বিভিন্ন লোকমুখে গল্প গুজব শুনে কেউ যখন সেই সব গল্পগুলো কপি করে, সেই কপির মধ্যে অনেক সমস্যা রয়ে যায়। এই বিষয়ে আলোচনার শুরুতেই, কোরআনের একটি আয়াত আমাদের খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া প্রয়োজন। আয়াতটিতে বলা হচ্ছে, মক্কার লোকেরা নবী মুহাম্মদকে কান সর্বস্ব লোক বলে ঠাট্টাতামাশা করতো। আচ্ছা, সবকিছু বাদ দিয়ে কান সর্বস্ব লোক বলবার কারণ কী? এমন কী কারণ থাকতে পারে, যার কারণে চোখ নাক মুখ বাদ দিয়ে তাকে কান সর্বস্ব লোক বলে ডাকা হতো [1]
আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ নবীকে ক্লেশ দেয়, এবং বলে, এ লোকটি (মুহাম্মদ) তো কানসর্বস্ব। আপনি বলে দিন, কান হলেও তোমাদেরই মঙ্গলের জন্য, আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে এবং বিশ্বাস রাখে মুসলমানদের কথার উপর। বস্তুতঃ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার তাদের জন্য তিনি রহমতবিশেষ। আর যারা আল্লাহর রসূলের প্রতি কুৎসা রটনা করে, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।
এবারে আসুন একটি হাদিস পড়ি, যেখানে শিক্ষিত একজন ওহী লেখক ইসলাম ত্যাগ করে নবীর সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি যা লিখে দিতেন তার চেয়ে বেশি কিছু নবী জানতেন না [2]। এই হাদিস থেকে জানা যায়, নবীর বিরুদ্ধে খ্রিস্টানের কাছ থেকে আয়াত লিখে নেয়ার একটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল।
সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৬১/ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য
পরিচ্ছেদঃ ৬১/২৫. ইসলামে নুবুওয়াতের নিদর্শনাবলী।
৩৬১৭. আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক খ্রিস্টান ব্যক্তি মুসলিম হল এবং সূরা বাকারাহ ও সূরা আলে-ইমরান শিখে নিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য সে ওহী লিখত। অতঃপর সে আবার খ্রিস্টান হয়ে গেল। সে বলতে লাগল, আমি মুহাম্মাদ -কে যা লিখে দিতাম তার চেয়ে বেশি কিছু তিনি জানেন না। (নাউজুবিল্লাহ) কিছুদিন পর আল্লাহ্ তাকে মৃত্যু দিলেন। খ্রিস্টানরা তাকে দাফন করল। কিন্তু পরদিন সকালে দেখা গেল, কবরের মাটি তাকে বাইরে নিক্ষেপ করে দিয়েছে। এটা দেখে খ্রিস্টানরা বলতে লাগল- এটা মুহাম্মাদ এবং তাঁর সাহাবীদেরই কাজ। যেহেতু আমাদের এ সাথী তাদের হতে পালিয়ে এসেছিল। এ জন্যই তারা আমাদের সাথীকে কবর হতে উঠিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। তাই যতদূর পারা যায় গভীর করে কবর খুঁড়ে তাকে আবার দাফন করল। কিন্তু পরদিন সকালে দেখা গেল, কবরের মাটি তাকে আবার বাইরে ফেলে দিয়েছে। এবারও তারা বলল, এটা মুহাম্মাদ ও তাঁর সাহাবীদের কান্ড। তাদের নিকট হতে পালিয়ে আসার কারণে তারা আমাদের সাথীকে কবর হতে উঠিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। এবার আরো গভীর করে কবর খনন করে দাফন করল। পরদিন ভোরে দেখা গেল কবরের মাটি এবারও তাকে বাইরে নিক্ষেপ করেছে। তখন তারাও বুঝল, এটা মানুষের কাজ নয়। কাজেই তারা লাশটি ফেলে রাখল। (মুসলিম ৫০/৫০ হাঃ ২৭৮১, আহমাদ ১৩৩২৩) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৩৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৩৫৬)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
এবারে আসুন কোরআনে যা বলা আছে, তা খ্রিস্ট ধর্মের মিথলজির সাথে মেলে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখি। নবী মুহাম্মদ সম্ভবত বিভিন্ন লোকের মুখে এইসব গল্পগুলো শুনে শুনে লিখেছেন, যার কারণে আব্রাহামিক নবীদের আবির্ভাবের টাইমলাইনটি ভালভাবে বুঝতে পারেননি। কোরআনে বলা হয়েছে, যীশু খ্রিস্ট বা ঈসা নবীর মা মরিয়মের পিতার নাম হচ্ছে ইমরান [3]
আর (দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন) ‘ইমরান-কন্যা মারইয়ামের যে তার লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করেছিল, ফলে আমি তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম। সে তার প্রতিপালকের বাণী ও তাঁর কিতাবসমূহে (তাওরাত, যবূর ও ইঞ্জীলে) বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। সে ছিল অনুগত ও বিনতদের অন্তর্ভুক্ত।
— Taisirul Quran
আরও দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন ইমরান তনয়া মারইয়ামের, যে তার সতীত্ব রক্ষা করেছিল, ফলে আমি তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং সে তার রবের বাণী ও তাঁর কিতাবসমূহ সত্য বলে গ্রহণ করেছিল; সে ছিল অনুগতদের একজন।
— Sheikh Mujibur Rahman
(আল্লাহ আরো উদাহরণ পেশ করেন) ইমরান কন্যা মারয়াম-এর, যে নিজের সতীত্ব রক্ষা করেছিল, ফলে আমি তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁকে দিয়েছিলাম। আর সে তার রবের বাণীসমূহ ও তাঁর কিতাবসমূহের সত্যতা স্বীকার করেছিল এবং সে ছিল অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত।
— Rawai Al-bayan
আরও দৃষ্টান্ত পেশ করেন ‘ইমরান-কন্যা মারইয়ামের— যে তার লজ্জাস্থানের পবিত্ৰতা রক্ষা করেছিল, ফলে আমরা তার মধ্যে ফুঁকে দিয়েছিলাম আমাদের রূহ হতে। আর সে তার রবের বাণী ও তাঁর কিতাবসমূহ সত্য বলে গ্রহণ করেছিল এবং সে ছিল অনুগতদের অন্যতম [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
একইসাথে আল্লাহ মরিয়মকে হারুনের বোন হিসেবে সম্বোধন করেছেন [4]
অতঃপর সে তার সন্তানকে বয়ে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে আসল। তারা বলল, ‘হে মারইয়াম! তুমি তো এক অদ্ভুত জিনিস নিয়ে এসেছ!
— Taisirul Quran
অতঃপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হল; তারা বললঃ হে মারইয়াম! তুমিতো এক অদ্ভুত কান্ড করেছ!
— Sheikh Mujibur Rahman
তারপর সে তাকে কোলে নিয়ে নিজ কওমের নিকট আসল। তারা বলল, ‘হে মারইয়াম! তুমি তো এক অদ্ভূত বিষয় নিয়ে এসেছ’!
— Rawai Al-bayan
তারপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হল; তারা বলল, ‘হে মারইয়াম! তুমি তো এক অঘটন করে বসেছ [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
ওহে হারূনের বোন! তোমার পিতা তো খারাপ লোক ছিল না, আর তোমার মাও ছিল না কোন অসতী নারী।’
— Taisirul Quran
হে হারূন ভগ্নি! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলনা এবং তোমার মাতাও ছিলনা ব্যভিচারিণী।
— Sheikh Mujibur Rahman
‘হে হারূনের বোন! তোমার পিতা তো খারাপ লোক ছিল না। আর তোমার মা-ও ছিল না ব্যভিচারিণী’।
— Rawai Al-bayan
‘হে হারূনের বোন! [১] তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিল না এবং তোমার মাও ছিল না ব্যাভিচারিণী [২]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
নবী মুহাম্মদের যুগেই কোরআনের এইসব ভুল বক্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। এইসব প্রশ্নের উত্তরে নবী কী গোঁজামিল দিয়েছিল, আসুন তা দেখে নেয়া যাক [5] –
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৩৯/ শিষ্টাচার
পরিচ্ছেদঃ ১. ‘আবুল কাসিম’ উপনাম গ্রহন নিষিদ্ধ এবং পছন্দনীয় নামের বিবরণ
৫৪১৩। আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বা, মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু নুমায়র, আবূ সাঈদ আশাজ্জ ও মুহাম্মাদ ইবনু মুসান্না আনাযী (রহঃ) … মুগীরা ইবনু শু’বা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি যখন নাজরান গেলাম, তখন সেখানকার লোকেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনারা (আল-কুরআনে)يَا أُخْتَ هَارُونَ (হে হারুনের বোন) অর্থাৎ ঈসা (আলাইহিস সালাম) [অর্থাৎ ঈসা (আঃ) এর মা মারইয়ামকে হারুনের বোন বলা হয়েছে] অথচ মূসা (আলাইহিস সালাম) ছিলেন ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর এত দিন আগে? [সুতরাং মূসা (আলাইহিস সালাম) এর ভাই নবী হারুন (আলাইহিস সালাম) ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর অনেক আগের যুগের। মারইরাম তার বোন হন কিভাবে?]
পরে যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আমি ফিরে এলাম, তখন তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তারা (ইয়াহুদী-নাসারারা) তাদের পূর্ববর্তী নবী ও সালিহগণের নামে (সন্তানের) নাম রাখত।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ মুগীরা ইবনু শু’বা (রাঃ)
এবারে আসুন খ্রিস্ট ধর্মের গ্রন্থগুলো থেকে কী জানা যায় তা জেনে নেয়া যাক। খ্রিস্ট ধর্ম অনুসারে, মরিয়ম হচ্ছেন জোয়াকিম এর কন্যা। এই লোকই যিশুর নানা এবং সেইন্ট অ্যানের স্বামী। জোয়াকিম এবং অ্যানের গল্প পাওয়া যায় জেমসের সুসমাচারে বা ‘গসপেল অফ জেমস’ গ্রন্থে। আবার, খ্রিস্টধর্ম অনুসারে মুসার পিতার নাম ছিল ইমরান। ইমরানের ছেলে ছিল মুসা, হারুন আর কন্যা হচ্ছেন মিরিয়াম, যিনি সম্পুর্ণ ভিন্ন একজন। ইসলামে ধর্মের নবী ঈসার মা মরিয়ম নন। নবী মুহাম্মদ স্পষ্টতই মুসা এবং হারুনের বোন মিরিয়ামের সাথে ঈসা বা যীশুর মা মরিয়মকে গুলিয়ে ফেলেছেন। আসুন ইসলাম ধর্ম অনুসারে এই সম্পর্কটির চার্টটি দেখে নিই,
কিন্তু এই চার্টটি সম্পূর্ণ ভুল, কারণ এই মরিয়ম সেই মরিয়ম নয়। খ্রিস্টধর্ম অনুসারে এই মিরিয়াম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যক্তি, যিনি মুসা এবং হারুনের বোন ছিলেন। নবী মুহাম্মদ লোকমুখে শুনে এই দুইজনকে গুলিয়ে ফেলেছেন। পরবর্তীতে গোঁজামিল দেয়ার জন্য বলেছেন, ইহুদিরা পুর্ববর্তী নবীদের নামে সন্তানদের নাম রাখতো। কিন্তু ঈসার মা মরিয়মের হারুন নামের কোন ভাই ছিল, বা তার পিতা ইমরান ছিল, এরকম কোন প্রমাণ মেলে না।
তথ্যসূত্র
- কোরআন, সূরা তওবা আয়াত ৬১ [↑]
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বরঃ ৩৬১৭ [↑]
- সূরা তাহরীম, আয়াত ১২ [↑]
- সূরা মরিয়ম, ২৭-২৮ [↑]
- সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৫৪১৩ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"