তবে ইসলাম নিয়ে পড়ালেখা করলে বিভিন্ন সময় ইসলামিক আলেমদের বইপত্রগুলোতে নাসেখ মানসুখ শব্দগুলো পাওয়া যায়। এই শব্দগুলো খুব ভালভাবে জানা এবং বোঝা ইসলামকে সামগ্রিকভাবে বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাসেখের অর্থ হলো, যা রহিত করে। ‘নসখ’ এর বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে ‘মানসুখ’ শব্দটি। মানসুখ অর্থ হচ্ছে, যা রহিত করা হয়েছে। কোরআনের কিছু আয়াতকে ‘মানসুখ’ বা রহিত আয়াত এবং আরো কিছু আয়াতকে ‘নসখ’ বা পরিমার্জিত আয়াত বলা হয়। নসখ আয়াতের বিধান দ্বারা মানসুখ আয়াতের বিধান রহিত ও প্রতিস্থাপিত হয়। অর্থাৎ, আল্লাহ পাক মাঝে মাঝেই বিভিন্ন আয়াত নাজিল করে, সেই আয়াত আবার রহিত করেছেন, নতুন আয়াত নাজিল করেছেন। বিষয়টি কোরআনের অবিকৃত হওয়ার বিরুদ্ধে এক বিশাল ধাক্কা। যদিও মুসলিমগণ এখানেও মুখ উচিয়ে বলবেন, এই সংস্কার, পরিমার্জনাও আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছে।
আমি কোন আয়াত রহিত করলে কিংবা ভুলিয়ে দিলে, তাত্থেকে উত্তম কিংবা তারই মত আয়াত নিয়ে আসি, তুমি কি জান না যে, আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর উপর ক্ষমতাবান।
— Taisirul Quran
আমি কোন আয়াতের হুকুম রহিত করলে কিংবা আয়াতটিকে বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তদনুরূপ আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জাননা যে, আল্লাহ সর্ব বিষয়ের উপরই ক্ষমতাবান?
— Sheikh Mujibur Rahman
আমি যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
— Rawai Al-bayan
আমরা কোনো আয়াত রহিত করলে বা ভুলিয়ে দিলে তা থেকে উত্তম অথবা তার সমান কোনো আয়াত এনে দেই [১] আপনি কি জানেন না যে, আল্লাহ্ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
আমি যখন এক আয়াতের বদলে অন্য আয়াত নাযিল করি- আর আল্লাহ ভালভাবেই জানেন, যা তিনি নাযিল করেন– তখন এই লোকেরা বলে, ‘তুমি তো মিথ্যা রচনাকারী।’ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, এ সম্পর্কে তাদের অধিকাংশেরই কোন জ্ঞান নেই।
— Taisirul Quran
আমি যখন এক আয়াতের পরিবর্তে অন্য এক আয়াত উপস্থিত করি, আর আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন তা তিনিই ভাল জানেন, তখন তারা বলেঃ তুমিতো শুধু মিথ্যা উদ্ভাবনকারী, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর যখন আমি একটি আয়াতের স্থানে পরিবর্তন করে আরেকটি আয়াত দেই- আল্লাহ ভাল জানেন সে সম্পর্কে, যা তিনি নাযিল করেন– তখন তারা বলে, তুমি তো কেবল মিথ্যা রটনাকারী; রবং তাদের অধিকাংশই জানে না।
— Rawai Al-bayan
আর যখন আমরা এক আয়াতের স্থান পরিবর্তন করে অন্য আয়াত দেই— আর আল্লাহ্ই ভাল জানেন যা তিনি নাযিল করবেন সে সম্পর্কে— , তখন তারা বলে, ‘আপনি তো শুধু মিথ্যা রটনাকারী’, বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
সেই সাথে, সহিহ হাদিসেও এই বিষয়ে পরিষ্কার বলা আছে যে, আল্লাহ পাকের নাজিলকৃত কোন কোন আয়াত বাতিল হতে পারে। [6]
সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫২/ তাফসীর
হাদিস নাম্বার: ৪১৭৪
৪১৭৪। উমাইয়া (রহঃ) … আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি উসমান ইবনু ‘আফফান (রাঃ) কে উক্ত আয়াত সম্পর্কে বললাম যে, এ আয়াত তো অন্য আয়াত দ্বারা মানসুখ (রহিত) হয়ে গেছে। অতএব উক্ত আয়াত আপনি মুসহাফে লিখেছেন (অথবা রাবী বলেন) কেন বর্জন করছেন না, তখন তিনি (উসমান (রাঃ)) বললেন, হে ভাতিজা আমি মুসহাফের স্থান থেকে কোন জিনিস পরিবর্তন করব না।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
এ থেকে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়, আল্লাহ পাক তার নাজিলকৃত আয়াতসমূহে মাঝে মাঝে পরিবর্তন আনেন। প্রয়োজনমাফিক তিনি সংশোধন করেন। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে সংশয় ডট কমের সংকলন দেখুন।
মুহাম্মদের সাহাবীগণ, তাবে তাবেইন এবং প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলারগণের মত হচ্ছে, অন্তত পাঁচশ আয়াত রহিত হয়ে গেছে। এসব আয়াতের বিধান এখন আর কার্যকর নয়, যদিও এর প্রায় সবই এখনো কোরআনে রয়েছে। নাসেখ মানসুখের ওপর ভিত্তি করে কোরআনের সূরাগুলোকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ
- ৩০টি সূরায় নাসেখ মানসুখ উভয় ধরণের আয়াত রয়েছে। অর্থাৎ, এসব সূরায় বিধান রহিতকারী আয়াতও রয়েছে, পাশাপাশি পুরাতন বিধান সমৃদ্ধ আয়াতও রয়েছে।
- ৩৬টি সূরায় শুধু মানসুখ আয়াতসমূহ রয়েছে। এদেরকে যে আয়াতগুলো রহিত করেছে, সেগুলো অন্য সূরায় স্থান পেয়েছে কিংবা এদের পরিবর্তে অন্য কোন আয়াত পাঠানো হয়নি।
- ৬টি সূরায় শুধু নসখ আয়াতসমূহ রয়েছে। এই আয়াতগুলো যাদেরকে রহিত করেছে, সেগুলো অন্য সূরায় উল্লেখ করা হয়েছে।
- ৪২টি সূরায় নসখ বা মানসুখ জাতীয় কোন আয়াত নেই। এগুলো ঝামেলামুক্ত।
আসুন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী এর খ্যাতনাম গ্রন্থ আল ফাউযুল কবীর ফি উসুলিত তাফসীর থেকে সরাসরি পড়ি। [7]
তথ্যসূত্র
- সূরা ১৭ঃ আয়াত ৭৭ [↑]
- সূরা ৪৮ঃ আয়াত ২৩ [↑]
- সূরা ৩৫ঃ আয়াত ৪৩ [↑]
- সূরা বাকারাঃ ১০৬ [↑]
- সূরা নাহলঃ ১০১ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নাম্বারঃ ৪১৭৪ [↑]
- আল ফাউযুল কবীর ফি উসুলিত তাফসীর, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"