খ্রিস্টানদের ত্রিত্ব বা ত্রিত্ববাদ বা ট্রিনিটির ধারণা হলো অধিকাংশ খ্রিস্টান কর্তৃক স্বীকৃত ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কিত একটি মৌলিক আকীদা বা কেন্দ্রীয় বিশ্বাস, যেখানে এক ঈশ্বরকে তিনজন সহ-সমান, সহ-অনন্ত, স্থায়ীভাবে বিদ্যমান ঈশ্বরত্বের মিলন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই তিনটি সত্ত্বা হচ্ছে পবিত্র পিতা ঈশ্বর, পবিত্র পুত্র ঈশ্বর (যিশু খ্রিস্ট) ও পবিত্র আত্মা ঈশ্বর, অর্থাৎ এক সারবত্ত্বা/সত্ত্বা/প্রকৃতি (সমজাতীয়তা) তিনটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে (অস্তিত্ব) বিভক্ত। এই মতবাদটিকে বলা হয় ত্রিত্ববাদ এবং এর অনুসারীদের বলা হয় ত্রিত্ববাদী, অন্যদিকে এর বিরোধীদের বলা হয় ত্রিত্ববাদ-বিরোধী বা অত্রিত্ববাদী। খ্রিস্টান অত্রিত্ববাদীদের মধ্যে রয়েছে একত্ববাদ, দ্বিত্ববাদ ও মডালিজম।
যদিও আধুনিক ত্রিত্ববাদের বিকশিত মতবাদটি নূতন নিয়মের বইগুলোতে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয় নি, তথাপি নূতন নিয়মে ঈশ্বরের একটি ত্রয়ী ধারণা রয়েছে এবং এতে বেশ কয়েকটি ত্রিত্ববাদী সূত্র রয়েছে। ত্রিত্বের মতবাদটি প্রথম প্রণীত হয়েছিল প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টান ও গির্জার ফাদারদের মধ্যে যখন তাঁরা তাঁদের শাস্ত্রীয় নথিপত্র ও পূর্ববর্তী ঐতিহ্যে যিশু ও ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ত্রিত্ব সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা রয়েছে: ফিলিওকুই, শাশ্বত কার্যকরী অধীনতাবাদ, অধীনতাবাদ ও সামাজিক ত্রিত্ববাদ।
যদিও ত্রিত্ব মূলত একটি খ্রিস্টান ধারণা, তথাপি ইহুদি ধর্মেও এর একটি সমান্তরাল দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, বিশেষ করে কাব্বালা ঐতিহ্যের রচনাসমূহে। খ্রিস্টানগণের মধ্যে একটি বৃহৎ অংশ মনে করেন, একজন ঈশ্বর বিদ্যমান। সম্পূর্ণ পৃথক তিনজন ভিন্ন ভিন্ন সত্ত্বা বিদ্যমান: পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা। তিনজনের প্রত্যেক ব্যক্তিই ঈশ্বর: পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর, পবিত্রআত্মা ঈশ্বর। পিতা পুত্র নন, পুত্র পবিত্র আত্মা নন, পিতা পবিত্র আত্মা নন।”
নবী মুহাম্মদ যখন লোকমুখে এই ট্রিনিটি বা ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন, তিনি এই ট্রিনিটি সম্পর্কে ভুল ধারণা করে ভেবেছিলেন, খ্রিস্টধর্মে এই তিনজন হচ্ছে ঈশ্বর, তার পুত্র এবং ঈসা বা যীশুর মাতা মরিয়ম। মুহাম্মদের এই ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে কোরআনের আয়াতও রয়েছে, যেখানে ট্রিনিটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল একটি ধারণা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কোরআনে ট্রিনিটির সমালোচনা করতে গিয়ে আসলে ভুল ট্রিনিটির সমালোচনা করা হয়েছে, যেই ট্রিনিটিতে পবিত্র আত্মা নয়, ঈসার মাকে ট্রিনিটির অংশ ভাবা হয়েছে। অথচ ঈসার মাকে অধিকাংশ ট্রিনিটিতে বিশ্বাসী খ্রিস্টান ট্রিনিটির অংশ মনে করে না। ট্রিনিটির শেষেরজন হচ্ছে পবিত্র আত্মা, মরিয়ম নয়। আসুন কোরআনের সেই আয়াতটি পড়ে দেখা যাক, [1] –
স্মরণ কর, যখন আল্লাহ ঈসা ইবনু মারইয়ামকে বললেন, তুমি কি লোকেদেরকে বলেছিলে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে আর আমার মাতাকে ইলাহ বানিয়ে নাও।’ (উত্তরে) সে বলেছিল, ‘পবিত্র মহান তুমি, এমন কথা বলা আমার শোভা পায় না যে কথা বলার কোন অধিকার আমার নেই, আমি যদি তা বলতাম, সেটা তো তুমি জানতেই; আমার অন্তরে কী আছে তা তুমি জান কিন্তু তোমার অন্তরে কী আছে তা আমি জানি না, তুমি অবশ্যই যাবতীয় গোপনীয় তত্ত্ব সম্পর্কে পূর্ণরূপে ওয়াকেফহাল।
— Taisirul Quran
আর যখন আল্লাহ বলবেনঃ হে ঈসা ইবনে মারইয়াম! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলেঃ তোমরা আল্লাহর সাথে আমার ও আমার মায়েরও ইবাদাত কর? ঈসা নিবেদন করবেঃ আপনি পবিত্র! আমার পক্ষে কোনক্রমেই শোভনীয় ছিলনা যে, আমি এমন কথা বলি যা বলার আমার কোন অধিকার নেই; যদি আমি বলে থাকি তাহলে অবশ্যই আপনার জানা থাকবে; আপনিতো আমার অন্তরে যা আছে তাও জানেন, পক্ষান্তরে আপনার জ্ঞানে যা কিছু রয়েছে আমি তা জানিনা; সমস্ত গাইবের বিষয় আপনিই জ্ঞাত।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর আল্লাহ যখন বলবেন, ‘হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা, তুমি কি মানুষদেরকে বলেছিলে যে, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাতাকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর?’ সে বলবে, ‘আপনি পবিত্র মহান, যার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার জন্য সম্ভব নয়। যদি আমি তা বলতাম তাহলে অবশ্যই আপনি তা জানতেন। আমার অন্তরে যা আছে তা আপনি জানেন, আর আপনার অন্তরে যা আছে তা আমি জানি না; নিশ্চয় আপনি গায়েবী বিষয়সমূহে সর্বজ্ঞাত’।
— Rawai Al-bayan
আরও স্মরণ করুন, আল্লাহ্ যখন বলবেন, ‘হে মারইয়াম –তনয় ‘ঈসা! আপনি কি লোকদেরকে বলেছিলেন যে, তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া আমাকে আমার জননীকে দুই ইলাহরূপে গ্রহণ কর? ‘তিনি বলবেন, ‘আপনিই মহিমান্বিত! যা বলার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার পক্ষে শোভনীয় নয়। যদি আমি তা বলতাম তবে আপনি তো তা জানতেন। আমার অন্তরের কথাতো আপনি জানেন, কিন্তু আপনার অন্তরের কথা আমি জানি না; নিশ্চয় আপনি অদৃশ্য সম্বদ্ধে সবচেয়ে ভালো জানেন।’
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
তথ্যসূত্র
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"