03.হাদিস কখন লিখিত হয়?

অন্ধবিশ্বাসী আহলে কোরআন বা কোরানিস্টদের একটি বহুল প্রচলিত দাবী হচ্ছে, হাদিস নাকি নবীর মৃত্যুর ৩০০ বছর পরে লিখিত হয়েছিল! যা একেবারেই সত্য নয়। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুহাম্মদের আমলেই হাদিস লিখিত হয়েছে। তাই হাদিস মুহাম্মদের মৃত্যুর ২০০-৩০০ বছর পরে লিখিত, এরকম হাস্যকর কথা আর হয় না [1] [2] [3]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৩/ ইলম বা জ্ঞান
পরিচ্ছেদঃ ৮১। ইলম লিপিবদ্ধ করা
১১৪। আলী ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) …. আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণের মধ্য আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) ব্যতীত আর কারো কাছে আমার চাইতে বেশী হাদীস নেই। কারণ তিনি লিখে রাখতেন, আর আমি লিখতাম না। মা’মার (রহঃ) হাম্মাম (রহঃ) সূত্রে আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৩/ ইলম বা জ্ঞান
পরিচ্ছেদঃ ৮৪। ইলম মুখস্ত করা
১২০। আবূ মুস‘আব আহমদ ইবনু আবূ বাকর (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমি আপনার কাছ থেকে বহু হাদীস শুনি কিন্তু ভুলে যাই। তিনি বলবেন তোমার চাঁদর খুলে ধর। আমি খুলে ধরলাম। তিনি দু’হাত অঞ্জলী করে তাতে কিছু ঢেলে দেওয়ার মত করে বললেনঃ এটা তোমার বুকের সাথে লাগিয়ে ধর। আমি তা বুকের সাথে লাগালাম। এরপর আমি আর কিছুই ভুলিনি।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৩/ ইলম বা জ্ঞান
পরিচ্ছেদঃ ৮৪। ইলম মুখস্ত করা
১১৯। ‘আবদুল ‘আযীয ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ লোকে বলে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) বড় বেশী হাদীস বর্ণনা করে। (জেনে রাখ,) কিতাবে দুটি আয়াত যদি না থাকত, তবে আমি একটি হাদিসও বর্ণনা করতাম না। এরপর তিনি তিলাওয়াত করলেনঃ
“আমি সেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি মানুষের জন্য কিতাবে তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পরও যারা তা গোপন রাখে আল্লাহ তাদেরকে লা‘নত দেন এবং অভিশাপকারিগণও তাদেরকে অভিশাপ দেয় কিন্তু যারা তওবা করে এবং নিজদিগকে সংশোধন আর সত্যকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে, ওরাই তারা, যাদের প্রতি আমি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা বাকারাঃ ১৫৯-১৬০)
(প্রকৃত ঘটনা এই যে,) আমার মুহাজির ভাইয়েরা বাজারে কেনাবেচায় এবং আমার আনসার ভাইয়েরা জমা-জমির কাজে মশগুল থাকত। আর আবূ হুরায়রা (রাঃ) (খেয়ে না খেয়ে) তুষ্ট থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে লেগে থাকত। তাই তারা যখন উপস্থিত থাকত না, তখন সে উপস্থিত থাকত এবং তারা যা মুখস্থ করত না সে তা মুখস্থ রাখত।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

এমনকি, নবী মুহাম্মদের অন্যতম প্রিয় সাহাবী হযরত আলীও হাদিস লিখে রাখতেন, যা নিচের হাদিস থেকে পরিষ্কার হয়, [4]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২২/ হজ্ব (হাজ্জ)
পরিচ্ছেদঃ ১১৭০. মদীনা হারম হওয়া
১৭৪৯। মুহাম্মদ ইবনু বাশশার (রহঃ) … আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত এই সহীফা ছাড়া আর কিছুই নাই। তিনি আরো বলেন, ’আয়ির নামক স্থান থেকে অমুক স্থান পর্যন্ত মদিনা হল হারাম। যদি কেউ এতে কুরআন–সুন্নাহর খেলাফ অসঙ্গত কোন কাজ করে অথবা কুরআন-সুন্নাহর খেলাফ, আচরণকারী আশ্রয় দেয়, তাহলে তাঁর উপর আল্লাহর লা’নত এবং সকল ফেরেশতা এবং মানুষের। সে ব্যাক্তির কোন নফল এবং ফরজ ইবাদাত কবুল করা হবে না।
তিনি আরো বলেন, মুসলিম কর্তৃক নিরাপত্তাদানের অধিকার সকলের ক্ষেত্রে সমান। তাই যে ব্যাক্তি কোন মুসলিমের দেওয়া নিরাপত্তাকে লঙ্ঘন করবে, তাঁর প্রতি আল্লাহর লা’নত এবং সকল মানুষের ও ফিরিশতাদের। আর কবুল করা হবে না তাঁদের কোন নফল এবং ফরজ ইবাদাত। যে ব্যাক্তি তাঁর মাওলার (মিত্রের) অনুমতি ব্যতীত অন্য অন্য কাওমের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তাঁর প্রতিও আল্লাহর লা’নত এবং সকল ফেরেশতা ও মানুষের। সে ব্যাক্তির কোন নফল এবং ফরজ ইবাদাত কবুল করা হবে না। আবূ ‘আবদুল্লাহ (রহঃ) বলেন, “আদলুন” অর্থ বিনিময়।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আলী ইবনু আবী তালিব (রাঃ)

আরো বেশ কয়েকটি হাদিসে এই বিষয়টি এসেছে। হযরত আলী যাতে হাদিস লিখে রাখতো তাকে সহীফা বলতেন। এই বিষয়টি নিচের হাদিস থেকে আরো পরিষ্কার হয় [5]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪৮/ জিহাদ
পরিচ্ছেদঃ ১৯১২. বন্দীকে মুক্ত করা। এ বিষয়ে আবু মুসা (রাঃ) কর্তৃক নবী (সাঃ) থেকে হাদীস বর্ণিত রয়েছে
২৮৩৩। আহমদ ইবনু ইউনুস (রহঃ) … আবূ জুহাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আলী (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, আল্লাহর কোরআনে যা কিছু আছে তা ছাড়া আপনাদের নিকট ওহীর কোন কিছু আছে কি? তিনি বললেন, না, সে আল্লাহ তা‘আলার কসম! যিনি শস্যদানাকে বিদীর্ন করেন এবং প্রাণী সৃষ্টি করেন। আল্লাহ কুরআন সম্পর্কে মানুষকে যে জ্ঞান দান করেছেন এবং সহীফার মধ্যে যা রয়েছে, এ ছাড়া আমি আর কিছু জানিনা। আমি বললাম, এ সহীফাটিতে কি আছে? তিনি বললেন, ‘দীয়াতের বিধান, বন্দী মুক্তকরণ এবং কোন মুসলিমকে যেন কোন কাফিরের পরিবর্তে হত্যা করা না হয় (এ সম্পর্কিত নির্দেশ)।’
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ জুহাইফাহ (রাঃ)

সহিফা হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ একটি হাদীস সংকলন, যা হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ছাত্র হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ সংকলন করেন। তিনি ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ এর ভাই ছিলেন। ঠিক কত সালে তিনি এই হাদিস গ্রন্থ সংকলন করেন জানা না গেলেও আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু এর মৃত্যুর আগে সংকলন করেন বলেই আলেমদের গবেষণা পরিষ্কার করে। সেই হিসেবে হাদিস গ্রন্থটি হিজরী ৫৮ সালের আগেই সংকলিত [6]। এর সংকলনকারী অষ্টম শতাব্দী এর একজন হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ। এটি পরে বিংশ শতাব্দীতে মুহাম্মাদ হামিদুল্লাহ তাহকীক করে প্রকাশ করেন। এই বইয়ের দুইটি কপি; একটি পাওয়া যায় দামেস্ক এর গ্রন্থাগার এবং অন্যটি বার্লিনের একটি গ্রন্থাগারে। ড. হামিদুল্লাহ এই দুটি পাণ্ডুলিপি সামনে রেখে সম্পাদনা করেন। শুরুতে একটি বিস্তৃত ভূমিকাও লেখেন যা যেমন তথ্যবহুল, তেমনি প্রাঞ্জল । তিনি আরবীর সাথে সাথে উর্দু ও ফরাসি ভাষাতেও এই সাহিফা হাম্মাম ইবন মুহাব্বিহ প্রকাশ করেন। আগ্রহী পাঠকের জন্য সেই বইটির পিডিএফ লিঙ্ক আপনাদের দেয়া হলো [7]। এরপরে ইমাম আবু হানিফা হাদিস সংকলন করেন [8] , এরপরে আসে ইমাম মালিকের হাদিস [9]

হাদিস গ্রন্থসমূহের মধ্যে ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা” সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান প্রামান্য হাদীসগ্রন্থ। তিনি প্রায় একলক্ষ হাদীস থেকে যাচাইবাছাই করে প্রায় একহাজার নয়শ হাদীস সংকলন করেছেন। তার জন্ম: ৭১১ খ্রিস্টাব্দ, ৯৩ হিজরী – মৃত্যু ৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭৯ হিজরীর ৭ই রবিউস সানি। ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা” গ্রন্থটি হাদীস সংকলনের ব্যাপারে বিপুল-উৎসাহ উদ্দিপনার সৃষ্টি করেছিল। এটি হাদীসশাস্ত্র অধ্যায়নে মুসলিম মণিষীদের প্রধান আর্কষণে পরিণত হয়েছিল। এর পূর্বে ইমাম আবু হানীফা দেশ-দেশান্তরে সফর করে বিপুল পরিমাণ হাদীস সংগ্রহ করেছেন তার সংখ্যাই হলো ৪০ হাজার। এই ৪০ হাজার থেকে সহীহ ও আমলযোগ্য আহকামের হাদীসগুলো বাছাই করে তিনি একটি হাদীসের কিতাব লিখেন, যার নাম কিতাবুল আছার। এ বিষয়ে সদরুল আইম্মা মুয়াফফাক বিন আহমদ ‘মানাকিবুল ইমামিল আযম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ৪০ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে কিতাবুল আছার লিখেছেন। [10]

এরই ফলশ্রূতিতে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে সর্বত্র হাদীস চর্চার কেন্দ্র কিতাবুল “উম্ম” এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের “মাসনাদ” গ্রন্থদ্বয় হাদীসের উপর গুরুত্বপুর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। এরপরে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে অনেক মুসলিম মণিষী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর হাদীস সংগ্রহ করেন। তন্মধ্যে বিখ্যাত হলেন ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ, এবং ইমাম ইবনে মাজাহ। এদের সংকলিত হাদীস গ্রন্থগুলো হলো সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবূ দাউদ, সুনান আত-তিরমিজী, সুনানে নাসাই এবং সুনানে ইবনে মাজাহ। এই ছয়খানা হাদীসগ্রন্থকে সন্মিলিতভাবে সিহাহ সিত্তাহ বা ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ বলা হয়। আব্বাসিয় যুগে হাদীস লিপিবদ্ধের কাজ পরিসমাপ্ত হয়।

তথ্যসূত্র

  1. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ১১৪ []
  2. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ১২০ []
  3. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ১১৯ []
  4. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ১৭৪৯ []
  5. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২৮৩৩ []
  6. Are There Any Early Hadiths? []
  7. সহিফা হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ []
  8. ইমাম আবু হানিফার হাদিস সংকলন গ্রন্থ []
  9. প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড []
  10. ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ: ১৬৪ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"