কোরআনে উত্তরাধিকার আইনের মধ্যে রয়েছে একটি বড় ধরণের সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে খলিফা উমরের আমলে আউল নীতির উদ্ভাবন করতে হয়, কারণ কোরআন অনুসারে হিসেব করলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পত্তি সঠিকভাবে ভাগ করা যায় না। খলিফা উমরের আমলে এই নিয়ে একটি সমস্যার উদ্ভব ঘটায় উমরের আমল থেকে এই আউল নীতি মুসলিম সমাজে চালু আছে। কিন্তু এই আউল নীতি অনুসরণ করলে কোরআনের আয়াত সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় না। আবার, ইবনে আব্বাস আরেকটি পদ্ধতিতে সম্পত্তি ভাগ করতে বলতেন, যেটি কোরআনের নিয়ম অনুসরণ করে বটে, কিন্তু সেখানে যেই সমস্যাটি হয়, তা হচ্ছে পরে আর সম্পত্তির কোন অংশ থাকে না। শেষের দিকে যারা থাকেন, তারা আর কোন অংশ পান না। আসুন এই বিষয়টি সংক্ষেপে আলোচনা করি। পরিবর্তীতে আরও বিস্তারিতভাবে এটি আলোচনা করা হবে। এই বিষয়ে আমাদের যে বিষয়টি জানা থাকা জরুরি তা হচ্ছে, কোন কিছু ভাগ করার সময় ভগ্নাংশগুলোর যোগফল সর্বদাই ১ হতে হবে। এর এর কম বা বেশি হওয়া যাবে না। কারণ সম্পূর্ণ সম্পত্তিকেই এক হিসেবে ধরে ভাগ করা হয়। যেমন ধরুন, একটি পিটজা ভাগ করার সময় যদি ১/৮ করে ভাগ করা হয়, তবে মোট ৮ টি টুকরো হবে এবং ১/৮+১/৮+১/৮+১/৮+১/৮+১/৮+১/৮+১/৮ = ১ হবে। যদি ৯ বা ১০ জন মানুষ থাকে, শেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা আর কোন পিটজার অংশ পাবেন না। কারণ ১/৮ করে টুকরো করা পিটজাকে কে ৮ জনার বেশী মানুষের মধ্যে ভাগ করে দেয়া যাবে না। যোগফল যদি ১ এর বেশি হয়ে যায়, তাহলে ১ এর বেশী আর কাউকে অংশ দেয়া যাবে না। এগুলো স্কুলজীবনেই মানুষ পাটিগণিত করলে শিখে যায়।
এবারে আসুন কোরআনের উত্তরাধিকার আইনটি পড়ি। প্রথমেই এই সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতগুলো পড়ে নিই,
আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেনঃ একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর অংশের সমান। অতঃপর যদি শুধু নারীই হয় দু`এর অধিক, তবে তাদের জন্যে ঐ মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্যে অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতার মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের সন্তান থাকে। যদি সন্তান না থাকে এবং পিতা-মাতাই ওয়ারিস হয়, তবে মাতা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। অতঃপর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকে, তবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ ওছিয়্যতের পর, যা করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রের মধ্যে কে তোমাদের জন্যে অধিক উপকারী তোমরা জান না। এটা আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত অংশ নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, রহস্যবিদ। (কুরআন-৪:১১)
আর, তোমাদের হবে অর্ধেক সম্পত্তি, যা ছেড়ে যায় তোমাদের স্ত্রীরা যদি তাদের কোন সন্তান না থাকে। যদি তাদের সন্তান থাকে, তবে তোমাদের হবে এক-চতুর্থাংশ ঐ সম্পত্তির, যা তারা ছেড়ে যায়; ওছিয়্যতের পর, যা তারা করে এবং ঋণ পরিশোধের পর। স্ত্রীদের জন্যে এক-চতুর্থাংশ হবে ঐ সম্পত্তির, যা তোমরা ছেড়ে যাও যদি তোমাদের কোন সন্তান না থাকে। আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে, তবে তাদের জন্যে হবে ঐ সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ, যা তোমরা ছেড়ে যাও ওছিয়্যতের পর, যা তোমরা কর এবং ঋণ পরিশোধের পর। যে পুরুষের, ত্যাজ্য সম্পত্তি, তার যদি পিতা-পুত্র কিংবা স্ত্রী না থাকে এবং এই মৃতের এক ভাই কিংবা এক বোন থাকে, তবে উভয়ের প্রত্যেকে ছয়-ভাগের এক পাবে। আর যদি ততোধিক থাকে, তবে তারা এক তৃতীয়াংশ অংশীদার হবে ওছিয়্যতের পর, যা করা হয় অথবা ঋণের পর এমতাবস্থায় যে, অপরের ক্ষতি না করে। এ বিধান আল্লাহর। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল।
(কুরআন-৪:১২)
উপরের আয়াতদুটো হচ্ছে সম্পত্তির হিসেবের আয়াত। ছেলে মেয়ে স্বামী স্ত্রী কে কতটুকু সম্পত্তি পাবেন তার হিসেব। আচ্ছা, এবারে আসুন ধরি, জনাব আবুল মিয়ার পরিবারে রয়েছে তার বৃদ্ধ পিতা মাতা, তার স্ত্রী, এবং তিন কন্যা। আবুল মিয়া মারা গেলেন, এবং উনার সম্পত্তি কোরআনের উপরের আয়াত মোতাবেক ভাগ বাটোয়ারা করা হবে। হিসেব করার সুবিধার জন্য ধরে নিচ্ছি আবুল মিয়া ১০০ টাকার সম্পত্তি রেখে গেছেন। এখন ভাগ বাটোয়ারা কীভাবে করবো?
১। মৃতের পিতা-মাতার মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের সন্তান থাকে।
- এই আয়াত অনুসারে যেহেতু মৃতের সন্তান আছে, তাই তার বৃদ্ধ পিতা মাতা প্রত্যেকে পাবেন ছয় ভাগের এক ভাগ করে। অর্থাৎ এক একজন পাবেন (১০০÷৬ = ১৬.৬৬) টাকা করে। দুইজন মিলেে পাবেন ১৬.৬৬×২ = ৩৩.৩৩ টাকা।
২। আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেনঃ একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর অংশের সমান। অতঃপর যদি শুধু নারীই হয় দু`এর অধিক, তবে তাদের জন্যে ঐ মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্যে অর্ধেক।
- এবারে আসুন তার তিন কন্যা কতটুকু সম্পত্তি পাবে তার হিসেবে। উপরের আয়াত থেকে বোঝা যায়, আবুল সাহেবের তিন কন্যা পাবে মালের তিনভাগের দুই ভাগ। অর্থাৎ ( ১০০× ২/৩ = ৬৬.৬৭) টাকা।
৩। স্ত্রীদের জন্যে এক-চতুর্থাংশ হবে ঐ সম্পত্তির, যা তোমরা ছেড়ে যাও যদি তোমাদের কোন সন্তান না থাকে। আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে, তবে তাদের জন্যে হবে ঐ সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ, যা তোমরা ছেড়ে যাও ওছিয়্যতের পর, যা তোমরা কর এবং ঋণ পরিশোধের পর।
- এবারে মৃত আবুল মিয়ার স্ত্রীর হিসেব। উপরের আয়াত মোতাবেক তিনি পাবেন আট ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ (১০০÷৮ = ১২.৫০) টাকা।
এভাবে আসুন হিসেব করি। আবুল সাহেব মোট ১০০ টাকা রেখে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে কোরআনের এই নিয়ম অনুসারে
যারা পাবেন | যত পাবেন |
পিতামাতা | ৩৩.৩৩ টাকা |
তিন কন্যা | ৬৬.৬৭ টাকা |
স্ত্রী | ১২.৫০ টাকা |
মোট | ৩৩.৩৩ + ৬৬.৬৭ + ১২.৫০ = ১১২.৫০ টাকা |
কিন্তু টাকাগুলো ভাগ করে দেয়ার সময় দেখা যাছে, ১২.৫০ টাকা কম হয়ে যাচ্ছে। মোট টাকা আছে ১০০, অথচ সবাইকে দিতে হবে ১১২.৫০। এই বাড়তি ১২.৫০ টাকা কোথা থেকে আসবে? আল্লাহ পাক নাজিল করবেন? এরকম বড় ধরণের গাণিতিক ভুল দিয়ে সম্পত্তির হিসেব করা খুবই বিপদজনক।