কোরআনের মধ্যে বেশকিছু আয়াতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। একদিকে কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে, “কোনো ভারবহনকারী অন্যের পাপের ভার বহন করবে না,” অর্থাৎ প্রত্যেকেই কেবল নিজের কৃতকর্মের জন্য দায়ী হবে এবং কেউ অন্যের পাপের দায়ভার বহন করবে না। এটি একটি ন্যায়বিচারমূলক ধারণা, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার কর্মফলের জন্য নিজে দায়ী থাকে এবং অন্যের কাজের শাস্তি বা পুরস্কার ভোগ করবে না। কিন্তু অন্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিছু মানুষ কেয়ামতের দিনে নিজেদের পাপের ভার তো বহন করবেই, সেই সঙ্গে তাদের দ্বারা প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত মানুষদের পাপের বোঝাও বহন করবে। এই দ্বিতীয় ধরনের বক্তব্যের মানে দাঁড়ায়, যদি কেউ অন্যকে ভুল পথে পরিচালিত করে, তাহলে সেই বিভ্রান্ত ব্যক্তির পাপের একটি অংশও তার ওপর বর্তাবে। ফলে, এখানে প্রশ্ন ওঠে—কোনো ব্যক্তি কি সত্যিই অন্যের পাপের দায় বহন করতে পারে?
এক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন ধারণার সৃষ্টি হয়—একটি হলো, প্রত্যেকেই তার নিজস্ব পাপের দায়ভার বহন করবে, আর অন্যটি হলো, নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের পাপের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের পাপের অংশীদার হবে। এই দ্বৈত ও পরস্পরবিরোধী ধারণা একটি জটিলতা তৈরি করে, যা ইসলামের ন্যায়পরায়ণতার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। যদি কেউ প্রকৃতপক্ষে অন্যের পাপের বোঝা বহন করতে না পারে, তবে কেন অন্যের পাপের দায়ভার একাংশ প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তির ওপর বর্তাবে?
একইসাথে, হাদিসে বলা হয়েছে, মুসলিমদের পাপের বোঝা ইহুদী নাসারাদের ওপর চাপিয়ে দেবেন! যা এই সম্পর্কিত ন্যায় বিচারের ধারনার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। আসুন তথ্যগুলো যাচাই করি,
কোন মানুষ অন্যের পাপের বোঝা বহন করবে না | মানুষ অন্যের পাপের বোঝাও বহন করবে |
---|---|
আমি কি আল্লাহকে ছেড়ে অন্য প্রতিপালক তালাশ করব? (অথচ প্রকৃতপক্ষে) তিনিই সব কিছুর প্রতিপালক। প্রত্যেক ব্যক্তি যা অর্জন করে তার জন্য সে নিজেই দায়ী হবে। কোন ভারবহনকারীই অন্যের গুনাহের ভার বহন করবে না। অবশেষে তোমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল তোমাদের প্রতিপালকের নিকটেই, তখন তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন যে সকল বিষয়ে তোমরা মতভেদে লিপ্ত ছিলে (সে সব বিষয়ে প্রকৃত সত্য কোনটি)। — Taisirul Quran তুমি জিজ্ঞেস করঃ আমি কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য রবের সন্ধান করব? অথচ তিনিই হচ্ছেন প্রতিটি বস্তুর রাব্ব! প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বীয় কৃতকর্মের জন্য দায়ী হবে, কেহ কারও কোন বোঝা বহন করবেনা, পরিশেষে তোমাদের রবের নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে, অতঃপর তিনি তোমরা যে বিষয়ে মতবিরোধ করেছিলে সে বিষয়ের মূল তত্ত্ব তোমাদেরকে অবহিত করবেন। — Sheikh Mujibur Rahman বল, ‘আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন রব অনুসন্ধান করব’ অথচ তিনি সব কিছুর রব’? আর প্রতিটি ব্যক্তি যা অর্জন করে, তা শুধু তারই উপর বর্তায় আর কোন ভারবহনকারী অন্যের ভার বহন করবে না। অতঃপর তোমাদের রবের নিকটই তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। সুতরাং তিনি তোমাদেরকে সেই সংবাদ দেবেন, যাতে তোমরা মতবিরোধ করতে। — Rawai Al-bayan বলুন, ‘আমি কি আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে রব খুঁজব? অথচ তিনিই সব কিছুর রব। ’প্রত্যেকে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী এবং কেউ অন্য কারো ভার গ্রহণ করবে না। তারপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন তোমাদের রবের দিকেই , অতঃপর যে বিষয়ে তোমারা মতভেদ করতে, তা তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন। — Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria [1] | তারা অবশ্য অবশ্যই তাদের নিজেদের পাপের বোঝা বহন করবে, নিজেদের বোঝার সাথে আরো বোঝা, আর তারা যে সব মিথ্যে উদ্ভাবন করত সে সম্পর্কে ক্বিয়ামত দিবসে তারা অবশ্য অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে। — Taisirul Quran এবং তারা নিজেদের বোঝা বহন করবে এবং নিজেদের বোঝার সাথে আরও বোঝা; এবং তারা যে মিথ্যা উদ্ভাবন করে সেই সম্পর্কে কিয়ামাত দিবসে অবশ্যই তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে। — Sheikh Mujibur Rahman আর অবশ্যই তারা বহন করবে তাদের বোঝা এবং তাদের বোঝার সাথে আরো কিছু বোঝা। আর তারা কিয়ামতের দিন অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে সে সম্পর্কে, যা তারা মিথ্যা বানাত। — Rawai Al-bayan তারা তো বহন করবে নিজেদের ভার এবং নিজেদের বোঝার সাথে আরো কিছু বোঝা [১]; আর তারা যে মিথ্যা রটনা করত সে সম্পর্কে কিয়ামতের দিন অবশ্যই তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে। — Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria [2] |
কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। আমি ‘আযাব দেই না যতক্ষণ একজন রসূল না পাঠাই। — Taisirul Quran এবং কেহ অন্য কারও ভার বহন করবেনা; আমি রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কেহকেও শাস্তি দিইনা। — Sheikh Mujibur Rahman আর কোন বহনকারী অপরের (পাপের) বোঝা বহন করবে না। আর রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি আযাবদাতা নই। — Rawai Al-bayan আর কোনো বহনকারী অন্য কারো ভার বহন করবে না [২]। আর আমরা রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত শাস্তি প্রদানকারী নই [৩]। — Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria [3] | যার ফলে ক্বিয়ামাত দিবসে তারা বহন করবে নিজেদের পাপের বোঝা পূর্ণ মাত্রায়, আর (আংশিক) তাদেরও পাপের বোঝা যাদেরকে তারা গুমরাহ করেছে নিজেদের অজ্ঞতার কারণে। হায়, তারা যা বহন করবে তা কতই না নিকৃষ্ট! — Taisirul Quran ফলে কিয়ামাত দিবসে তারা বহন করবে তাদের পাপভার পূর্ণমাত্রায় এবং পাপভার তাদেরও যাদেরকে তারা অজ্ঞতা বশতঃ বিভ্রান্ত করেছে; হায়! তারা যা বহন করবে তা কতই না নিকৃষ্ট! — Sheikh Mujibur Rahman এতে করে তারা কিয়ামতের দিনে নিজদের পাপের বোঝা পুরোটাই বহন করবে এবং তাদের পাপের বোঝাও যাদেরকে তারা অজ্ঞতা হেতু পথভ্রষ্ট করে। তারা যা বহন করবে, তা কতই না নিকৃষ্ট! — Rawai Al-bayan ফলে কিয়ামতের দিন তারা বহন করবে তাদের পাপের বোঝা পূর্ণ মাত্রায় এবং তাদেরও পাপের বোঝা যাদেরকে তারা অজ্ঞতাবশত বিভ্রান্ত করেছে [১]। দেখুন, তারা যা বহন করবে তা কত নিকৃষ্ট ! — Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria [4] |
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৫১/ তাওবা পরিচ্ছেদঃ ৮. হত্যাকারীর তাওবা আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য; যদিও সে বহু হত্যা করে থাকে ৬৭৫৮। মুহাম্মদ ইবনু আমর ইবনু আব্বাদ ইবনু জাবালা ইবনু আবূ রাওয়াদ (রহঃ) … আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিছুসংখ্যক মুসলিম পাহাড় সমান গুনাহ নিয়ে কিয়ামতের ময়দানে আসবে এবং আল্লাহ তাআলা তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। আর তা ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের উপর চড়িয়ে দিবেন। আমার মনে হয় এ রূপই বর্ণনাকারী হাদীসের শেষোক্ত কথাটি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। রাবী আবূ রাওহ (রহঃ) বলেন, কার পক্ষ থেকে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে, তা আমার জানা নেই। আবূ বুরদা (রহঃ) বলেন, এ হাদীসটি আমি উমার ইবনু আবদুল আযীয (রহঃ) এর নিকট বর্ণনা করার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার পিতা এ হাদীসটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি (শুনে) তোমার নিকট বর্ননা করেছে কি? আমি বললাম, হ্যাঁ। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) বর্ণনাকারীঃ আবূ মূসা আল- আশ’আরী (রাঃ) [5] | |
সূনান আবু দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৩৫/ সুন্নাহ পরিচ্ছেদঃ ১৮. মুশরিকদের সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে। ৪৬৪২. ইব্রাহীম ইবন মূসা (রহঃ) ….. আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জীবন্ত প্রথিত কন্যা এবং তার মা- উভয়ই জাহান্নামী। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) বর্ণনাকারীঃ শা‘বী (রহঃ) [6] |
তথ্যসূত্র
- সূরা ৬, আয়াত ১৬৮ [↑]
- সূরা ২৯, আয়াত ১৩ [↑]
- সূরা ১৭, আয়াত ১৫ [↑]
- সূরা ১৬, আয়াত ২৫ [↑]
- সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৬৭৫৮ [↑]
- সূনান আবু দাউদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৪৬৪২ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"